Featuredআ’মলআক্বীদা

আশুরা দিবস : করণীয় ও বর্জনীয়

মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান

আরবি চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাস মহররম। রাসূল্লাহ (সা.) এ মাসকে ‘আল্লাহর মাস’ এবং এ মাসের দশম তারিখ তথা আশুরার দিনকে ‘আল্লাহর দিন’ বলে অভিহিত করেছেন। হাদিস শরিফে এ মাস ও আশুরা দিবসের রোযা সম্পর্কে অনেক বর্ণনা এসেছে।

হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায হচ্ছে মধ্যরাতের নামায, আর রমযান মাসের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা হচ্ছে আল্লাহর মাসের রোযা, যাকে তোমরা মহররম বলে থাকো। (মুসলিম, আহমদ, হাকিম)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, জাহিলি যুগের লোকেরা আশুরার দিনে রোযা রাখতো। রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং মুসলমানগণও রামাদানের রোযা ফরয হবার পূর্বে এ দিনে রোযা রাখতেন। যখন রামাদানের রোযা ফরয হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আশুরার দিন হলো আল্লাহর দিনসমূহের মধ্যে একটি। সুতরাং যে চায় সে যেন এ দিনে রোযা রাখে। (বুখারি)
উপরোক্ত দুটি হাদিস ছাড়াও আরো বিভিন্ন হাদিসের ভিত্তিতে মহররম ও আশুরা দিবসের ফযিলত সুপ্রমাণিত।

আশুরা দিবসে আমাদের করণীয়
১. আশুরা দিবসের প্রধান করণীয় হলো রোযা রাখা।
হাদিস শরিফের ভাষ্যানুযায়ী হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়ের মুক্তি এবং খোদাদ্রোহী ও অত্যাচারী ফেরাউনের সলিল সমাধির ভিত্তিতে আশুরার দিন ইহুদি সম্প্রদায়ের নিকট অত্যন্ত মর্যাদাবান ও সম্মানিত ছিল। তারা এ দিনে রোযা রাখতো। জাহিলি যুগে কুরায়শরাও এ দিন রোযা রাখতো। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও তখন রোযা রাখতেন। মদিনায় হিজরতের পর তিনি মুসলমানদেরকেও আশুরার রোযা রাখার নির্দেশ দেন। তবে যাতে ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য না হয় সেজন্য দু’দিন রোযা রাখার বিধান জারী করেন। এ হিসেবে আশুরার দিন ও এর পূর্বের কিংবা পরের একদিন মিলিয়ে মোট দুদিন রোযা রাখা সুন্নত।

২. বিভিন্ন নেক আমল ও দুআ-ইস্তিগফার করা। এ ক্ষেত্রে কোনো আমল নির্দিষ্ট করা উচিত নয়। সাধারণভাবে যে কোনো নেক আমল করা যাবে।

৩. কোনো কোনো হাদিসে আশুরা দিবসে পরিবার-পরিজনের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করার ফযীলত সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। যেমন: ইমাম তাবারানীর ‘আল মুজামুল কাবীর’ গ্রন্থে আছে, আশুরার দিন যে তার পরিবারে পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করবে সে সারা বছর স্বচ্ছলতায় কাটাবে। অন্য বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহ তাকে সারা বছর স্বচ্ছলতায় রাখবেন।
এ হাদিসের সনদ নিয়ে মুহাদ্দিসীনে কেরামের মধ্যে এখতেলাফ রয়েছে। কেউ কেউ একে দুর্বল বলেছেন আবার কেউ কেউ হাসান বলেছেন। হাসান হাদিস দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য আর দুর্বল হাদিস ফযীলতের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। সূতরাং সাধারণভাবে এ দিনে পরিবার-পরিজনের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে কোনো অসুবিধা নেই।

আশুরা দিবসে বর্জনীয় কাজসমূহ
দশই মহররম হযরত হোসাইন (রা.)-এর নির্মম শাহাদাতের প্রেক্ষিতে উম্মতের জন্য একটি শোকাবহ দিন। কিন্তু তাই বলে এ দিনে শোক প্রকাশের নিমিত্ত এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যা ইসলামসঙ্গত নয়। যেমন:
১. শরীরকে জখম ও রক্তাক্ত করা,
২. বুক চাপড়ানো,
৩. চেহারায় আঘাত করা,
৪. মাতম বা আহাজারি করা
৫. জাহিলি যুগের মতো কথা-বার্তা বলা ইত্যাদি।

হাদিস শরিফে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যারা মুখ চাপড়ায়, কাপড় ছিড়ে ও জাহিলি যুগের কথা-বার্তা বলে তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

অন্য হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় চোখ অশ্রুসজল হয়, অন্তর ব্যথিত হয় কিন্তু আমরা এমন কিছু মুখে উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের নিকট অপছন্দনীয়।

উল্লেখ্য যে, রাফিযি তথা শিয়ারা তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে আশুরার দিনে শোক পালন করে। এটি ইসলামের প্রকৃত আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং এদিন মাতম, কান্নাকাটি ও শোক পালন থেকে বিরত থাকা উচিত। অন্যদিকে শিয়াদের শোকের বিরোধিতা ও আহলে বায়তের সাথে শত্রুতাবশত খারিজী ও জাহিল-মুর্খরা এ দিনে আনন্দ উৎসব পালন করে। এরূপ করাও সত্যপন্থী মুসলমানদের জন্য উচিত নয়।

আল্লামা ইবনে হাজার আল হায়সামী লিখেছেন: “খবরদার! শিয়াদের বিদআতী প্রথা, যেমন হা-হুতাশ, কান্নাকাটি ও শোক পালন থেকে বিরত থাকবে। কারণ, এসব মুমিনদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসব জায়িয হলে নবী করিম (সা.)-এর ওফাত দিবসে তা করা অধিক সমীচিন ও যুক্তিযুক্ত হতো। অনুরূপভাবে আহলে বায়তের বিপক্ষে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত খারিজী ও মুর্খদের বিদআত থেকে দুরে থাকবে, যারা ধ্বংস দিয়ে ধ্বংসকে, বিদআত দিয়ে বিদআতকে এবং মন্দের মাধ্যমে মন্দকে মুকাবিলা করে। যেমন: শিয়াদের শোকের বিপরীতে অত্যধিক আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ, আশুরার দিনকে ঈদের দিনে রূপান্তর, এ দিনে চুলে কলপ, চোখে সুরমা ও নতুন পোষাক পরে সাজসজ্জায় মেতে উঠা, অতিরিক্ত ব্যয় ও সাধারণ অভ্যাসের চেয়ে উন্নত খাবার ও খিচুড়ি পাকানো ইত্যাদি। তাদের বিশ্বাস মতে এসব সুন্নত ও ধারাবাহিকভাবে চলে আসা আমল। অথচ এ জাতীয় কর্মকাণ্ড বর্জন করাই হলো সুন্নাত। কেননা এসব কাজের পক্ষে নবী করীম (সা.) থেকে নির্ভরযোগ্য কোনো হাদিস ও সাহাবায়ে কেরাম থেকে গ্রহণযোগ্য বিশুদ্ধ কোনো বর্ণনা নেই।” (আস সাওয়াইকুল মুহরিকাহ)

শোকের মাস কিংবা অশুভ সময় মনে করে কেউ কেউ মহররম মাসে বিবাহ-শাদী থেকে বিরত থাকে। এটি সম্পূর্ণ অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার। এ মাসকে অশুভ মনে করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) এ মাসকে ‘আল্লাহর মাস’ বলে অভিহিত করেছেন।

শেষ কথা:
আশুরা দিবস অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি দিন। এ দিন এক দৃষ্টিকোণ থেকে শোকের হলেও এতে কোনো ধরণের বাড়াবাড়ি কিংবা শরিয়তের সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। বরং হাদিসে নববীর বর্ণনার আলোকে রোযা রাখা, কুরআন মজীদের বর্ণনার আলোকে বিপদের কথা স্মরণ করে বেশি করে ইসতিরজা (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) পাঠ করা এবং সাধারণভাবে অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রত্যাশায় নিয়োজিত হওয়া উচিত।

লেখকঃ বিশিষ্ট ইসলামী গবেষক, প্রবন্ধকার, প্রভাষক- বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসা।

Related Articles