জীবনীমনীষা

সূফী কবি শিতালংশাহ : সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

লেখক: মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান 

সিলেট বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী। হযরত শাহজালাল, শাহপরাণসহ ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি এ সিলেট। স্বভাবতই এখানে যুগে যুগে, কালে কালে জন্ম নিয়েছেন অনেক ওলী-আউলিয়া। আর তাঁদের রচিত সাহিত্য, কবিতা ও গানে রয়েছে আধ্যাত্মবাদ তথা সূফীবাদের নিদর্শন। সিলেট বিভাগে সূফী ভাবধারার কাব্য রচনায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের সংখ্যা অনেক। তাদের মধ্যে রয়েছেন গোলাম হোসেন, সৈয়দ মুসা, সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ শাহনূর, শাহ আবদুল ওয়াহ্্হাব, শিতালং শাহ, শেখ ভানু, হাফিয হাতিম, শাহ আরকুম প্রমুখ। এদের মধ্যে শিতালংশাহ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ এবং তাঁর রচিত কবিতা বা গানসমূহ অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর সূফীধারার এ গানসমূহ ‘শিতালংগী রাগ’ নামে পরিচিত।

১২০৭ বাংলা সনে (১৮০৬ খৃ.) সূফী সাধক শিতালংশাহ’র জন্ম। তিনি বৃটিশ ভারতের সিলেট জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার বদরপুর থানার (বর্তমানে ভারতের অংশ) চাপঘাট পরগনায় শ্রীগৌরি মৌজার শিলচর খিত্তায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জাঁহান বখশ, মাতা সুরতজান বিবি। (সৈয়দ মোস্তফা কামাল, বাংলার মুসলমানদের ধর্মীয় সামাজিক রঙ্গমঞ্চের অন্তরালে : বিবিধ প্রসঙ্গ, পৃষ্ঠা ১০৩)

তার প্রকৃত নাম মোহাম্মদ সলিম। শিতালং তার বিনয়সূচক নাম, যার অর্থ পায়ের গোড়ালীর গিরা। (ফজলুর রহমান, সিলেটের মরমী সঙ্গীত, পৃষ্ঠা ৩৭)

তিনি স্বীয় কবিতায় আপন পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে :

“শিতালঙ নাম মোর গুনা বেশুমার

কৃপা যদি করে আল্লা করিম গফফার।

মোহাম্মদ সলিম উরফে দোষ গুণে মাজুর

জাহান বখশ আলী নাম পিতার মশহুর।

পরগণা চাপঘাট মোর পয়দায়িশ যেথায়

শ্রীগৌরি মৌজাতে, শিলচর খিত্তায়।” (ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭)

জনশ্রুতি আছে যে, শিতালংশাহ’র বাবা জাহান বখশ ছিলেন ঢাকার নবাব বংশের লোক। ব্যবসা উপলক্ষে তিনি সিলেট এসেছিলেন। নৌকাডুবিতে তার ব্যবসায়ের মালামাল পানিতে তলিয়ে যায়। এরপর তিনি জমিদার মীর মাহমুদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। মীর মাহমুদ তার গুণে মুগ্ধ হয়ে আপন কন্যা সুরতজানকে তার সাথে বিবাহ দেন। তিনি মেয়ে জামাইকে তারিনীপুর গ্রামে বেশ কিছু ভূসম্পত্তিও খরিদ করে দেন। জাহান বখশ তারিনীপুরে বসতি স্থাপন করেন। তার কনিষ্ঠ পুত্রের অধঃস্তন বংশধরগণ এখনও তারিনীপুরে বসবাস করছেন। (সৈয়দ মোস্তফা কামাল, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০৩)

শিতালং শাহ তারিণীপুর মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পরে তিনি বর্তমান গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি মাদরাসায় ভর্তি হন। এখানে তিনি ইলমে দ্বীন অর্জন করেন। পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতার তা’লীম গ্রহণ করতে থাকেন আপন মুরশিদের কাছে। তিনি কয়েকজন কামিল উস্তাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তার কবিতায় তাদের নামও পাওয়া যায়। তারা হলেন শাহ আবদুল আলী, শাহ আবদুল ওয়াহাব ও শাহ আবদুল কাদির (র.)। এদের মধ্যে শাহ আবদুল ওয়াহাব ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ ওলী-আল্লাহ ও সূফি কবি। ভব তরান, হাসর তরান, ভেদকায়া ইত্যাদি তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। দ্বিতীয় মুরশিদ শাহ আবদুল কাদিরও স্বনামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ‘বাহরে সালিকিন’ গ্রন্থের রচয়িতা। আপন মুরশিদের পরিচয় প্রদান করে শিতালংশাহ লিখেছেন :

শাহ আব্দুল আলী মোর পীর দস্তেগীর

হাসিল মুরাদ ছিলা বাতিনে জাহির।

মুর্শিদ কামিল শাহ আব্দুল ওহাব

তিনির প্রসাদে হইল ধেয়ানেতে লাভ।

দ্বিতীয় মুর্শিদ শাহ আব্দুল কাদির

শিশুকালে কেরামতি আছর জাহির।

এই দুই সাহেব মোরে রাখিয়া কৃপায়

ভেদ মর্ম শিক্ষা দিলা তওজ্জু নিঘায়। (ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭)

শিতালংশাহ আধ্যাত্ম সাধনার এক পর্যায়ে স্বীয় মুরশিদ শাহ আবদুল ওয়াহাব (র.)-এর নির্দেশে ঘর-সংসার ত্যাগ করে ভূবন পাহাড়ে চলে যান। এই পাহাড়ে তিনি অনেক বছর নির্জন সাধনায় অতিবাহিত করেন। এদিকে পুত্রের বিরহে মা ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তিনি চারজন লোককে ফুলবাড়ীতে শাহ আবদুল ওয়াহাব (র.)-এর নিকট পাঠান। শাহ আবদুল ওয়াহাব (র.) তাদেরকে এ মর্মে আশ্বস্থ করেন যে, শিতালংশাহ আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বাড়িতে আসবেন। ছেলের আসার খরব শুনে মা নানা ধরনের পিঠা, পুলি, দুধের সর জমা করে শিকায় তুলে রাখেন। এক রাতে শিতালংশাহ বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় এসে মাকে ডাক দেন। মা বের হয়ে বাঘ দেখে ভয় পেয়ে যান। তখন তিনি মাকে বলেন, “ভয় কর না মা, এরা আমার পোষা কুকুরের মতো। শিকায় রাখা পিঠাগুলো নিয়ে আস আর খুশি মনে আল্লাহর রাস্তায় আমাকে বিদায় দাও। তা না হলে কিছুই হাসিল হবে না।” মা খাবার দিলে তিনি কিছু খেয়ে মাকে খুশি করলেন এবং আল্লাহর ওয়াস্তে বিদায় দিতে অনুরোধ করলেন। তার মা ‘আল্লাহর হাওলা’ বলার সাথে সাথে বাঘ তাকে নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল। এরপর দীর্ঘদিন কেউ তার কোনো খোঁজ পায়নি। দীর্ঘ এগারো বছর পর লাউড়ের পাহাড়ের পাদদেশে শাহ আরফিনের মাজারের পাশে এক মাছ শিকারী ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তাকে দেখতে পেয়ে তার নিকট গমন করে। কিন্তু কোনো কথা না বলে বাড়ি চলে যায়। পরদিন এক ঘটি গরম দুধ নিয়ে আবার সে স্থানে আসে। কিন্তু তিনি চোখ না খোলায় লোকটি কথা বলতে সাহস পায়নি। ফলে সে দূরে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। এক সময় ধ্যান ভেঙ্গে ওযূ করে তিনি নামায আদায় করতে লাগলেন। লোকটি এ সময় তার কাছে এসে দাঁড়ালো। নামায শেষে তিনি তাকে চলে যেতে বললেন। লোকটি তাকে দুধটুকু পান করার অনুরোধ করলো। তিনি তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য দুধ পান করলেন। পরদিন লোকটি নির্দিষ্ট সময়ে আবার দুধ নিয়ে হাজির হলো। এ দিন তিনি তার সাথে কথা বললেন। কথা প্রসঙ্গে লোকটি নাম জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘শিতালং’। বাড়ী কোথায়? জবাব দিলেন, ‘কাছাড়’। এ সংবাদ লোকমুখে প্রচার হলে আস্তে আস্তে লোকজনের আনাগোণা শুরু হয়। একদিন সবার অগোচরে সে স্থান ত্যাগ করে তিনি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। (সৈয়দ মোস্তফা কামাল, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০৫)

মুর্শিদ শাহ আবদুল ওয়াহাব (র.)-এর পক্ষ থেকে তার নিকট এ সময় ধর্মপ্রচার ও সংসারী হবার নির্দেশ আসে। ফলে তিনি বদরপুরের গড়কাপন মৌজার মাজু মিয়ার বোনকে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার জ্ঞান, চরিত্র মাধুর্য ও কারামত দেখে অনেক লোক তার কাছে মুরীদ হতে থাকে। তার সম্পর্কিত অনেক অলৌকিক ঘটনা লোকমুখে প্রচলিত আছে।

শিতালং শাহ ছিলেন একজন সূফি সাধক ও স্বভাব কবি। তার জীবন যাপন অত্যন্ত সহজ সরল ছিল। তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করতেন, শরীয়তের বিধি-নিষেধ অনুসরণে জীবন পরিচালনা করতেন এবং মুরীদদেরকে শরঈ বিধান মেনে চলার নির্দেশ দিতেন। শরঈ বিধান মেনে না চললে এর পরকালীন ভয়াবহ পরিণতির বিষয়েও সতর্ক করতেন। তার রাগসমূহে এসবের নিদর্শন রয়েছে। তার রাগের কয়েকটি কলি এখানে উপস্থাপন করা হলো :

এলাহি হায় হায়রে মাবুদ রহমান

এ দুঃখ সংকটে তুই মুস্কিল আছান

ভীষণ সংকট দেখি না দেখি উপায়

ভূমিতে রাখিয়া মাথা কান্দে নছুফায়।

ভীষণ সংকট আজি ঘটিল আমার

সংকটে পড়িয়া কান্দি ছত্তার ছত্তার।

রব্বুল আলম তুই গফুরুর রাহিম

ঘটিয়াছে আজি মোর মস্কিল আজিম

বেসমার পাপ মোর অন্তর সায়র

পাপ ক্ষেমা কর মোর কিরপার সাগর। [নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত, মরমী কবি শিতালং শাহ, (শিতালং-গীতি সংগ্রহ, গীতি নং ৩৫) বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০০৫]

আমার দিন যায়রে বেহুশে মজিয়া

কি কাজে আইলাম ভবে না চাইলাম তলাইয়া

বনিজ করিতে আইলাম পরার ধন লইয়া

খুয়াইলাম পুঞ্জিপাতা কামানদী ডুবাইয়া

কত কত সাধুজ্ঞানী এই নদীতে আইয়া

কত কত পুঞ্জিপাতা গেছৈন খুয়াইয়া

কাম নদীতে ছয় ডাকাইত সদায় থাকে বইয়া

বেপারী বেখিয়াল অইলে মাল নেয় লুটিয়া।

এই নদীতে শতধার কেমনে যাইতাম বাইয়া।

ধরোগি মুর্শিদ রতন কামিল আলিম চাইয়া।

বরাতের জোরে যদি মুর্শিদ যাও পাইয়া

তছবি তহলিলে দিবা বাঁচার পথ বাতাইয়া।

শিতালং ফকিরে কয় মনারে ভাইয়া

কামনদীর ফাড়ি শিখো মুর্শিদবাড়ি যাইয়া। (গীতি নং ১৫)

নামাজ পরম ধনরে নামাজ পরম ধন

আখেরে নামাজে হবে আনন্দিত মন

যেজন নামাজ পড়ে প্রেমভাবে মন

তাহার হৃদয় হবে নুরেরই রওশন। (প্রাগুক্ত, গীতি নং ১১০)

বেনামাজি কয়বরে ঠেকিবা মহাদায়

কাহহারের দৃষ্টি তারে করিবা আল্লায়

বেনামাজির উপরে হইবে আল্লাহর লান্নত

বাড়িতে থাকিবে তার আজাব শিদ্দত। (প্রাগুক্ত, গীতি নং ১৬৪)

আপন কর পরিচয় পন্থ চিনরে

ও মন পাঁচ আনফাছেতে জপ নাম

সংবেদন করিতে মনে ইচ্ছা হয় যার

প্রেমানলে জ্বলি করে প্রেমের বিহার। (প্রাগুক্ত, গীতি নং ১৩)

ও ভাই নাম জপরে দমের জিকির

তছবি তহমিদ জপো তহলিল ও তকবির

তছবিহ জপিলে হয় বেশি মোনাছিব

আউয়াল আখেরে হবে বুলন্দ নসিব। (প্রাগুক্ত, গীতি নং ৪১)

এখানে শিতালঙ্গী রাগের কয়েকটি নমুনা উপস্থাপন করা হলো। এগুলো থেকেই শিতালং শাহের পরিচয় অনুধাবন করা সম্ভব। নন্দলাল শর্মা তার সংকলিত ও সম্পাদিত ‘মরমী কবি শিতালং শাহ’ গ্রন্থে ২৪১টি শিতালংগীতি উল্লেখ করেছেন। শিতালং শাহ বাংলাদেশের সূফি সাহিত্যে এক সুপরিচিত এক নাম। তিনি আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *