আ’মল

আহলে হাদীস আলেমদের দৃষ্টিতে শবে বরাতের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য

আহলে হাদীস আলেমদের দৃষ্টিতে শবে বরাতের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য
—–মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান

অর্ধ শাবানের রজনী তথা শবে বরাতের ফযীলত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ সম্পর্কে প্রায় ২২ টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যাদের কোনোটি সহীহ, কোনোটি হাসান আবার কোনোটি দ্বয়ীফ স্তরের। এ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর কয়েকটি বর্ণনা সহীহ স্তরের; যা আহলে হাদীসদের পূর্বসূরীদের নিকটও গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু বর্তমান যুগের সহীহ হাদীস অনুসরণের দাবীকারী তথাকথিত লা-মাযহাবীরা এ সকল হাদীসকে অস্বীকার করে শবে বরাতকে ভিত্তিহীন বলে অপপ্রচার করে। সহীহ হাদীসকে অস্বীকার করা একমাত্র হাদীস অস্বীকারকারী ভ্রষ্টগণ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। মাআযাল্লাহ।
নামধারী আহলে হাদীসরা তাদের চলার পথে যাদেরকে অনুসরণ করে থাকে তারাও শবে বরাতের মর্যাদা ও তাৎপর্যকে অস্বীকার করেন নি।
নিচে শবে বরাত সম্পর্কে আহলে হাদীসদের কয়েকজন গুরুর মূল্যবান বাণী উপস্থাপন করছি।

১। হাফিয ইবনু তাইমিয়া
আহলে হাদীসরা হাফিয ইবনু তাইমিয়াকে তাদের ইমাম হিসাবে মান্য করেন। সম্ভবপর সকল ক্ষেত্রেই তারা ইবনু তাইমিয়ার দলীলকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। হাফিয ইবনু তাইমিয়া শবে ববরাত সম্পর্কে বলেন,
وأما ليلة النصف من شعبان ففيها فضلٌ، وكان في السلف من يصلي فيه
–শাবানের মধ্যবর্তী রাত অর্থাৎ শবে বরাতের অনেক মর্যাদা। সালাফে সালেহীনের অনেকে এ রাত্রিতে নামায আদায় করতেন।(আল ফাতাওয়া আল কুবরা, ৪/৪২৮, ইকতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ২৫৮ পৃষ্ঠা)
অন্যত্র বলেন-
إذا صلى الإنسان ليلة النصف وحده أو في جماعة خاصة كما كان يفعل طوائف من السلف فهو أحسن
–যদি কোনো ব্যক্তি শাবানের মধ্যবর্তী রাতে তথা শবে বরাতে একাকী বা বিশেষ জামাতে নামায আদায় করে যেভাবে সালফে সালেহীন করতেন, তাহলে এটা উত্তম। (আল ফাতাওয়া আল কুবরা, ২/২৬২)
তিনি এ সম্পর্কে আরো বলেন-
ليلةُ نصف شعبان رويَ فيها من الأخبار والآثار ما يقتضي أنها مفضلة ومن السلف من خصَّها بالصلاة فيها وصوم شعبان
–অর্ধ শাবানের রাত্রির ব্যাপারে অনেক হাদীস ও আছার বর্ণিত হয়েছে। যদ্বরা এ রাতের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। সালাফ বা পূর্বসুরীদের মধ্যে কেউ কেউ এ রাতে বিশেষ করে নামায আদায় করতেন। শাবান মাসের রোজার ব্যাপারে বিশুদ্ধ হাদীস এসেছে। (ফায়যুল কাদীর, ২/৩১৬)

শবে বরাতের নামায সম্পর্কে তিনি বলেন-
(وصلاةُ الألفية في ليلة النصف من شعبان والاجتماع على صلاةٍ راتبة فيها بدعة وإنما كانوا يصلون في بيوتهم كقيام الليل وإن قام معه بعض الناس من غير مداومة على الجماعة فيها وفي غيرها فلا بأس، كما صلى النبي -صلى الله عليه وسلم- ليلة بابن عباس وليلة بحذيفة
–শবে বরাতের রাতে “আলফিয়্যাহ” নামায আদায় করা বা রাত্রিযাপনের জন্য মসজিদে সমবেত হওয়া বিদআত। তবে কেউ যদি বাড়িতে কিয়ামুল লাইল আদায় করে আর এতে কোনরূপ আহবান ছাড়া লোকেরা তার সাথে নামাযে শরীক হয় তাতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা হাদীসে আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক রাত্রিতে হযরত ইবনে আব্বাস রা. কে নিয়ে অন্য রাত্রিতে হযরত হুযায়ফা র. কে নিয়ে (নফল) নামায আদায় করেছেন।[মুখতাসার ফাতাওয়া আল মিসরিয়্যাহ, ১/২৯১]

২। আব্দুর রহমান মুবারকপুরী
আহলে হাদীসদের দৃষ্ঠিতে ভারত উপমহাদেশে যে কয়জন শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ আছেন শায়খ মুবারকপুরী তাদের অন্যতম। আব্দুর রহমান মুবারকপুরী তার তিরমিযীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেন
اعلم أنه قد ورد في فضيلة ليلة النصف من شعبان عدة أحاديث مجموعها يدل على أن لها أصلاً… فهذه الأحاديث بمجموعها حجة على من زعم أنه لم يثبت في فضيلة ليلة النصف من شعبان شيء والله تعالى أعلم
–অর্ধ শাবানের মাহাত্ম্যের ব্যাপারে একাধিত হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এগুলো সামষ্টিকভাবে প্রমাণ করে যে, এ রাতের একটি ভিত্তি আছে”। এসব হাদীস সামষ্টিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ যারা মনে করে অর্ধ শাবানের রাতের ব্যাপারে কিছুই সাব্যস্ত হয়নি। আল্লাহই ভালো জানেন”। [তুহফাতুল আহওয়াযী, ৩/৩৬৫]

৩। শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী
আহলে হাদীসদের দৃষ্টিতে শায়খ আলবানী উনিশ শতকের একমাত্র জারাহ তাদীলের ইমাম। আলবানীকে তারা কখনো কখনো পূর্ববর্তী যুগের জারাহ তাদীলের ইমামদের থেকেও বেশি মূল্যায়ন করেন। ফলে এমন অসংখ্য হাদীস আছে যা সালাফ যুগের ইমামদের দৃষ্টিতে সহীহ হলেও তাদের কাছে সেটা দ্বয়ীফ। কেননা আলবানী সাহেব বলেছেন এটি দ্বয়ীফ, তাই।
আলহামদুলিল্লাহ, শায়খ আলবানীও শবে বরাত সংক্রান্ত হাদীসকে সহীহ বলেছেন। শবে বরাতের হাদীস উল্লেখ করার পর তিনি লিখেন-
حديث صحيح روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضاً
–হাদীসটি ছহীহ। একদল সাহাবী থেকে বিভিন্ন সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে। যাদের একটি আরেকটিকে মজবুত করে”।
দীর্ঘ আলোচনার পর আলবানী পরিশেষে লিখেন-
وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب، والصحة تثبت بأقل منها عدداً
–মোটকথা হলো, এই সব ধারায় বর্ণিত হাদীসটি নিঃসন্দেহে ছহীহ বা বিশুদ্ধ। এর চেয়ে কমসংখ্যক সূত্র দিয়েও হাদীসের বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়।
[সিলসিলাতু আহাদিসিস সাহীহাহ]

৪। শায়খ সালেহ আল উছাইমিন
আহলে হাদীসদের অন্যতম শীর্ষ আলেম সৌদি আরবের শায়খ সালেহ আল উছাইমিন শবে বরাত সম্পর্কে বলেন,
ومن هذا الباب ليلة النصف من شعبان روي في فضلها أحاديث ومن السلف من يخصها بالقيام ومن العلماء من السلف وغيرهم من أنكر فضلها وطعن في الأحاديث الواردة فيها، لكن الذي عليه كثير من أهل العلم أو أكثرهم على تفضيلها
–শাবানের অর্ধরজনী তথা শবে বরাত সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া সালফে সালেহীন থেকে রাত্রিযাপনের মাধ্যমে এ রাতকে বিশেষায়িত করার প্রমাণ পাওয়া যায়। আলেমদের কেউ কেউ এ রাত্রির মর্যাদাকে অস্বীকার করেছেন। তবে অধিকাংশ উলামায়ে কিরামই এ রাত্রির বিশেষ মর্যাদার পক্ষে। [মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইলি ইবনি উছাইমিন, ৭/১৫৬]

৫। উবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী
আব্দুর রহমান মুবারকপুরীর বিশিষ্ট শাগরেদ উবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী তার লিখিত মিশকাতের ব্যাখ্যাগ্রন্থে শবে বরাত সংক্রান্ত হাদীসগুলো উল্লেখ করার পর লিখেন,
وهذه الأحاديث كلها تدل على عظم خطر ليلة نصف شعبان وجلال
–এ সকল হাদীস শবে বরাতের মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের প্রতি নির্দেশ করে। [মিরআতুল মাফাতিহ, বাবু কিয়ামু শাহরি রামাদান]

পুনশ্চঃ আল্লাহ তাআলা যাকে গোমরাহ করেন তাকে কোন কিছুই হেদায়াতের পথ দেখাতে পারে না।
আল্লাহ যেন আমাদের হেদায়াত দান করেন। আমীন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *