বাংলাদেশে থাকাকালীন আমি কেবল হানাফি ছিলাম। মিশরে এসে (ক্ষেত্রবিশেষে) কিছুটা শাফেয়ী হয়েছি। বাংলাদেশের ধর্মীয় রীতিনীতি যেরূপ হানাফি মাযহাব অনুসারে প্রণীত হয়েছে, মিশরের ধর্মীয় রীতিনীতি সেরূপ শাফেয়ী মাযহাব থেকে গৃহীত হয়েছে। অন্তত আযানের সময়সূচী, জামাতের সময়সূচী, রামাদান মাসে বিতর নামাজ ইত্যাদি শাফেয়ী মাযহাবের অনুসরণে আদায় করতে হয়। তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। দুঃখ নেই দুটি কারণে। প্রথম কারণটি গৌণ, দ্বিতীয়টি মুখ্য।
গৌণ (অগুরুত্বপূর্ণ) কারণটি হল- ইমাম শাফেয়ী তাঁর ইলমের বড় একটি অংশ অর্জন করেছিলেন হানাফি মাযহাবের প্রাণপুরুষ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আশ-শায়বানীর কাছ থেকে। মদীনা তাইয়্যিবায় ইমাম মালিক ইবনে আনাসের কাছে দীর্ঘদিন ইলম অর্জনের পর ইমাম শাফেয়ী বাগদাদে এসেছিলেন এবং ৩ বছর ইমাম শায়বানীর কাছে ইলম অর্জন করেছিলেন। এই ৩ বছর ইমাম শাফেয়ী কোথায় অবস্থান করেছিলেন জানেন? জি, ঠিকই ধরেছেন। টানা ৩ বছর ইমাম শাফেয়ী ইমাম শায়বানীর ঘরে অবস্থান করেছিলেন। কারণ ইমাম শাফেয়ী দরিদ্র ছিলেন। বাগদাদে নিজের ঘর ক্রয় করার সামর্থ তাঁর ছিলনা।
এই ৩ বছর প্রায় প্রতি রাতে ইমাম শাফেয়ী তাঁর উস্তাদ ইমাম শায়বানীর সাথে ফিকহের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে “জ্ঞানমূলক বিতর্ক” করতেন। তাতে ছাত্রের প্রতি উস্তাদের মন বিষাক্ত হয়নি, উস্তাদের প্রতিও ছাত্রের মন নিরুৎসাহিত হয়নি। আমার আফসোস জাগে, আহা! সেই বিতর্কগুলো যদি রেকর্ড করে রাখা যেত!
ইমাম শাফেয়ীর জীবনীকারদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন যে, বাগদাদে অবস্থানকালীন পুরো সময়টি ইমাম শাফেয়ী হানাফি মাযহাব অনুসারে দীনের আইন-কানুন পালন করতেন। ইমাম শাফেয়ী যতবার ইমাম আবু হানিফার কবর যিয়ারতে গিয়েছেন, ততবার সেখানে হানাফি মাযহাব অনুসারে নামাজ আদায় করেছেন।
অতএব ইমাম শাফেয়ী যদি ইমাম আবু হানিফার প্রতি শ্রদ্ধাবশত হানাফি মাযহাব (ক্ষেত্রবিশেষে) অনুসরণ করতে পারেন, তবে আমি এক নগণ্য হানাফিও ইমাম শাফেয়ীর প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাঁর মাযহাব (ক্ষেত্রবিশেষে) অনুসরণ করতে পারি। এতে আমার দীন-ঈমান নষ্ট হবেনা।
ক্ষেত্রবিশেষে শাফেয়ী মাযহাব অনুসরণের দ্বিতীয় এবং মুখ্য কারণটি হল- যে কতিপয় আলিম-উলামার কাছে মুসলিম উম্মাহ চিরঋণী, ইমাম শাফেয়ী তন্মধ্যে অন্যতম। এরচেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
ইমাম শাফেয়ী সুন্দর চেহারা ও হাস্যরসপূর্ণ মেজাজের অধিকারী ছিলেন। তাঁর মুখটি ছিল বাচ্চাদের মতো (Baby face). তাঁর জীবনের অসংখ্য চমকপ্রদ ঘটনার মধ্যে একটি হল- মদীনায় গমন করার পূর্বে তিনি কিছুদিন মক্কায় অবস্থান করেছিলেন। তখন তিনি প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করছেন। তবে প্রাথমিক স্তরে থাকলেও তাঁর জ্ঞান থেকে উপকার নিতে মানুষ পিছপা হতোনা। একদা রামাদান মাসে তিনি মাসজিদুল হারামে রোজার নিয়মনীতি বিষয়ে দরস দিচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পর পানির পাত্র থেকে এক ঢোক পানি পান করলেন। লোকেরা চিৎকার দিয়ে উঠল, এ কী করছেন? আপনি আমাদেরকে রোজার দরস দিচ্ছেন, অথচ নিজে পানি পান করছেন? ইমাম শাফেয়ী হেসে ওঠে বললেন- আমি এখনো নাবালক। আমার ওপর রোজা ফরজ হয়নি!
সুবাহানাল্লাহ! চিন্তা করতে পারেন, কোন বয়স থেকে ইমাম শাফেয়ী উম্মতের ইমাম হয়ে আছেন?
আমার এলাকার মসজিদে তারাবীর নামাজের ইমাম হলেন আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ ফ্যাকাল্টির সহকারী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নাবীল। আজ তাঁর সাথে পরিচিত হলাম। কথার ফাঁকে বললাম- আমি হানাফি মাযহাবের অনুসারী। তিনি বুকে হাত দিয়ে বললেন- ইমাম আবু হানিফাকে আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি।
ড. নাবীলের কথা শুনে আমি ওয়াদা করেছি, যেদিন ইমাম শাফেয়ীর কবর যিয়ারতে যাওয়ার সৌভাগ্য হবে, সেদিন তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলব- আমি একজন হানাফি। কিন্তু আমি আপনাকে নিজের পিতার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা করি। আপনি কেবল শাফেয়ী মাযহাব নয় ; পুরো মুসলিম উম্মাহ’র সম্মানিত ইমাম।