মনীষা
বিচারপতি সৈয়দ আবুল বশর মাহমুদ হোসেন: কিছু স্মৃতি কিছু কথা
হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম। আম্মা বা’দ
মাননীয় সভাপতি, উপস্থিত প্রধান অতিথি, বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, অন্যান্য অতিথিবৃন্দ, উপস্থিত মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ, আইনজীবীবৃন্দ, সাংবাদিকবৃন্দ ও সুধীমন্ডলী, সকলকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি।
আজকে আমরা বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম সৈয়দ আবুল বশর মাহমুদ হোসেন সাহেবের স্মৃতিচারণ ও তার মাগফিরাতের লক্ষ্যে আয়োজিত এ আলোচনা ও মিলাদ মাহফিলে একত্রিত হয়েছি।
মাননীয় বিচারপতি জনাব সৈয়দ আবুল বশর মাহমুদ হোসেন বহুগুণের অধিকারী এক মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি সিলেট তথা বাংলাদেশের বহুল পরিচিত ঐতিহ্যবাহী সায়্যিদ পরিবারের সন্তান, হযরত নাসির উদ্দীন সিপাহসালার (র.)-এর অধঃস্তন বংশধর। তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক মূলত: দ্বীনি কারণে। আমার ওয়ালিদ মুহতারাম হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (র.)-এর মাধ্যমে তাঁর সাথে আমি পরিচিত ছিলাম।
তিনি জীবনের বাঁকে বাঁকে অনেক দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিটি অঙ্গনেই সফলতা ও ন্যায়-নিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রারম্ভিককালে তিনি একজন দক্ষ আইনজীবি ছিলেন। পরবর্তীতে বিচারপতি এমনকি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতির পদও অলংকৃত করেছেন। একজন বিচারপতি হিসাবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি হওয়ার পরও আমাদের মতো মানুষের নিকট তিনি ছিলেন এক দুনিয়াবিরাগী সূফী সাধক। অতি সাধারণ জীবনাচরণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা, জ্ঞানস্পৃহা, ব্যক্তিগত আমল-আখলাক এসব কিছুর কারণে তাঁর ব্যক্তিত্ব আমাদের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ। আমি তাঁর সাহচর্যে ছাত্রজীবনে কিছুকাল অতিবাহিত করেছি। অতি নিকট থেকে তাঁকে দেখেছি, তাঁর নসিহত শ্রবণ করেছি। সে স্মৃতির খাতার দু’একটি পাতা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
নারিন্দা শাহ সাহেব লেনে জাস্টিস সাহেবের বাসভবন। বাসভবনের দক্ষিণ সীমানার একটি কামরায় ছাত্রজীবনে আমি কিছুকাল অবস্থান করি। বাসভবনের পূর্ব পাশে ছিল একটি বিরাট বৃক্ষ। বাড়িতে প্রবেশ করার সময় কে যেন কানে কানে বলতো: ভয় নাই, এ ঘরে এমন একজন বসবাস করেন যিনি দেশ জাতির উপর আল্লাহ তাআলার রহমতের ছায়া। তিনি ইনসাফ কায়েম করার লক্ষ্যে দিবানিশি কর্মব্যস্ত।
শেষ রাতে জাস্টিস সাহেব গাছটির নিচ দিয়ে কুরআন পাকের আয়াত, দুআ সম্বলিত ফারসি উর্দু কবিতা পাঠ করতে করতে পায়চারি করতেন। তাঁর নসিহত মুতাবিক আমি শেষ রাত্রে কামিল জামাতের হাদীস শরীফের কিতাব পড়াশুনা করতাম। একদিন শেষ রাত্রে অনুভব করলাম তিনি বাইরে পায়চারি করছেন। শুনলাম দু’ছত্র কবিতা বারবার কান্নামিশ্রিত কন্ঠে আবৃত্তি করছেন। কান পেতে শুনলাম সেই কবিতা :
موت كو سمجھے هے غافل اختتام زندگى
هے يه شام زندگى صبح دوام زندگى
-হে গাফিল! মৃত্যুকে মনে করেছ জীবনের শেষ। না, মৃত্যু হয়তো এমন এক প্রভাত যে প্রভাত শেষ হবে না অথবা এমন অন্ধকার রাত যে রাত পোহাবে না।
তিনি আমার ছোট্ট কামরার দুয়ারে এসে দাঁড়ালেন। আমি দুয়ার খোলে দিলাম। সালাম জানিয়ে ভিতরে এসে বসার জন্য অনুরোধ করলাম। তিনি আমার সামনে একটি ছোট্ট চেয়ারে বসলেন। চেহারা মুবারকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার দাঁড়ি মুবারক নয়নজলে সিক্ত। কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘সংবাদ এসেছে আমার এক নিকট আত্মীয় মহিলা ইন্তেকাল করেছেন, যিনি আমাকে বাল্যকাল থেকে যৌবনের সীমা পর্যন্ত স্নেহ-মমতা, ভালোবাসার চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। তার এহসানের কথা বারবার মনে পড়ছে।’ তারপর দু’হাত তোলে মরহুমার মাগফিরাতের জন্য, মা-বাবার জন্য, আওলাদের জন্য, দেশ ও জাতির জন্য আবেগময় ভাষায় দুআ করলেন। আমি আমীন আমীন বললাম। শেষ রাত্রির রোনাজারি সর্ম্পকে তিনি মাওলানা রূমী (র.)-এর কবিতা পড়লেন:
چوخدا خواهد كه مارا يارى كند
ميل مارا جانب زارى كند
-আল্লাহ তাআলা যখন আমাদের মহব্বত করতে চান, তখন আমাদের অন্তঃকরণকে কান্নাকাটির দিকে ধাবিত করে দেন।
তাছাড়া উর্দু একটি কবিতা পাঠ করলেন-
عطار هو رومى هو رازى هو غزالى هو
كچھه ھاتو نهيں آتا بے آه سحر گاهى
তারপর মৃত্যু সর্ম্পকে কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন। তিনি কাঁদলেন, আমার মতো কঠিন হৃদয় মানুষকেও কাঁদালেন।
নিঝুম নিরালা রাত। ঘরের পাশের আমগাছের ডালে কোকিলের কণ্ঠে রাত যেন বিদায় নিচ্ছে। মনে হলো চেনা জানা এ পৃথিবী ছেড়ে আমরা যেন ভিন দেশের পথিক। আমি ভুলে গেলাম যে, এ দেশের অত্যন্ত সম্মানিত আসনে সমাসীন মাননীয় বিচারপতি আমার সামনে বসে আছেন বরং আমি অনুভব করলাম যেন এক সংসারবিরাগী দরবেশ লোকালয় ত্যাগ করে কোনো পর্বতের পাশে একটি হুজরায় বসে আমাকে মোহমুক্তির শরবত সরবরাহ করছেন। একটি কবিতা মনে পড়ল:
بوۓ گل نالئه دل دود چراغ محفل
جو تورے بزم سے نكلا سو پرشياں نكلا
-ফুলের খুশবু, ব্যথিত হৃদয়ের কান্না, রাতের আধারে জ্বালানো প্রদীপের ধোঁয়া, তোমার আসর থেকে যে বের হতে চায় তার অবস্থা হয় পেরেশান।
তিনি ছিলেন হযরত শাহ জালাল (র.)-এর অন্যতম সহচর হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (র.)-এর বংশধর। এ প্রসঙ্গে আলাপ করলে তিনি এক ছত্র কবিতা পাঠ করতেন:
نسبت بهت اچھى هے مگر حال برا هے
-সর্ম্পক খুবই উত্তম, কিন্তু আমার অবস্থা মন্দ।
তিনি আরো বলতেন:
پيوسة ره شجر سے اميد بهار ركھر
-হে বৃক্ষের শাখা, গাছের সাথে যদি যুক্ত থাক তবে বসন্তের আশা রাখতে পার।
তিনি বলতেন, আমার পূর্ব পুরুষ হযরত নাসির উদ্দিন সিপাহসালার (র.) কোথায় ছিলেন আর আমি কোথায়?
তিনি সপ্তাহে একদিন পরিবারের সকলকে নিয়ে মাহফিলে বসতেন। মাঝে মধ্যে আমাকে বসার অনুমতি দিতেন। তাঁর ছেলেদের সূরা এখলাছ ও অন্যান্য সূরা তিলাওয়াত করার জন্য বলতেন। খতমে খাজেগান পড়ে সালাত ও সালাম পেশ করে আবেগময় কণ্ঠে দোয়া করতেন। পরিবার পরিজন, মা-বাবা, দেশ ও জাতির জন্য দোয়া করতেন। এখনও আমি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পারিবারিক মাহফিল কায়েম করার জন্য বলি। যারা পারিবারিক মাহফিল করেন তারা সুফল ভোগ করছেন। তাদের ছেলে-মেয়েরা অবাধ্য নয়। তাদেরকে আল্লাহ তাআলা ঘরে বাইরে শান্তি দান করেছেন।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনো মানুষ আমাদের কথা কিংবা কাজে যেন কোনো আঘাত না পায় সে বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন থাকতেন। এক সময় আমি বহু পরিশ্রম করে একখানা ছোট পুস্তক রচনা করেছিলাম। সে পুস্তকে অন্য ধর্ম সর্ম্পকে কিছু সমালোচনা ছিল। তিনি পুস্তকখানা পাঠ করে বললেন, পুস্তকের উদ্ধৃতিসমূহ সত্য, কিন্তু অন্য ধর্মের লোকেরা ভুল বুঝলে হিতে বিপরীত হবে। আপনার কলম ও বক্তব্য যেন কাউকে আঘাত না করে। তারপর একটি কবিতা বললেন:
دلوں كا قرب حاصل كيحۓ راحت رساں هوكر
نفس نے دل ميں جا پائ هے آرام جا هوكر
-মানুষের অন্তরের নৈকট্য লাভ কর আরাম প্রদান করে।
শ্বাস-প্রশ্বাস অভ্যন্তরে আনাগোনা করে অন্তরে আরাম প্রদান করে।
আমি জাস্টিস সাহেবের নিকট গুজারিশ রাখলাম যে, আমি এ ধরনের পুস্তক রচনা থেকে নিজেকে বিরত রাখব এবং এ পুস্তক আমি কখনো ছাপাব না।
ইলমে কিরাত বিষয়ে আমি ছোট একখানা পুস্তক রচনা করে পাাণ্ডুলিপি তার মুবারক হাতে তুলে দিয়েছিলাম। দুই-তিন দিন পর প্রয়োজনীয় সংশোধনীর দিকে ইশারা করে আমার হাতে তুলে দিয়ে একটি মূল্যবান নসীহত করলেন। বললেন, কোনো পুস্তক সর্ম্পকে মন্তব্য লিখার আগে পুস্তকখানা ভালো করে পাঠ করা উচিত। আমি অধম এই নসীহতের উপর সবসময় আমল করি। উক্ত পুস্তকের জন্য তিনি নিজ হাতে তিনছত্র দোয়ামূলক বাণী লিখে স্বাক্ষর করে দিয়েছিলেন। আলহামদুল্লিাহ, পুস্তকখানার ২৮টি সংস্করণ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তার জীবদ্দশায় আমার লিখিত সব পুস্তক তিনি দেখতেন ও জরুরী নির্দেশনা প্রদান করতেন।
তিনি উর্দু ও ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল হাদীস কোর্স শেষ করার পর তিনি আমাকে উর্দু সাহিত্যের উপর দু বছরের একটি বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করার জন্য বলেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমি দু বছরের আদিব ও আদিবে কামিল কোর্স সম্পন্ন করি। কোর্স সম্পন্ন করার পর তিনি আমাকে আল্লামা ইকবাল, গালিব, দরদ, আকবর এলাহাবাদী রচিত কবিতা পাঠ করার জন্য ডাকতেন । আমার মুখে কোনো কবির উর্দু, ফার্সি কবিতা শুনলে ঐ কবির আরো অনেক কবিতা তিনি নিজে পাঠ করতেন এবং এগুলোর ব্যাখ্যা করতেন। তাছাড়া আহলে তাসাওউফ বুযুর্গানে কেরামের অনেক কবিতা বিশেষত বুযুর্গানে তরিকতের উর্দু , ফার্সি কালাম তিনি পাঠ করে ব্যাখ্যা করতেন। তার লাইব্রেরিতে মাওলানা রুমী (র.)-এর মসনবী শরীফ, দিওয়ানে হাফিজ, দিওয়ানে আমির খছরু, আল্লামা ইকবালের ফার্সি কবিতা, গাউছে পাক হযরত মহি উদ্দিন জিলানী (র.)-এর ফার্সি ভাষায় রচিত দেওয়ানে গাউছিয়া ইত্যাদি ছিল। তিনি ফার্সি দেওয়ানে গাউছিয়ার বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। পুস্তকখানা বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। আমার নিকট এর একটি কপি সংরক্ষিত আছে। ফার্সস ভাষা ও সাহিত্যে এত দক্ষতা অর্জনের পরও তিনি ফার্সি সাহিত্য সর্ম্পকে আরো জ্ঞান লাভ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করতেন।
সেসময় একজন অতি বৃদ্ধ লোক সাইকেলে চড়ে মোরগ ও খাটি সরিষার তৈল বিক্রি করতেন। তিনি সাইকেলের পিছনে একটি বাক্সে কয়েকটি মোরগ ও সরিষার তৈলের ক্যারিয়ার নিয়ে আসতেন। জাস্টিস সাহেব নিজে গেইটে বের হয়ে ঐ বৃদ্ধ ব্যক্তির নিকট থেকে মোরগ খরিদ করতেন। ঘটনাক্রমে একদিন একটি মোরগ ছুটে গেল। ঐ ব্যক্তি মোরগ পাকড়াও করে নিয়ে আসলেন। মোরগটি বাক্সে রাখার সময় দু ছত্র ফার্সি কবিতা পাঠ করলেন। জাস্টিস সাহেব প্রশ্ন করলেন, আপনি ফার্সি কবিতা কিভাবে শিখলেন? উত্তরে ঐ ব্যক্তি বললেন, আমি পশ্চিমবঙ্গে এক মাদরাসায় দীর্ঘদিন ফার্সির শিক্ষক ছিলাম। খুব ভালো ফার্সি জানতাম। এদেশে আসার পর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারিনি। তাই মোরগ ও তৈল নিয়ে ঘুরছি। জাস্টিস সাহেব সে মোরগ ও তৈল বিক্রেতা বৃদ্ধকে বললেন, আপনি অমুক সময়ে আসবেন, আপনার সাথে আলাপ হবে। আট-দশ দিন পরপর এই বৃদ্ধ আসতেন। জাস্টিস ছাহেবকে নিয়ে বসে মসনবী, দিওয়ানে হাফিজ, দিওয়ানে গাওছিয়া, দিওয়ানে আমির খসরু ইত্যাদি সামনে রেখে এক-দুই ঘণ্টা আলোচনা করতেন।
তিনি ইলমে হাদীস সর্ম্পকেও অবগত ছিলেন। একদিন আমার উপস্থিতিতে একজন আলিম ছাহেব অনুমতি নিয়ে তার বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন। বৈঠকখানার রেকগুলিতে আইন-আদালতের বই রাখা। উপরের রেকে বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, তাফসীরের কিতাব ও সীরতের কিতাব সযত্নে রাখা। আলিম সাহেব অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন হাদীস শরীফ সর্ম্পকে আলোচনা করে নিজেকে একজন বিজ্ঞ আলিম প্রমাণ করার চেষ্টায় লিপ্ত হলেন। তিনি এক হাদীস পাঠ করে বললেন, এই হাদীস আবু দাউদের অমুক অধ্যায়ে আছে। উচ্চারণের সময় এ’রাব, যের, যবরের মধ্যেও ভুল করলেন। জাস্টিস সাহেব উপরের রেক থেকে আবু দাউদ বের করে আলিম সাহেব যে অধ্যায়ের কথা বলেছিলেন সে অধ্যায় বের করে বললেন, ‘কিতাব আপনার সামনে, হাদীস শরীফ বের করে দেখান।’ তিনি বেশ কিছু সময় অপচয় করে হাদীস আর বের করতে পারলেন না। লজ্জিত হয়ে চা পান করে চলে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন ইনি শুধু বিচারপতি নন; একজন বিজ্ঞ আলিমও বটে।
তিনি গাড়িতে বসে ওযীফা তিলাওয়াত করতেন। নারিন্দা থেকে কোর্টের গেইট পর্যন্ত তাঁর গাড়িতে বসে পথ অতিক্রম করার সৌভাগ্য আমার কয়েকবার হয়। তখন দেখেছি তিনি গাড়িতে বসে জরুরী দোয়া কালাম পাঠ করার পর হিযবুল আজম ওযীফাখানা বের করে তিলাওয়াত করতেন।
আল্লাহ তাআলা তার মকবুল বান্দাদের উপর রাজি হয়ে কোনো কোনো সময় গায়েবের পর্দা উন্মোচন করে তার কলবে এমন নূর দান করেন, যে নূরের আলোতে পর্দার আড়ালের বিষয় সম্পর্কে বান্দা অবগত হন। এ নিয়ামতকে সেই বান্দা গোপন রাখেন, আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করেন। সৈয়দ আবুল বশর মাহমুদ হোসেন (র.) সেসকল সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন। এ বিষয়ে একটি ঘটনা উল্ল্যেখ করছি। আমার ওয়ালিদ মুহতারাম ও মুরশিদ হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব (র.)-এর সফরসঙ্গী হয়ে আমি ট্রেনে সিলেট থেকে ঢাকায় আসছি। পথিমধ্যে আমার ওয়ালিদ ছাহেব বললেন, জাস্টিস ছাহেবের সাথে দুই-তিন দিন পর দেখা করব। আবার অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন, আমার লাইব্রেরিতে একখানা মূল্যবান কিতাব ছিল, কিতাবখানা হারিয়ে গেছে। যদি ঢাকার কোনো লাইব্রেরিতে পাওয়া যায় তবে সংগ্রহ কর। আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন্ কিতাব? তিনি ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতি (র.) রচিত شرح الصدور فى احوال الـموتى والقبور কিতাবখানার কথা বললেন। পরদিন বা এর পরদিন বাদ মাগরিব নারিন্দার বাড়িতে উভয়ের সাক্ষাৎ হলো। মুসাফাহা-মুয়ানাকার কিছুক্ষণ পর জাস্টিস ছাহেব উপরের কামরায় গিয়ে একখানা কিতাব নিয়ে এসে বললেন, এই কিতাবখানা আমি আপনাকে হাদিয়া দেয়ার জন্য লাহোর থেকে খরিদ করে নিয়ে এসেছি। জাস্টিস ছাহেব বললেন ‘আমি লাহোর জামে মসজিদ অথবা দাতাগঞ্জ বখশ (র.)-এর মাযার থেকে বের হলাম। মনের দিক থেকে তাগাদা অনুভব করলাম যে, আপনাকে হাদিয়া দেয়ার জন্য ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতি (র.)-রচিত شرح الصدور فى احوال الـموتى والقبور কিতাবখানা খরিদ করব। তিনি আমার ওয়ালিদ ছাহেবের হাতে কিতাবখানা তুলে দিলেন। বুঝতে পারলাম আমার ওয়ালিদ ছাহেব ট্রেনে যেসময় কিতাবখানার কথা বলেছিলেন, ঠিক সেই সময় জাস্টিস সাহেবের মনে কিতাবখানা খরিদ করার ইচ্ছা হয়েছিল।
দীর্ঘদিন আমি ঢাকার বাইরে ছিলাম। জাস্টিস সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে একবার ঢাকায় পৌঁছে অনুমতি নিয়ে বৈঠকখানায় প্রবেশ করলাম। দীর্ঘদিন পর আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর হাসলেন। তিনি এমন সুন্দর হাসি হাসতেন যে হাসি ছিল অকৃত্রিম। যখন হাসতেন তখন মনে হতো গোলাপ ফুল বিকশিত হয়ে যেন তার সুগন্ধি ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সংবাদ আসলো জাস্টিস আব্দুস সত্তার সাহেব, জাস্টিস আব্দুস সুবহান সাহেব ও আরো কয়েকজন এমন বিশেষ ব্যক্তি আসছেন, যারা জন্মভূমির বুকে অনুকুল-প্রতিকুল পরিবেশে ইনসাফ কায়েম করার জন্য খালিছভাবে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। অমি অন্য কামরায় চলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করলাম। জাস্টিস সাহেব আমাকে বললেন, এখানেই বসতে হবে। মেহমানগণ তাশরিফ আনলেন, সৌভাগ্যক্রমে আমার সাথে মুসাফাহা করলেন। আমি নিরবে বসে তাদের মূল্যবান কথা-বার্তা শ্রবণ করলাম। তাঁরা মৃত্যু, কবরের জীবন আর বিচার দিনের অবস্থা সম্পর্কে আলাপ করছিলেন। তাছাড়া নিজ নিজ জীবনের কিছু অশ্রুভেজা স্মৃতিও আলোচনার মধ্যে ছিল। বৈঠক শেষ হয়ে গেল। সকলে জাস্টিস সাহেবকে মুনাজাত করতে বললেন। যারা আমীন বললেন, তাদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। মুনাজাত শেষে বুকে হাত দিয়ে তাদের চেহারার দিকে আশাভরা নয়নে তাকিয়ে হৃদয়ের ভাষায় বললাম, ইয়া আল্লাহ! তোমার বান্দাদের দীর্ঘায়ূ দান কর, যাতে তারা নিরাশার আঁধারঘেরা প্রিয় জন্মভূমির বুকে ইনসাফ কায়েম করতে পারেন।
তিনি যখন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ছিলেন সেসময় একদিন অনুমতি নিয়ে তার কেবিনে প্রবেশ করলাম। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। মুবারক হাত দিয়ে আমি অধমের কম্পিত ডান হাতখানা ধরে বুকের বাম পাশে রেখে আমাকে তার বুকে দম করতে বললেন, আমি সূরা ‘ফাতাহ’-এর এক আয়াত তিলাওয়াত করে দুই-তিনবার ফুঁক দিলাম। তারপর আমার হাতখানা গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা করলেও তিনি কিছুক্ষণ আমার হাতখানা বুকে রাখলেন। একটি শ্লোক মনে পড়ল :
لقاء الـخليل شفاء الـعليل
-যাকে ভালবাসি তার সাক্ষাৎই রোগমুক্তির কারণ।
মনে মনে কামনা করলাম আল্লাহ তাআলা যেন আমাকে তিরমিযী শরীফের হাদীস মোতাবিক ফল দান করেন। হাদীসখানার অনুবাদ হলো: হযরত আলী রাদ্বিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে মুসলমান সকালে কোনো অসুস্থ মুসলমানকে দেখতে যায়, সত্তর হাজার ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করেন। আর যদি সন্ধ্যা বেলা দেখতে যায় তবে ভোর পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করেন। তার জন্য রয়েছে বেহেশতের একটি বাগান। (অথবা বেহেশতের চয়ন করা ফল)।
মনে মনে আল্লাহ তাআলার দরবারে ফরিয়াদ করলাম, ইয়া আল্লাহ! তোমার মাকবুল বান্দার নেক সাহচর্যে কিছুকাল অতিবাহিত করেছি। তিনি পথের দিশা দান করেছেন। নয়নভরে তার মায়ামাখা চেহারা দেখেছি। আজকের এই দৃষ্টি বিনিময় যেন জীবনের শেষ দৃষ্টি বিনিময় না হয়।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যে হাতখানা তার বুকে রেখেছিলাম সেই হাত দিয়ে নয়নের জল মুছে তার দীর্ঘ হায়াত কামনা করলাম ।
আজকে যে মাহফিলে উপস্থিত হয়েছি এমন মাহফিলে আমার মতো সীমিত জ্ঞানের অধিকারী, পথশ্রান্ত ব্যর্থ পথিকের মনের আবেগ ব্যক্ত করার সুযোগ হয় না। আমি আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করছি, আল্লাহ তাআলা আমাকে এমন মহান ব্যক্তিবর্গের সামনে উপস্থিত করেছেন যাদের প্রতি প্রিয় জন্মভূমির সর্বস্তরের জনগণ, বালক, যুবক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ আশাভরা নয়নে তাকিয়ে আছে। সকলের আশা, আমাদের মাথার ছায়াস্বরূপ আল্লাহ তাআলা যে ব্যক্তিগণকে রেখেছেন, তাদের দ্বারা এ দেশে ইনসাফ কায়িম হবে। জুলুম নির্যাতনের গভীর অন্ধকারে চাঁদের আলোর প্রতিফলন ঘটবে।
যারা আল্লাহর ওয়াস্তে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আনজাম দেন তাদের জন্য দিকদর্শক এক পবিত্র হাদীস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাণী প্রদান করেছেন-
اَمْرَنِىْ رَبِىّ بِتِسْعٍ اَلْاِخَلَاصُ فِى السِّرِّ وَالْعَلَانِيَةِ وَالْعَدْلُ فِىْ الرِّضَا وَالْغَضَبِ وَالْقَصَدُ فِى الْغِنٰى وَالْفَقَرِ وَاَنْ اَعْفُوَ عَمَّنْ ظَلَمَنِىْ وَاَصِلَ مَنْ قَطَعَنِىْ وَاُعْطِىَ مَنْ حَرَمَنِىْ وَاَنْ يَّكُوْنَ نُطْقِىْ ذِكْرًا وَّصَمْتِىْ فِكْرًا وَّنَظْرِىْ عِبْرَةً.
অর্থ: আমার রব আমাকে নয়টি বিষয়ে নির্দেশ দান করেছেন:
১. প্রকাশ্য ও গোপনে ইখলাসকে গুরুত্ব দান করা।
২. সন্তুষ্ট ও রাগান্বিত উভয় অবস্থায় ইনসাফ কায়েম করা।
৩. সম্পদশালী ও সম্বলহীন উভয় অবস্থায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা।
৪. যে আমার উপর যুলুম করে তাকে যেন ক্ষমা করি।
৫. যে সর্ম্পক ছিন্ন করে তার সাথে যেন সম্পর্ক স্থাপন করি।
৬. যে আমাকে বঞ্চিত করে তাকে যেন দান করি।
৭. যখন কথা বলি তখন আমার কথা যেন আল্লাহর যিকর হয়।
৮. নিরব অবস্থায় যেন আল্লাহর নিদর্শন সর্ম্পকে চিন্তা করি।
৯. আমার দৃষ্টি দিয়ে যেন শিক্ষাগ্রহণ করি।
আজকের সভায় উপস্থিত মহান ব্যক্তিবর্গ, আপনাদের কর্মস্থল শুধু রাজধানীর বুকে সীমিত নয়। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত আপনাদের কর্মস্থল। গ্রাম বাংলার নিভৃত পল্লীর অসহায় মানুষের ফরিয়াদ শুনবেন, মজলুম রোহিঙ্গাসহ সারা দুনিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানবতার কান্না শ্রবণ করবেন। আল্লাহ তাআলা যেন আপনাদের মকবুল জিন্দেগী দান করেন। আমীন।
[২ আগস্ট, ২০১৮ ইং তারিখে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ আবুল বশর মাহমুদ হোসেন স্মরণে আয়োজিত আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিলে পঠিত মূল প্রবন্ধ]