আ’মল

যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের বিস্ময়কর ফদ্বীলত ও আমাল

হযরত মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী ফুলতলী

আমাদের মাঝে এসেছে যিলহজ্জ মাস। কুরআন কারীমে আল্লাহ তা‘আলা এদিনগুলোর শপথ নিয়েছেন, বেশী বেশী যিকর করতে নির্দেশ করেছেন । এছাড়াও হাদীস শরীফে এই মাসের প্রথম দশ দিনের রাত জেগে ইবাদাত, রোযা রাখা, তাসবীহ-তাহলীলের অনেক ফদ্বীলত বর্ণিত হয়েছে। আমরা এই দশ দিন সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরছি।

কুরআন কারীমে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিনের ফদ্বীলতের ব্যাপারে ইঙ্গিত পাওয়া যায। যেমন-

…وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ

অনুবাদ : ….. এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে..।

তাফসীরে ইবন কাছীর এ হযরত ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে এখানে أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ ‘নির্দিষ্ট দিনসমূহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে যিলহজ্জের ‘দশ রাত’।

অনুরূপ আল কুরআন আল কারীমের সূরা ফাজরে আল্লাহ তা’আলা এই দশ রাত্রির কসম করেছন। আল্লাহ তাআলা যেসব বিষয়ের কসম করেছেন সেসকল বিষয় ইহকালীন অথবা পরকালীন জীবনে কোন না কোন গুরুত্ব বহন করে। আল্লাহ তাআলা সূর্যের শপথ করেছেন, চন্দ্রের শপথ করেছেন, তারকারাজির শপথ করেছেন,মক্কা মুকাররামার শপথ করেছেন, কুরআন শরীফের শপথ করেছেন,প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনের শপথ নিয়েছেন, তেনতেমনিভাবে এই দশ রাত্রিরও শপথ করেছেন-
والفجر * وليال عشر
ফজরের শপথ, আর দশ রাত্রির শপথ। (সূরা ফজর, আয়াত : ১-২)

এ আয়াতের ব্যাপারেও ইমাম তাবারী বলেন- ‘দশ রাতের শপথ’ এর দ্বারাও যিলহজ্জ- এর প্রথম দশ রাত উদ্দেশ্য। কেননা এ ব্যাপারে কুরআন বিশেষজ্ঞগণ ইজমা পোষণ করেছেন।

আর ইবন কাসীর তার তাফসীরে সূরা ফজরের এ আয়াতের ব্যাপারে বলেন- হযরত ইবন আব্বাস (রা.), ইবনু যুবায়র (রা.), মুজাহিদসহ পূর্বাপর প্রায় সবাই এমত পোষণ করেন যে এর দ্বারা যিলহজ্জের ১ম দশ রাত উদ্দেশ্য।

সূরা ফজরের পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা জোড় ও বেজোড়ের শপথ নিয়েছেন। হাদীসের ভাষ্য থেকে বুঝা যায় এ দু’টিও যিলহজ্জের প্রথম দশকের সাথে সম্পৃক্ত। যেমন-

হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত- তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সূত্রে বর্ণনা করেন-
নিশ্চয় (সূরা ফজরের আয়াতস্থিত) দশ রাত দ্বারা যিলহজ্জের ১০ রাত আর والشفع والوتر এর والوتر (বেজোড়) দ্বারা আরফার দিন (৯ তারিখ) এবং والشفع (জোড়) দ্বারা কুরবানীর দিন (১০ তারিখ) উদ্দেশ্য। (আহমদ ৩য় খন্ড : হাদীস নং-১৪৫৫১)

যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিনের ফদ্বীলতের ব্যাপারে বহু হাদীসেও উল্লেখ পাওয়া যায়-ল

এইদিনের আমল আল্লাহর আছে সবচেয় প্রিয়

হযরত ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হতে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমায়েছেন-
ما من أيامٍ العمل الصالح فيها أحبُّ إلى الله من هذه الأيامِ ( يعني أيامَ العشر ) . قالوا : يا رسول الله ، ولا الجهادُ في سبيل الله ؟ قال : ولا الجهادُ في سبيل الله إلا رجلٌ خرج بنفسه وماله فلم يرجعْ من ذلك بشيء. *
– এমন কোনো দিবস নেই যার আমল জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় হবে। প্রশ্ন করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদ করা থেকেও কি অধিক প্রিয়? রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বললেন, হাঁ জিহাদ করা থেকেও অধিক প্রিয় তবে যদি এমন হয় যে, ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে বের হল এবং এর কোনো কিছুই ফেরত নিয়ে এল না।(আবূ দাঊদ হাদীস নং : ২৪৩৮)

সর্বোত্তম দিন

হযরত জাবির (রা.) হতে বর্নিত আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- যিলহজ্জের ১০ দিন সর্বোত্তম দিন।

ইবন হিব্বান সূত্রে বর্ণিত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমায়েছেন-
ما من أيامٍ أفضل عند الله من أيامَ عشر ذي الحجة.
-যিলহজ্জের প্রথম ১০ দিনের মত উত্তম দিন আল্লাহর কাছে আর কোনটিই নয়। (ইবন হিব্বান, খ-৯, হাদীস নং-৩৮৫৩)

জিহাদ হতেও উত্তম

উপরুক্ত হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলেন- এগুলো উত্তম না যে দিনগুলো জিহাদে কাটানো হয় সেদিনগুলো উত্তম? তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমালেন এগুলো জিহাদে কাঠানো দিনের চেয়েও উত্তম।

এদিনগুলোর আমল পবিত্রতমও সওয়াবে সর্বোত্তম :

হযরত ইবন আব্বাস (রা.) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সূত্রে বর্ণনা করেন-
ما من عملٍ أزكى عند الله ولا أعظم أجراً من خيرٍ يعمله في عشر الأضحى… ( رواه الدارمي( .
-আল্লাহর কাছে উত্তম কাজসমূহের মধ্যে পবিত্রতম ও প্রতিদানের বিবেচনায় সবচেয়ে বড় আমল হচ্ছে যা আদ্বাহার দশদিনে সম্পাদন করা হয়। …… (দারেমী, খ–২, হাদীস নং-১৭৭৪)

দুনিয়ার মাঝে সর্বোত্তম দিন :

হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমায়েছেন “দুনিয়ার দিনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে ‘দশ দিন’ অর্থাৎ যিলহজ্জ মাসের দশদিন। বলা হলো আল্লাহর পথে (জিহাদে) ব্যায়িত দিনগুলোও এর মত নয়? তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- আল্লাহর পথের দিনগুলোও এর সমান নয়, তবে যে তারা যারা নিজের মুখম-ল ধূলো ধূসরিত করল (অর্থাৎ শহীদ হলো)। (হাইসামী, খ–৪, পৃষ্ঠা নং-১৭)

এত ফদ্বীলত হওয়ার পেছনে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোও রয়েছে-

যিলহজ্জের প্রথম দশদিনের মধ্যে রয়েছে-

১. তারবীয়ার দিন (يوم التروية) এটি হচ্ছে যিলহজে¦র ৮ম দিন। যেদিনে হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। মুহরিম অবস্থায় হাজীগন মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

২. এর মাঝে রয়েছে আরফার দিন। এটি অত্যন্ত ফদ্বীলতের দিন। হাদীসে এসেছে-

#আরফাই হচ্ছে হজ্জ। (الحج العرفة)

# আল্লাহ এ দিনে আরফার ময়দানে উপস্থিত ও অনুপস্থিত মুমিনদের মাফ করে দেন।

#এ দিনে আল্লাহ আরফার ময়দানে উপস্থিতদের নিয়ে ফিরিস্তাদের মাঝে গৌরব করেন। (মুসলিম শরীফে হযরত আয়শা (রা.) বর্ণিত হাদীসে দ্রষ্টব্য)

# এই দিনে রোযা রাখলে আগের ও পরের ২ বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

৩. এই দিনগুলোতেই মুজদালিফায় অবস্থান করা হয়।

৪. এর মাঝেই ইসলামের ৫ম স্তম্ভ হজ্জ সম্পাদিত হয়।

৫. এদিনগুলোর ১০ দিনে কুরবানীর সূচনা হয়। আর এটি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিনসমূহের একটি আবূ দাউদে বর্ণিত হয়েছ-

إن أعظم الأيام عند الله يوم النحر، ثم يوم القرّ. رواه أبو داوود.

যিলহজে¦র প্রথম দশকের এতো ফদ্বীলত বর্ণিত হয়েছে যে আলিমগণ রমযানের শেষ দশকের এবং এর মধ্যে সমন্বয় করতে গিয়ে বলেন-

عَشْرُ رَمَضَانَ أَفْضَلُ مِنْ حَيْثُ لَيَالِيهِ لِأَنَّ مِنْهَا لَيْلَةَ الْقَدْرِ، وَهِيَ أَفْضَلُ اللَّيَالِي، وَعَشْرُ ذِي الْحِجَّةِ أَفْضَلُ مِنْ حَيْثُ أَيَّامُهُ لِأَنَّ فِيهَا يَوْمَ عَرَفَةَ وَهُوَ أَفْضَلُ الْأَيَّامِ.

অর্থাৎ : রমযানের প্রথম দশক ‘রাতের’ বিবেচনায় সর্বোত্তম কেননা, এর মধ্যে রয়েছে লাইলাতুল কদর। আর এটা রাতসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম। অন্যদিকে যিলহজ্জের প্রথম দশক ‘দিনের’ বিবেচনায় উত্তম, কেননা এর মধ্যে রয়েছে আরফার দিন যা দিনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম। (মিরকাত)

এই দশ রাত্রির এতো মর্যাদার কারণ হিসাবে উলামায়ে কিরাম বলেন এই সময়ের মধ্যে সকল আমল করা যায়। নামায, রোযা, যাকাত, সদকাহ সব আমল অন্য সময়ে করা যায় কিন্তু কুরবানী, হজ্জ করা যায় না। আর এই দশ দিনের মধ্যে নামায, রোযা, যাকাতের সাথে সাথে কুরবানী ও হজ্জ সহ অন্যান্য সকল ইবাদত করা যায়। সে জন্যে এর মর্যাদা আলাদা। (দ্র. ইবন হাজার; ফাতহুল বারী)

এ রাতসমূহের আমল

এ রাতসমূহে আমরা নিম্নলিখিত আমল করতে পারি–

বেশি বেশি আল্লাহর যিকর করা ঃ এ সময়ে যিকর করার জন্য সরাসরি কুরআন শরীফের নির্দেশনা পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ

-তোমরা নির্দিষ্ঠ দিনসমূহে আল্লাহর নামের যিকর করো। জমহুর মুফাস্সিরীনের মতে এই আয়াত দ্বারা যিলহজ্জের প্রথম দশ দিনকে বুঝানো হয়েছে।

#এই দশ রাত্রিতে বেশি বেশি নফল আমল করার বর্ণনা হাদীস শরীফে পাওয়া যায়। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
ما من أيام أعظم عند الله ، ولا أحب إلى الله العمل فيهن من أيام العشر ، فأكثروا فيهن من التسبيح ، والتحميد ، والتهليل ، والتكبير.

-এই দশ দিনের মর্যাদার সমতুল্য এবং এই দশ দিনের আমল অপেক্ষা অধিক প্রিয় আমল আল্লাহর কাছে নেই। সুতরাং তোমরা এই দিন সমসূহে অধিক পরিমাণে তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল এবং তাকবীর পড়।

রোযা রাখা ঃ যিলহজ্জের প্রথম দিন থেকে নবম দিন পর্যন্ত আমরা রোযা রাখতে পারি। রাসূল (সা.) এই সময়ে রোযা রাখতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা (রা.) বলেন-
أربع لم يكن يدعهن رسول الله صلى الله عليه وسلم صيام يوم عاشوراء والعشر وثلاثة أيام من كل شهر والركعتين قبل الغداة.

-রাসূল (সা.) চারটি জিনিস কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, দশ রাত্রির রোযা, প্রত্যেক মাসে তিনটি রোযা আর সকালের দুই রাকাআত নামায (ফজরের সুন্নত)।

অন্য হাদীসে এসেছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَال: مَا مِنْ أَيَّامٍ أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ أَنْ يُتَعَبَّدَ لَهُ فِيهَا مِنْ عَشْرِ ذِي الْحِجَّةِ، يَعْدِل صِيَامَ كُل يَوْمٍ مِنْهَا بِصِيَامِ سَنَةٍ، وَقِيَامُ كُل لَيْلَةٍ مِنْهَا بِقِيَامِ لَيْلَةِ الْقَدْرِ
-হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ফরমায়েছেন : আল্লাহর নিকট দিনসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের ইবাদত। এর প্রত্যেক দিনের রোযা এক বছরের রোযার সমান। আর এর প্রত্যেক রাতের ইবাদত শবই কদরের ইবাদতের সমান। (সূত্র : তফসীর কুরতুবী : ২০/৩৯, আল মগনি ৩/১৭৫, তিরমিযী ৩/১২২)

রাত জেগে ইবাদত করাঃ যিলহজ্জের দশ রাত্রিসমূহে রাত জেগে ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম। হানাফী ও হাম্বলী মাযহাব অনুযায়ী এ দশকের রাতসমূহে জাগ্রত থেকে ইবাদত করা মুস্তাহাব।
প্রখ্যাত তাবিঈ হযরত সাঈদ ইবন জুবায়র (রা.) বলেন-
لاَ تُطْفِئُوا سُرُجَكُم لَيَالِيَ العَشْرِ
-তোমরা দশ রাত্রিতে তোমাদের ঘরের বাতি সমূহ নিভিয়ে ফেলো না।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই দশককে যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *