
[আলোচ্য বিষয়টি খুব সংবেদনশীল এবং বিতর্কিত। তাই পুরো লেখা না পড়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার সবিনয় অনুরোধ রইল]
প্রতিবছর প্রায় ২০-২২ লাখ মানুষ হজ পালন করতে যান। দিন দিন সে সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতো বিপুলসংখ্যক মানুষের স্থানসংকুলানের জন্য প্রয়োজন বৃহৎ অবকাঠামো। সেদিকে লক্ষ্য রেখে সৌদিআরব সরকার গত দেড়-দুই দশক ধরে হারাম শরীফের অবকাঠামো সম্প্রসারণ করে যাচ্ছেন। মসজিদের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত হয়েছে আরাফাহ, মিনা, মুযদালিফার যাবতীয় সুযোগ সুবিধা। হাজীদের সেবার জন্য সৌদি সরকারের এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। তবে এ উন্নয়নের সবটুকু সুখকর নয়।
এই ছোট জীবনে ৩ বার পবিত্র মক্কা-মদীনার মেহমান হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ২০০০ সালে প্রথমবার গিয়ে যে মক্কা-মদীনা দেখেছিলাম, ৫ বছর পর দ্বিতীয়বার গিয়ে দেখি তা অনেকটাই বদলে গেছে। এর ১১ বছর পর যখন যাই, তখন আমার স্মৃতিপটে সংরক্ষিত মক্কা-মদীনার চিহ্নমাত্র নেই। আকাশচুম্বী অট্টালিকা আর আমেরিকান ম্যাকডোনাল্ডের ভিড়ে ইসলামের ঐতিহ্যকে ধারণ করা মক্কা-মদীনার অলিগলি, পাহাড়-পর্বত তখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের (التوسعة والتطوير) দোহাই দিয়ে অবলীলায় বোলডোজার চালিয়ে দেয়া হয়েছে ইসলামের অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থান ও কাঠামোর ওপর। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অনেক মাহাত্ম্যপূর্ণ নিদর্শন। এসব ভাঙ্গণ ও নিবৃত্তিকরণ কেবল সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য নয়। সাথে রয়েছে আরেকটি ‘বড় কারণ’। সেটি হচ্ছে- তথাকথিত শিরকের আশঙ্কা!
শিরক (আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্য স্থাপন করা) একটি জঘন্য অপরাধ এবং আল্লাহর প্রতি অবিচারের নামান্তর। শিরকের দিকে পা বাড়ানো থেকেও ইসলাম আমাদেরকে বিরত রেখেছে। কিন্তু সৌদি আরবের ধর্মীয় পরিষদ শিরককে অন্য লেভেলে নিয়ে গেছেন! যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ঘাম ও চুল মোবারক সংগ্রহে রাখার জন্য সাহাবায়ে কেরাম উদ্যমী ছিলেন, সেখানে সৌদি ধর্মীয় পরিষদ রাসূলুল্লাহ (সা.), আহলে বায়েত ও সাহাবিদের সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত ঐতিহ্যে শিরকের গন্ধ খোঁজে পান। কল্পিত এ শিরক-ভীতি মূলত রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো, যে সৌদি কর্তৃপক্ষ মানুষকে সম্মান করার মাঝেও শিরকের গন্ধ খোঁজেন, তাঁদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা “সালমান সালমান” জয়ধ্বনি করে!
সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও শিরক-মুক্তির যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের তালিকা অনেক লম্বা। তন্মধ্যে-
১. হাজীদের জন্য যমযম কুপ প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ২০০০ সালে হজে গিয়ে যমযম কুপ দেখেছিলাম, আজ আর সে সুযোগ নেই।
২. সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয় গ্লাস গিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ছোটবেলায় একবার সাফা পাহাড় বেয়ে ওঠেছিলাম, যার স্মৃতি আজও অমলিন। আজ আপনি হাতও ছোঁয়াতে পারবেন না।
৩. আব্বাসি এবং উসমানী (অটোমান) আমলের প্রায় সব অবশিষ্টাংশ ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। অটোমান আমলে সম্প্রসারিত মাসজিদুল হারামের আভ্যন্তরীণ অংশের কয়েকটি পিলার ছিল কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক। আজ খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে।
৪. খাদিজা (রা.)-এর ঘরসহ বনু হাশিমের বাসস্থান, সাহাবিদের ঘরবাড়ি ও প্রাচীন মসজিদসমূহ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। আবওয়া এলাকায় অবস্থিত সায়্যিদা আমিনার কবর এমনভাবে মিটিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আজ আপনি চিহ্নিত করতেই পারবেন না। আবু বকর (রা.)-এর বাড়িটি হয়ে গেছে Hotel Hilton.
৫. ঐতিহ্যবাহী ‘জাবালে আবু কুবাইস’ পাহাড়টি দেবে যাচ্ছে। মক্কায় অবস্থানকারী একজনের কাছে শুনেছি, পাহাড়ে এক ধরণের কেমিক্যাল দেয়া হয়, যাতে পাথর ধীরে ধীরে লিকুইড হয়ে খসে পড়ে।
৬. পবিত্র কুরআন নাযিলের স্থান হেরা গুহায় হাজীদের পদচারণা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
৭. যে ঘরে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম হয়েছিল, আজ সে ঘরটি অবশিষ্ট নেই। ভেঙ্গে একটি অপ্রয়োজনীয় লাইব্রেরি করা হয়েছে, যেখানে গিয়ে দু’মিনিট দাঁড়াতেও দেয়া হয়না।
কেবল মক্কা শরীফের তালিকা দিলাম, তাও অসম্পূর্ণ। মদীনা তাইয়্যিবা তো রয়েই গেছে।
যমযম কুপ ও সাফা-মারওয়া পাহাড়ে অবারিত চলাচল হয়তো কুপ ও পাহাড়ের অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এরকম চিন্তা করলে বন্ধ করার কিছুটা যৌক্তিকতা পাওয়া যায়।
হেরা গুহায় হাজীদের যাওয়া বন্ধ করার পেছনে কারণ বলা হয়েছে- দুর্ঘটনা এবং শিরকে লিপ্ত হওয়া। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো। হাজীরা অনেকদিন ধরে সিড়ি নির্মাণের আবেদন করে আসছিলেন। সরকারি আলিম নিযুক্ত করে ‘তথাকথিত শিরক’ বন্ধ করা যেতো। কিন্তু তা না করে হুট করে নিষেধাজ্ঞা দেয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয়। মাথাব্যথার জন্য ঔষধ না খেয়ে মাথাটাই কেটে ফেলা কি বুদ্ধিমানের কাজ?
আহলে বায়েত ও সাহাবিদের ঘর, অগনিত সংখ্যক প্রাচীন মসজিদ, ঐতিহ্যবাহী পাহাড় ধ্বংস না করেও সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন সম্ভব ছিল। উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ‘বিন লাদেন গ্রুপ’ তাদের কাজের জন্য ইউরোপ-আমেরিকা থেকে প্রকৌশলী ভাড়া করে। যদি তাদেরকে বলা হতো, ঐতিহ্য (অন্তত কিছুটা হলেও) বহাল রেখে সম্প্রসারণ পরিকল্পনা করতে হবে, তাহলে তারা অন্য কোনো উপায় বের করতে সচেষ্ট হতো। এরচেয়ে অনেক মুশকিল কাজ প্রকৌশলীরা অবলীলায় করে ফেলেন।
ইসলামি ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে গবেষণা করছেন লন্ডন-ভিত্তিক Islamic Heritage Research Foundation এর নির্বাহী পরিচালক ও খ্যাতিমান প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. ইরফান আল-আলাওয়ী, যিনি সায়্যিদ মুহাম্মদ ইবনে আলাওয়ী আল-মালিকি (রাহ.)-এর প্রাক্তন ছাত্র। BBC ও Independent-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. ইরফান স্পষ্টভাষায় বলেছেন- There are ways you could expand Mecca and Medina while protecting the historical heritage of the mosque itself and the surrounding sites. তাছাড়া হারাম শরীফের পাশে বাদশার বিলাশবহুল বাড়ি ও সুউচ্চ ক্লক টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে, যা মসজিদের অংশ নয়। সেগুলো তো সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি? সব দোষ কেবল আহলে বায়েতের বাড়িঘর ও জাবালে আবু কুবাইসের?
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্মস্থানকে ভেঙ্গে লাইব্রেরি করার গবেট ও ঘৃণ্য সিদ্ধান্তটি কার মাথা থেকে এসেছে জানিনা। একজন মুসলমান বুকভরা শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিয়ে প্রিয়নবীর জন্মস্থানের সামনে দাঁড়ালে শিরক হয়ে যায়? হিংসাবশত আজ এ স্থানটিকে এক প্রকার ‘নিষিদ্ধ স্থান’ করে রাখা হয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি কেউ এ ঘরটিকে ‘মাওলুদুন নবী’ হিসেবে স্বীকার নাও করেন, তবুও তো এটিকে এরকম নিষিদ্ধ করে রাখার কোনো অর্থ নেই।
মিনায় অবস্থিত জামারাতে কংকর নিক্ষেপ করার সুবিধার্থে জামারাতকে ৫ তলা পর্যন্ত উঁচু করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। যদি মিনায় এরকম যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়া যায়, তাহলে মক্কা-মদীনায় কেন নেয়া যায়না? পৃথিবীর প্রতিটি জাতি নিজেদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের বেলায় যত্নবান। এমনকি সৌদিরাও। নিজেদের হামবড়া নাম সংরক্ষণ করার বেলায় তাদের জুড়ি নেই। নোটের ওপর বাদশার লাস্যময় ছবি, মাসজিদুল হারামে বাদশাদের নামে বড় বড় তোরণ, দেশজুড়ে রাজণ্যদের পোস্টার (ইদানিং প্রতিকৃতিও তৈরি হচ্ছে), আধুনিকতার নামের সিনেমাহল-কনসার্ট বানানোর তাগদা, অসহায় ইয়েমেনিদের ওপর পৈশাচিক হামলা, মুসলিম উম্মাহ’র সংবেদনশীলতাকে পাশ কাটিয়ে ইসরায়েলের সাথে মাখামাখি- কোনো কিছুতেই প্রশ্ন ওঠেনা। কেবল ইসলামি ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের বেলায়ই প্রশ্ন ওঠে! অহেতুক শপিংমলগুলো সম্প্রসারণে বাধা হয়না। কেবল মাওলুদুন নবীর ছোট্ট ঘরটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়! অবস্থাদৃষ্টে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক Institute for Gulf Affairs এর গবেষক ড. আলী আল-আহমেদ বলেছেন- It’s as if they wanted to wipe out history.
মদীনা তাইয়্যিবার অবস্থা মক্কা শরীফের চেয়ে কোনো অংশে নিরাপদ নয়। সাবেক বাদশা আব্দুল্লাহ’র আমলে মদীনায় অনেক ভয়ংকর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। জনরোষের ভয়ে কয়েকটি উদ্যোগ বিফল হলেও আশঙ্কা শেষ হয়ে যায়নি। গত ২০ বছরে মদীনার অন্তত ৩০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে, যার অধিকাংশ ছিল সাহাবা ও আহলে বায়েতের ঘর এবং স্মৃতিবিজড়িত মসজিদ। ড. ইরফান আল-আলাওয়ী বলেছেন- Their excuse is they want to make more room and create 20 spaces in a mosque that will eventually hold 1.6 million. It makes no sense. What they really want is to move the focus away from where the Prophet is buried. অর্থাৎ, মূল উদ্দেশ্য হলো, রাওদ্বা শরীফ থেকে মানুষের আবেগ ও আগ্রহ কমিয়ে দেয়া। আর এটি প্রথমবার নয়। মাসজিদুন নববী সম্প্রসারণের নামে উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালীদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীদের সবগুলো ঘর ভেঙ্গে দিয়েছিলেন, যেখানে আহলে বায়েতের একটি অংশ বসবাস করতেন। তৎকালীন আলিমরা তাঁকে অনেক নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা!
Islamic Heritage Research Foundation এর তথ্যমতে- ১৯৮৫ সাল থেকে আজ অব্দি মক্কা-মদীনার ৯৮% ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়ে গেছে। এমন নয় যে, এসব নিয়ে কেউ কথা বলছেনা। অনেকেই বলেছেন, লেখালেখি হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় রিপোর্ট হয়েছে, অনলাইন পিটিশন ও ভোটগ্রহণ হয়েছে। ‘অল-ইন্ডিয়া উলামা মাশায়েখ বোর্ড’ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন, সৌদি সরকারের কাছে পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষ কর্ণকুহরে হরতাল ডেকে বসে আছেন! অবিবেচনাপ্রসূত উন্নয়ন ও তথাকথিত শিরকের হাতুড়ি ইসলামের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ধ্বংস করেই চলছে।
আমরা জানি, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন যুগের অনিবার্য চাহিদা এবং এজন্য কিছু কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে- তাও স্বীকার করছি। কিন্তু উন্নয়নের দোহাই দিয়ে যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিদের স্মৃতিবিজড়িত সব বরকতময় ঐতিহ্যকে ধসিয়ে দেয়া হয়, তাহলে বলতেই হবে, প্রাপ্তি থেকে হারানোর অনুপাত অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে।
তথ্য-লিংক-
https://www.google.com.eg/amp/s/www.independent.co.uk/news/world/middle-east/the-photos-saudi-arabia-doesnt-want-seen-and-proof-islams-most-holy-relics-are-being-demolished-in-8536968.html%3famp
https://www.google.com.eg/amp/s/middleeastpress.com/arabic/السعودية-تهدم-آثار-الأسلام-بحجة-التوس/amp/
https://www.google.com.eg/amp/s/www.independent.co.uk/news/world/middle-east/medina-saudis-take-a-bulldozer-to-islams-history-8228795.html%3famp
https://www.google.com.eg/amp/amp.timeinc.net/time/3584585/saudi-arabia-bulldozes-over-its-heritage
http://www.bbc.com/arabic/interactivity/2013/05/130508_mecca_estruction_antiquities
https://defence.pk/pdf/threads/saudi-arabia-bulldozes-over-its-heritage.503617/
https://www.islamicity.org/2672/demolition-of-islams-historical-sites/