আ’মল

নবী করীম (সা.)-এর রওদা শরীফ যিয়ারতের হুকুম ও আদব

মূল: হযরত শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) | অনুবাদ: মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান

[প্রতি বছর হজ্জের সময় ছাড়াও সারা বছরব্যাপী দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানগণ প্রিয়নবী (সা.) এর রওদা শরীফ যিয়ারতে যান। মদীনার পথের মুসাফির আশিকে রাসূলগণ এ লেখা থেকে কিঞ্চিৎ উপকৃত হলে অনুবাদকে সার্থক মনে করবো।-অনুবাদক]

প্রিয়নবী সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত আবুল কাসিম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিম আল কুরাশী আল হাশিমী আল মক্কী আল মাদানী (সা.)-এর যিয়ারত করা মুস্তাহাব আমলসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাধিক নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। সামর্থবানদের জন্য যিয়ারত করা ওয়াজিবের নিকটবর্তী। কেননা নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে সামর্থ থাকা সত্ত্বেও আমার যিয়ারত করল না সে আমাকে কষ্ট দিল। অন্য বর্ণনায় আছে, আমার উম্মতের যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও আমার যিয়ারত করেনি তার কোন ওযর আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। নবী করীম (সা.) থেকে আরো বর্ণিত, যে ব্যক্তি আমার যিয়ারতের জন্য আসে এবং এ ক্ষেত্রে যিয়ারতই তার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, কিয়ামতের দিন তার জন্য শাফাআত করা আমার উপর ওয়াজিব হয়ে যায়। হাফিয আবূ আলী ইবনুস সাকান এটি বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, যে আমার কবর যিয়ারত করে তার জন্য আমার শাফাআত ওয়াজিব হয়ে যায়। হাফিয ইবনে আবদুল বার এ হাদীসকে সহীহ বলেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো ইরশাদ করেছেন, যে ইন্তেকালের পর আমার যিয়ারত করল সে যেন আমার জীবদ্দশায়ই আমার সাথে সাক্ষাত করল। এ বিষয়ে অনেক হাদীস রয়েছে। আমরা এখানে যা উল্লেখ করেছি (যিয়ারতের গুরুত্ব প্রমাণে) তাই যথেষ্ট।

যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফরের আদব
যিয়ারতকারী যখন যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হবে এবং মদীনা তায়্যিবার দিকে রওয়ানা হবে তখন পথিমধ্যে নবী করীম (সা.)-এর উপর বেশি বেশি করে দরুদ শরীফ পড়বে। কেননা এ পথের পথিকের জন্য ফরয ইবাদতের পর দরুদ শরীফ পড়াই সর্বোত্তম। যখন মদীনা ও হারামে মদীনার গাছপালা চোখে পড়বে তখন দরুদ ও সালাম আরো বাড়িয়ে দিবে আর আল্লাহর নিকট দুআ করবে যেন যিয়ারতের মাধ্যমে তিনি উপকৃত করেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্য দান করেন। এসময় দুআ করবে:
اللهم هذا حرم رسولك ، فاجعله لي وقاية من النار ، وأماناً من العذاب وسوء الحساب.
-হে আল্লাহ! এটি তোমার রাসূলের হরম তথা পবিত্রভূমি। একে আমার দোযখ থেকে মুক্তি এবং শাস্তি ও মন্দ হিসাব থেকে নিরাপত্তার ওসীলা বানিয়ে দাও।

মদীনা তায়্যিবা ও মসজিদে নববীতে প্রবেশের আদব
মুস্তাহাব হলো-পবিত্র মদীনায় প্রবেশের পূর্বে গোসল করবে, সবেচেয়ে ভালো ও পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করবে, সুগন্ধি লাগাবে ও সাধ্যমতো সদকা করবে। অত:পর মদীনা তায়্যিবায় প্রবেশ করবে। এ সময় পড়বে:
بسم الله وعلى ملة رسول الله ، رَّبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَل لِّي مِن لَّدُنكَ سُلْطَاناً نَّصِيراً.
-আল্লাহর নামে এবং তদীয় রাসূলের মিল্লাতের অনুসারী হিসেবে আমি প্রবেশ করছি। হে আল্লাহ আমাকে কল্যাণের সঙ্গে প্রবেশ করান এবং কল্যাণের সঙ্গে বের করুন আর আমাকে আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী শক্তি দান করুন।

মসজিদে নববীর দরজায় পৌঁছে ডান পা আগে দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করবে। এ সময় পড়বে:
اللهم اغفر لي ذنوبي وافتح لي أبواب رحمتك
-হে আল্লাহ আমার গুনাহসমূহ মাফ করে দাও এবং আমার জন্য তোমার রহমত ও অনুগ্রহের দরজা খুলে দাও।
এরপর পবিত্র রাওদাতুম মিন রিয়াদিল জান্নাহতে যাবে। এটি রাসূল্লাহ (সা.)-এর মিম্বর ও কবর শরীফের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। সেখানে সম্ভব হলে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামাযের জায়গায় আর সম্ভব না হলে রিয়াদুল জান্নাহ’র যে কোনো স্থানে অথবা মসজিদে নববীতে তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায (দু’রাকাআত) আদায় করবে। এরপর এ পবিত্র ভূমিতে পৌঁছার শুকরিয়াস্বরূপ ‘সিজদায়ে শোকর’ আদায় করবে এবং যিয়ারত কবূলের মাধ্যমে পরিপূর্ণ নিয়ামত দানের জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করবে। অবশ্য, নামায ও সিজদায়ে তিলাওয়াতের বাইরে অন্য কোনো সিজদা আদায়ের বিষয়ে উলামায়ে কিরামের মধ্যে ইখতেলাফ রয়েছে।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কবর শরীফের নিকট আসবে।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কবর শরীফ যিয়ারতের আদব
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কবর শরীফে এসে মাথা মুবারকের নিকট চেহারার দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। এ সময় কিবলাহ পেছন দিকে থাকবে। কবর শরীফের দেয়ালে হাত দিবে না এবং তাতে চুম্বন করবে না। কেননা তা করা কিংবা এরূপ কিছু করা মুর্খদের কাজ। এটি সলফে সালিহীনের আমলের অন্তর্ভূক্ত নয়। বরং তিন বা চার হাত দূরে দাঁড়াবে। অত:পর নবী করীম (সা.), হযরত আবূ বকর (রা.) ও হযরত ওমর (রা.)-এর উপর সালাত ও সালাম পেশ করবে।
নবী করীম (সা.)-এর কবর শরীফের নিকট দাঁড়িয়ে বিনম্র হৃদয়ে, নিচু স্বরে ও বিনীত ভঙ্গিতে বলবে:
السلام عليك يا سيد المرسلين ، السلام عليك يا خاتم النبيين ، السلام عليك يا قائد الغر المحجلين ، السلام عليك يا من ارسله رحمة للعالمين ، السلام عليك أيها النبي ورحمة الله وبركاته ،
أشهد أن لا إله إلا الله ، وأشهد أنك عبده ورسوله وامينه وخيرته من خلقه، و أشهد أنك بلغت الرسالة وأديت الأمانة ونصحت الأمة وجاهدت في سبيل الله حق جهاده وعبدت ربك حتي اتاك اليقين ، فجزاك الله عنا يا رسول الله أفضل ما جزي نبيا عن أمته ،
-আপনার প্রতি সালাম হে রাসূলগণের সরদার, আপনার প্রতি সালাম হে নবীগণের পরিসমাপ্তিকারী। আপনার প্রতি সালাম হে উজ্জল হস্ত-পদের অধিকারীগণের অগ্রপুরুষ, আপনার প্রতি সালাম হে মহান, যাকে আল্লাহ জগদ্বাসীর জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছেন। হে নবী, আপনার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি, রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল, তাঁর পক্ষ থেকে আমানতের অধিকারী এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি রিসালতের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, আপনার উপর অর্পিত আমানত (দায়িত্ব) আদায় করেছেন, উম্মতকে কল্যাণের পথে আহবান করেছেন, আল্লাহর পথে যথাযথভাবে জিহাদ করেছেন এবং ইন্তেকাল পর্যন্ত আপনার রবের ইবাদত করেছেন। সুতরাং ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আপনাকে আমাদের পক্ষ থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন যেরূপ উত্তম বিনিময় কোনো নবীকে তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকে প্রদান করেছেন।

এরপর দরুদ শরীফ পড়বে:
اللهم صل علي سيدنا محمد وعلى آل سيدنا محمد كما صليت على إبراهيم وعلي آل إبراهيم أنك حميد مجيد وبارك على سيدنا محمد وعلى آل سيدنا محمد كما باركت على إبراهيم وعلي آل إبراهيم إنك حميد مجيد ،
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সায়্যিদিনা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি সায়্যিদিনা মুহাম্মাদিন কামা সাল্লায়তা আলা ইবরাহীমা ওয়া আলা আলি ইবরাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা সায়্যিদিনা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি সায়্যিদিনা মুহাম্মাদিন কামা বা-রাকতা আলা ইবরাহীমা ওয়া আলা আলি ইবরাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ।
এরপর বলবে:
اللهم انك قلت وقولك الحق وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللهَ تَوَّابًا رَحِيمًا اللهم قد سمعنا قولك واطعنا امرك وقصدنا نبيك مستشفعين به اليك من ذنوبنا الهم فتب علينا واسعدنا بزيارته وادخلنا في شفاعته وقد جئناك يا رسول الله ظالمين انفسنا مستغفرين لذنوبنا وقد سماك الله تعالي بالرئوف الرحيم فاشفع لمن جائك ظالما لنفسه معترفا بذنبه تائبا الي ربه.
-হে আল্লাহ আপনি বলেছেন: وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللهَ تَوَّابًا رَحِيمًا [(ইয়া রাসূলাল্লাহ!) যদি তারা নিজেদের উপর যুলুম করত আপনার কাছে আসে অত:পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় আর রাসূল (আপনি) তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাহলে তারা আল্লাহকে তাওবা কবূলকারী ও দয়াময় হিসেবে পাবে) আর আপনার কথা তো সত্যই। হে আল্লাহ! আমরা আপনার কথা শুনেছি, আপনার আদেশ মান্য করেছি আর আমাদের গুনাহ মাফের বিষয়ে আপনার দরবারে সুপারিশের প্রত্যাশায় আপনার নবীর নিকট এসেছি, সুতরাং হে আল্লাহ! আমাদের তাওবা কবূল করুন, আপনার নবীর যিয়ারতের ওসীলায় আমাদের সৌভাগ্য দান করুন এবং আমাদেরকে তাঁর শাফাআতের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করুন। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা নিজেদের উপর যুলমকরত আমাদের গুনাহসমূহের ক্ষমা প্রার্থনাকারী হিসেবে আপনার দরবারে এসেছি আর আল্লাহ তো আপনাকে অনুগ্রহপরায়ণ ও দয়ালু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, সুতরাং যে নিজের উপর যুলমকরত গুনাহ স্বীকার করে রবের নিকট তাওবাকারী হিসেবে আপনার নিকট এসেছে তার জন্য আপনি সুপারিশ করুন।

কেউ কেউ যিয়ারতকালে নিম্নোক্ত পংক্তিগুলো আবৃত্তি করেছেন এবং এগুলোকে যিয়ারতের অন্তর্ভুক্ত বলেও উল্লেখ করেছেন। পংক্তিগুলো হলো:
يا خير من دُفنت في القاع أعظمه فطاب من طيبهن القاع والأكم
نفسي الفداء لقبر أنت ساكنه فيه الغفاف وفيه الجود والكرم
أنت الشفيع الذي تُرجى شفاعته عند الصراط إذا ما زلّت القدم.
এরপর নিজের জন্য, নিজের পিতা-মাতার জন্য ও অন্য যাদের জন্য দুআ করতে চান তাদের জন্য দুআ করবেন। কেননা রাসূল (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে দুআ করলে তা কবূল হয়।

মদীনা তায়্যিবা’র উদ্দেশ্যে সফরের আদব, রাস্তায় করণীয়, মদীনায় প্রবেশ ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যিয়ারতের আদব এবং এ পুত:পবিত্র শহরে অবস্থানের আদবসমূহ বিস্তারিত ও পরিপূর্ণরূপে পবিত্র মদীনার ইতিহাস বিষয়কগ্রন্থ ‘জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবূব’ এর মধ্যে আমি তুলে ধরেছি। সুতরাং আগ্রহীগণ তা দেখে নিতে পারেন।

[বি.দ্র: “জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবূব” গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ মাওলানা মহি উদ্দীন খান কর্তৃক “হৃদয় তীর্থ মদীনার পথে” নামে প্রকাশিত হয়েছে।-অনুবাদক]

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *