মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সৃষ্টি করে কিছু আদেশ এবং কিছু নিষেধ দিয়ে এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। যে সব বিষয়ের আদেশ প্রদান করেছেন তার মধ্যে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা অন্যতম। আল্লাহ তাঁর বান্দাহদেরকে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছেন। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ইস্তেগফার করতেন। আল্লাহ তাআ‘লা তাঁর হাবীবকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন-
وَٱسْتَغْفِرْ لِذَنۢبِكَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ بِٱلْعَشِىِّ وَٱلْإِبْكَـٰرِ) سورة غافر(
-আপনি আপনার গুনাহের জন্যে ক্ষমা প্রর্থনা করুন এবং সকাল-সন্ধ্যায় আপনার পালনকর্তার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করুন। (সূরা গাফির: ৫৫)
আমরা সবাই জানি যে নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল প্রকার গুনাহ থেকে মুক্ত। এরপরও আল্লাহ তাআলা তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার কথা বলার কারণ হলো ইস্তেগফারের গুরুত্ব বুঝানো। একথা ভাবার কোন সুযোগ নাই যে কেবল গুনাহ করার কারণেই ইসতিগফার করা হয়। গুনাহ না করেও ইসতিগফার করা যায়। এক বুযুর্গকে একবার জিজ্ঞেস করা হল আপনি সময় কিভাবে অতিবাহিত করেন? তিনি বললেন আমি একবার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলার কারণে ৩০ বছর যাবৎ ইস্তেগফার করে আসছি । ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলা তো গুনাহ নয়, এরপরও তাঁর ইস্তিগফার করার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন- বাজারে আমার একটি দোকান ছিল। খবর পেলাম বাজারে আগুন লেগে গেছে এবং আমার দোকান পুড়ে যাচ্ছে। আমি বাজারের দিকে দৌড়াতে লাগলাম। পথে আরেকজন সংবাদ দিলেন আপনার চিন্তার কিছু নাই, আপনার দোকানটা পুড়েনি। একথা শুনে আমি ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলেছিলাম। বাজারে গিয়ে দেখলাম আমার দোকান পুড়েনি ঠিক তবে আরো অনেকের দোকান পুড়ে গেছে। তখন আমার মনে হল আমার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলাটা ঠিক হয়নি। কারণ আমার নিজের দোকান না পুড়লেও আমার অন্য ভাইয়ের তো পুড়েছে।
এ ঘটনা থেকে বুঝা যায় কেউ ইস্তেগফার করেন বড় কোন গুনাহ করার কারণে আবার কেউ খুবই ছোট কোন ভুলের জন্য অনুশোচনাবোধ থেকে। তদ্রুপ আম্বিয়ায়ে কিরামের ইসতিগফারও গুনাহের কারণে ছিল না। ইসতিগফার কেবল আমাদের নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই নয়, বরং পূর্বের সকল নবী রাসূল আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করেছেন। আমাদের পিতা হযরত আদম (আ:)-এর ইসতিগফারের কথা কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়েছে। তিনি ইসতিগফার করলেন-
رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ (الأعراف(
-হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছি আর যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করো, দয়া না করো তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবো। (সূরা আ‘রাফ: ২৩)
হযরত ইবরাহীম (আ:) তাঁর নিজের জন্য তাঁর পিতা-মাতা এবং সকল মুমিনদের জন্য ইসতিগফার করলেন-
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ )سورة ابراهيم(
-হে আমাদের প্রতিপালক! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সকল মুমিনকে ক্ষমা করুন, যেদিন হিসাব কায়েম হবে। (সূরা ইবরাহীম: ৪১)
হযরত নূহ (আঃ)-এর ইস্তেগফার করার কথা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُنْ مِنَ الْخَاسِرِينَ (سورة هود(
-আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবো। (সূরা হুদ:৪৭)
অন্য আয়াতে নূহ (আঃ) কর্তৃক নিজের, তাঁর পিতা-মাতার এবং সকল মুমিনের জন্য ইস্তেগফার পাঠের কথা বর্ণনা করা হয়েছে-
رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِمَنْ دَخَلَ بَيْتِيَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ
-হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যারা মুমিন হয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করে তাদেরকে এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে ক্ষমা করুন (সূরা নূহ: ২৮)
হযরত হুদ (আঃ) তাঁর কওমকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার উৎসাহ দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
وَاسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ إِنَّ رَبِّي رَحِيمٌ وَدُودٌ (هود(
আর তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁরই পানে ফিরে এসো, নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক খুবই মেহেরবান, অতিস্নেহময়। (সূরা হুদ: ৯০)
হযরত নূহ (আঃ)ও তাঁর কওমকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার কথা বলেছিলেন। এ সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّاراً (نوح(
-তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল। (সূরা নূহ: ১০)
সুতরাং বুঝা গেল আল্লাহর কাছে ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা নবীগণের বৈশিষ্ট্য।
হদীসের আলোকে ইস্তিগফারের গুরুত্ব:
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
طوبى لمن وجد في صحيفته استغفاراً كثيرا
-সেই মানুষের জন্য শুভ সংবাদ যে তার আমলনামায় বেশি বেশি ইসতিগফার পাবে।
হাদীসে এসেছে প্রিয়নবী দু’আ করতেন-
اللهم اجعلني من الذين إذا أحسنوا استبشروا، و إذا أساءوا استغفروا
আল্লাহ আমাকে তাদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করো যারা শুভকাজে খুশী হত এবং গর্হিত কাজের বেলায় ইস্তিগফার করে।
অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
من استغفر للمؤمنين و المؤمنات كتب له بكل مؤمن و مؤمنه حسنة .
যে ব্যক্তি মু’মিন নর-নারীর জন্য ইসতিগফার করে তার জন্য প্রত্যেক মুমিন নর-নারীর কল্যাণমুগ্ধ সওয়াব লেখা হয়।
আরো এসেছে-
من قال حين يأوي إلى فراشه , أستغفر الله الذي لا إله إلا هـو الحي القيوم , وأتوب إليه , ثلاث مرات, غفر الله له ذنوبه , وإن كانت مثل زبد البحر , وإن كانت عدد ورق الشجر ، وإن كانت عدد رمل عالج ، وإن كانت عدد أيام الدنيا .
-যে ব্যক্তি বিছানায় আসার পর (ঘুমানোর সময়) তিনবার বলবে أستغفر الله الذي لا إله إلا هـو الحي القيوم , وأتوب إليه তার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, তার গুনাহ যদি সমুদ্রের পরিমাণও হয়, অথবা সকল গাছের পাতা পরিমাণ হয়, অথবা বালু পরিমাণ হয়, অথবা যদি তার গুনাহ দুনিয়ার সকল দিন পরিমাণও হয়।
আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (রা.) বলেন-
العجب ممن يهلك ومعه النجاة، قيل: و ما هي ؟ قال: الاستغفار
-বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে কেউ তার সাথে মুক্তি সনদ থাকার পরও ধ্বংস হয়ে যাওয়া। জিজ্ঞাসা করা হলোÑ সেট কী? তিনি বললেন- ইস্তিগফার।
পূর্ববর্তী কোনো এক আলেম বলেন-
يَقُولُ الشَّيْطَانُ: أَهْلَكْتُ بَنِي آدَمَ بِالذُّنُوبِ، وَأَهْلَكُونِي بِالاِسْتِغْفَارِ.
শয়তান বলে থাকে- আমি বনী আদমকে গুনাহ দ্বারা ধ্বংস করি আর তারা আমাকে ইস্তিগফার দ্বারা ধ্বংস করে।
ইসতিগফারের উপকারিতা
মহান আল্লাহর কাছে ইসতিগফার করার মাধ্যমে কেবল গুনাহ মাফ হয় না বরং এর মাধ্যমে বান্দাহ আল্লাহর কাছ থেকে আরো অনেক নিআমত লাভ করে। আর সে জন্যে তাওবাহ এবং ইসতিগফারের গুরুত্ব অধিক। ইসতিগফারের উপকারিতা সমূহের মধ্যে হলোঃ
১.গুনাহ মাফ হয়:
আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে আমরা আমাদের কৃত গুনাহ থেকে মাফ পাই।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَمَنْ يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُورًا رَحِيمًا )النساء(
-যে খারাপ কাজ করে অথবা নিজের উপর যুলুম করে, অতঃপর আল্লাহর কছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে সে আল্লাহকে অবশ্যই ক্ষমাশীল ও দয়ালু হিসেবে পাবে। (সূরা নিসা: ১১০)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
قُلْ يَـٰعِبَادِىَ ٱلَّذِينَ أَسْرَفُوا۟ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا۟ مِن رَّحْمَةِ ٱللَّهِ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغْفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلْغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ )الزمر(
-বলুন, হে আমার বান্দাহগণ! যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছো তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা যুমার: ৫৩)
এখানে একটা বিষয় লক্ষনীয় যে মহান আল্লাহ গুনাহগার বান্দাহদেরকে ‘গুনাহগার’ বলে সম্বোধন করেন নি। বলেছেন ‘হে আমার বান্দাহ’। সন্তান যখন কোন ভুল করে তখন বাবা-মাও অনেক সময় বলেন যে ‘তুই আমার সন্তান না’। কিন্তু পাপাচারী বান্দাহদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ‘আমার বান্দা’ বলে আহ্বান করছেন। এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার রহমত থেকে নিরাশ হতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কবীরাহ গুনাহ সমূহের একটি। বান্দাহর গুনাহর পরিমাণ যত বেশিই হোক তার উচিৎ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া।
মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ سَلَّمَ – ” وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللَّهُ بِكُمْ ، وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ ، فَيَسْتَغْفِرُونَ اللَّهَ فَيَغْفِرُ لَهُمْ ) . رَوَاهُ مُسْلِمٌ(
-হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- আল্লাহর শপথ, যদি তোমরা গুনাহ না করতে তবে আল্লাহ তোমাদের বদলে আরো একটি জাতি সৃষ্টি করতেন যারা গুনাহ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। (মুসলিম)
মানুষ সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষ ভুল করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
২. নিয়ামত লাভের মাধ্যম
একদিন ইমাম হাসান বসরী (র.) এর কাছে এক লোক এসে বলল আমি খুব অসুবিধায় আছি, আমার বাগানটা খরায় পুড়ে যাচ্ছে, তিনি বললেন: আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আরেক লোক এসে বলল আমি খুব অভাবী লোক আমার জন্য দু‘আ করুন। তিনি বললেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, অতঃপর আরো একজন এসে বলল আমার কোন সন্তান নেই, তিনি বললেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। হাসান বসরীর ছাত্ররা জিজ্ঞেস করলেন, তিনজন ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগ করলো। আপনি সবাইকে একই তাসবীহ শিখিয়ে দিলেন; সবাইকে ইস্তিগফার করতে বললেন? তিনি বললেন আমি নিজে থেকে কিছু বলিনি। মহান আল্লাহ-ই কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন
فَقُلْتُ ٱسْتَغْفِرُوا۟ رَبَّكُمْ إِنَّهُۥ كَانَ غَفَّارًا – يُرْسِلِ ٱلسَّمَآءَ عَلَيْكُم مِّدْرَارًا – وَيُمْدِدْكُم بِأَمْوَٰلٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّـٰتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَـٰرًا.
-তোমরা ক্ষমা প্রার্থনা করো তোমাদের রব ক্ষমাশীল। যদি তোমরা ইস্তিগফার করো তবে তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, সম্পত্তি এবং সন্তানাাদি দ্বারা তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন, তোমাদের জন্য জান্নাত এবং নহর সমূহ নির্ধারিত রাখবেন। (সূরা নূহ, ১০-১২)
৩. ইসতেগফারের মাধ্যমে শরহে সদর হয়
বান্দাহর মনের মধ্যে যে কালিমা তৈরি হয় ইস্তেগফারের মাধ্যমে তা দূর হয়। হাদীস শরীফে এসেছে-
قال صلى الله عليه وسلم: إنه ليغان على قلبي حتى أستغفر الله مائة مرة .) رواه أحمد(
আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন আমার অন্তুর কখনো মলিন হয়ে যায়। তখন আমি ১০০ বার ইস্তেগফার পাঠ করি। (আহমদ)
রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন মজলিস থেকে আসতেন তখন বেশি বেশি ইস্তিগফার পাঠ করতেন কেননা সব ধরণের মানুষের সাথে থাকার প্রভাবে অন্তরে একধরণের পর্দা তৈরি হয়।
শরহে সদর এর মূল অর্থ হলো বক্ষ উন্মুক্ত হওয়া অর্থাৎ সত্যকে ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করা, অন্যায়কে অন্যায় মনে করা, সত্যিকার ইল্ম অর্জন করা। তাই আমরা যারা ইলম অর্জনে ইচ্ছুক আমাদের শরহে সদর এর জন্য বেশি বেশি ইস্তিগফার পাঠ করা উচিৎ।
৪. সুন্দর আচরণ ও চরিত্র লাভ
হযরত হুযায়ফা (রাঃ) বলেন-
كان في لساني ذرب على أهلي -أي حدة- فذكرت ذلك للنبي صلى الله عليه وسلم فقال: “أين أنت من الاستغفار يا حذيفة)رواه أحمد وابن ماجه(
-আমার যবানের মাঝে কঠোরতা ছিল, আমি আমার পরিবারের-পরিজনের সাথে সদ্ব্যবহার করতে পারতাম না। আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ ব্যপারে বললে তিনি বললেন- হে হুযায়ফা! তুমি কি ইস্তিগফার পাঠ করো না? (আহমদ, ইবনে মাজাহ)
সুতরাং হাদীস থেকে আমরা শিক্ষা পেলাম যে, ইসতিগফারের মাধ্যমে আমাদের যবানের কাঠিন্যতা, ব্যবহারের রুঢ়তা দূর হয়।
৫. আযাব থেকে মুক্তি:
রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কাছে আল্লাহর দু’টো আমানত রয়েছে; প্রথমত: হলাম আমি নিজে এবং অন্যটি হলো ইস্তিগফার।
হাদীসে এসেছে-
أنزل الله أمانين لأمتي وما كان الله ليعذبهم وأنت فيهم وما كان الله معذبهم وهم يستغفرون (سورة الأنفال). فإذا مضيت تركت فيهم الاستغفار إلي يوم القيامة ) الترمذي(
-আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের জন্য দু’টি আমানত দিয়েছেন। (আল্লাহর বাণী)
وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُعَذِّبَهُمْ وَأَنتَ فِيهِمْ ۚ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের আযাব দিবনা যতক্ষণ আপনি তাদের মাঝে আছেন অথবা তারা ইস্তিগফার পাঠ করতে থাকবে। (সূরা আনফাল; ৩৩) আপনি তাদের কাছে থাকাবস্থায় আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিবেন না, আর তারা যতক্ষণ ইসতিগফার করবে ততক্ষণও আল্লাহ তাদের শাস্তি দিবেন না। সুতরাং যখন আমি চলে যাবো তখন আমি তাদের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত ইস্তেগফারকে রেখে যাবো। (তিরমিযী)
৬. আসমানসম গুনাহ মাফ:
হাদীস শরীফে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
قَالَ اللَّهُ: يَا ابْنَ آدَمَ: إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلاَ أُبَالِي. يَا ابْنَ آدَمَ: لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ وَلاَ أُبَالِي. يَا ابْنَ آدَمَ: إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِي لَا تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً.
-(হাদীসে কুদসী) আল্লাহ তাআলা বলেন- হে আদম সন্তান! তুমি যতদিন আমাকে ডাকতে থাকবে এবং আমার কাছে আশা করতে থাকবে তোমার পাপ যাই হোক না কেন ,আমি তা ক্ষমা করে দিব, এতে আমার কোন পরওয়া নেই। হে আদম সন্তান! তোমার পাপরাশি যদি আকাশের মেঘমালায়ও উপনীত হয়, এর পর তুমি যদি আমার কাছে ক্ষমা চাও, তবুও আমি সব ক্ষমা করে দিব, এতে আমার কোন পরওয়া নেই। হে আদম সন্তান! তুমি যদি যমীন পরিমান পাপরাশি নিয়েও আমার কাছে এসে উপস্থিত হও, আর আমার সঙ্গে যদি কিছুর শরীক না করে থাক, তবে আমি সি পরিমান ক্ষমা ও মাগফিরাত তোমাকে দান করব। আল্লাহ তাআলা ইসতিগফারের আমলকে খুবই ভালোবাসেন। (তিরমিযী)
আমরা কতবার ইসতিগফার করবো?
রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল প্রকার গুনাহ থেকে মুক্ত। তারপরও তিনি ইসতিগফার করতেন। হাদীস শরীফে এসেছে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন-
والله إني لأستغفر الله وأتوب إليه في اليوم أكثر من سبعين مرة) صحيح البخاري(
-আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন কমপক্ষে ৭০বারেরও অধিক তাওবাহ, ইস্তেগফার পাঠ করি। (বুখারী)
এক সাহাবী বলেন আমি এক বৈঠকে হাতে গননা করা শুরু করলাম যে আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতবার ইস্তিগফার পাঠ করেন? আমি দেখলাম তিনি ঐ বৈঠকে ১০০বারের অধিক ইস্তেগফার পাঠ করছেন। এজন্য আমাদের পীর ও মুর্শিদ হযরত আল্লামা ফুলতলী সাহেব কিবলাহ (রহ.) প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০বার ইস্তিগফার পাঠ করার নসীহত করতেন।
ইসতিগফারের বাক্য
আমরা প্রাথমিকভাবে তিনটি ইস্তিগফারের বাক্য বলতে পারি-
১. أَسْتَغْفِرُ اللهَ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ(আস্তাগফিরুল্লাহ, ইন্নাল্লাহা গাফূরুর রাহীম)
-আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। এ বাক্যটি কুরআন শরীফের একটি আয়াতের ভাবার্থে। (দ্র: সূরা মুযাম্মিল, আয়াত ২০)।
২. রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
مَنْ قَالَ أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظِيمَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيَّ الْقَيُّومَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ, غُفِرَ لَهُ وَإِنْ كَانَ قَدْ فَرَّ مِنَ الزَّحْفِ.
-যে أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْعَظِيمَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيَّ الْقَيُّومَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ এই ইস্তেগফার পাঠ করবে আল্লাহ তার সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন, এমনকি যদি কেউ যুদ্ধের ময়দান থেকেও পলায়ন করে (যা একটি কবিরা গুনাহ)।
৩. সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার
বুখারী শরীফে এসেছে- আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার হলো-
اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي, لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ خَلَقْتَنِي, وَأَنَا عَبْدُكَ, وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ, أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ, وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي؛ فَاغْفِرْ لِي؛ فَإِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أَنْتَ.
-হে আল্লাহ! তুমি আমার রব, তুমি ব্যতীত কোন মা’বূদ নেই, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আমি তোমার বান্দাহ। আমি সাধ্যানুযায়ী তোমার অঙ্গীকার ও ওয়াদার উপর রয়েছি। আমি আমার সকল কৃতকর্মের অনিষ্টতা হতে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তুমি আমার প্রতি যে নিয়ামত দান করেছ, তা স্বীকার করছি। আর আমার অপরাধ স্বীকার করছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি ছাড়া ক্ষমা করার ক্ষমতা আর কারো নেই। (বুখারী, হাদীস নং- ৬৩০৬)
আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে এই ইস্তিগফার সকালে পড়বে তার রাতের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে আর যে সন্ধ্যায় পড়বে তার দিনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।
৪. হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর (রা.) বলেন- নিশ্চয়ই আমরা গণনা করলাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আালাইহি ওয়া সাল্লাম এক বৈঠকে ১০০বার (নিচের বাক্যটি) বলেছেন-
رَبِّ اغْفِرْ لِي وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ. الترمذي
হে আল্লাহ আমাকে করুন এবং আমার তওবা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল অতি দয়ালু। (তিরমিযী)
ইসতিগফার কখন করবেন?
ইস্তেগফার করার কোন নির্দিষ্ঠ সময় নেই। আপনি যখন ইচ্ছা আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন। তবে বিশেষ কিছু সময় আছে যখন ইস্তিগফার করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং কবূল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেমন ঃ
১. ফরয নামাযের পর
ফরয নামাযের পর মহান আল্লাহর দরবারে ইস্তেগফার পাঠ করা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আালাইহি ওয়া সাল্লামের মুবারক অভ্যাস। হাদীস শরীফে এসেছে-
فَقَدْ كَانَ النَّبِيُّ إِذَا سَلَّمَ مِنَ الصَّূلاَةِ الْمَفْرُوضَةِ يَسْتَغْفِرُ اللهَ ثَلاَثاً
– নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফরয নামায শেষ করে সালাম ফিরাতেন তখন তিনবার ইসতিগফার করতেন।
২. তাহাজ্জুদের পর
আল্লাহ তাআলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে কুরআনে উল্লেখ করেছেন-
وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
‘….. আর তারা শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনা করে।’ (সূরা যারিয়াত: ১৮)
আর হাদীস শরীফে এসেছে আল্লাহ তাআলা শেষ রাতে প্রথম আসমানে এসে আহ্বান করতে থাকেন এবং বলেন-
من يدعوني فأستجيب له ومن يسألني فأعطيه ومن يستغفرني فأغفر له) . رواه مسلم(
Ñকে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দিব, কে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব, কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। (মুসলিম)
৩. আরাফার সময়: ওকুফে আরফার সময় ইস্তেগফার পাঠ করা আল্লাহ তাআ’লার নির্দেশ-
ثُمَّ أَفِيضُوا مِنْ حَيْثُ أَفَاضَ النَّاسُ وَاسْتَغْفِرُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ )البقرة(
-অতঃপর তওয়াফের জন্যে দ্রুতগতিতে সেখান (আরফার ময়দান) থেকে ফিরে আস, যেখান থেকে সবাই ফিরে। আর আল্লাহর কাছেই মাগফেরাত কামনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাকারী, করুনাময় (সূরা বাকারা: ১৯৯)
৪. মজলিসের পর
فَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ: مَنْ جَلَسَ فِي مَجْلِسٍ فَكَثُرَ فِيهِ لَغَطُهُ, فَقَالَ قَبْلَ أَنْ يَقُومَ مِنْ مَجْلِسِهِ ذَلِكَ: سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ, أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ, أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ, إِلَّا غُفِرَ لَهُ مَا كَانَ فِي مَجْلِسِهِ ذَلِكَগ্ধ
-হযরত আবূ হুরারয়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে কোন মজলিসে বসে এবং এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয় অতঃপর মজলিস থেকে উঠার পূর্বে বলে سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ, أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ, أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ তাহলে ঐ মজলিসে থাকাকালীন যত গোনাহ হয়েছে তা ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
ইসতিগফার করা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজায় গেলেও ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য আল্লাহ তাআলা ইস্তেগফার কে শর্ত করে দিয়েছেন।
وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمُ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمً. )النساء(
আল্লাহ বলেন- হে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি আপনার কোন বান্দা নিজের উপর জুলুম করে আপনার কাছে চলে আসে এবং ইস্তেগফার পাঠ করে আল্লাহর কাছে তবে সে আল্লাহকে তওবা কবুলকারী দয়ালু হিসেবে পাবে। (সূরা নিসা, আয়াত-৬৪)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ইস্তিগফার করার তাওফীক দান করুন।
অনুলিখন – মোহাম্মদ মারুফ হোসাইন