

জাহেদ স্যারকে তিনমাস ধরে বলছি, ‘চলুন, ফুলতলী ঘুরে আসি। হাতের কাছে আলোচিত-সমালোচিত এক মতাদর্শের বাস, না-দেখে, না জেনে এভাবে বিকলাঙ্গ বিশ্বাস নিয়ে চলতে থাকা ঠিক না।’
স্যারের অসুস্থ আম্মা, বোনের অসুস্থতাজনিত অপারগতা, সরকারের খাতায় নিয়মিত হাজিরা- এসব নিয়ে সময় বের করতে পারছেন না। এরই মধ্যে ভাতিজির হঠাৎ-মৃত্যু তাকে, তার পরিবারকে আরও অধিক দুখের বৃত্তে ফেলে দেয়। এদিকে আমারও তর সইছে না। দু’তিনদিন ধরে ভাবছি একা একা ঘুরে আসি! আবার ভালোও লাগে না একা, তাই সঙ্গীর সন্ধানে মনে মনে ঘুরছি। জোহরের নামাজ পড়েই মাওলানা শহীদুল্লাহ-কে ফোন দিলাম, ‘কিয়ানো আছো? যাইতায়নি এক জাগাত! মাওলানা শহীদুল্লাহ বললেন: কিয়ানো যাইতা?কইলাম: ফুলতলিত! গেলে আইওউক্কা।
সাথে সাথে তিনিও রাজি হয়ে গেলেন। তারও মনে দীর্ঘদিনের খায়েশ ফুলতলী যাবেন। কিন্তু আজ/কাল করে জীবনে একবারও যাওয়া হয়নি; তা জানলাম যাত্রা-গপে!
ধারণা ছিল ৪০মিনিটের মোটর ড্রাইভে পৌঁছা যাবে। কিন্তু সিলেট-জকিগঞ্জ রাস্তায় লাখেলাখে ঝাঁকেঝাকে খানাখন্দের ঝাঁকুনিতে সাইকেল আর আগায় না। তবুও ৫০মিনিটের মোটর-ড্রাইভে ফুলতলী পৌঁছার কৃতিত্ব কেবলই ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে উইড়া-উইড়া’ গানের বাল্যোন্মাদনা! আটগ্রাম পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছতেই উন্নয়নের ছাপ এসে ঝাপটে পড়লো মুখে, গতরে। একটু জিরিয়ে এককাপ চায়ের উন্মাদ প্রেম ঝেঁকে ধরলো মগজে। মাওলানাকে বললাম, ‘লামো বা, চা না খাইলে মগজ ঠিক অইতোনায়’! ছিমছাম, পরিপাটি রেস্টুরেন্টের সামন থেকে আধকাঁচা-কলা আর অপরিচ্ছন্ন গ্লাসের পানি হড়হড়ে ঢালতেই কাউস উঠিগেলো তুঙ্গে!
হেই মিয়া, আধালিটারি একটা ফ্রেস পানি দেও। অতা পানি খেউ মুকো দে নি? সারা আদুমছুদুম খারবার! ফ্রেস পানির সোহবতে কলা-খান্দা সাবাড়। আর চা-এর কথা বলতেই বলে ‘লাল চা আছে, দুধ চা নাই’! দুধ চা নাই হুনিয়া মগজে চক্কর মারি দিলো! দুনিয়ার সারা আজেবাজে জিনিষ খাইয়া ইদানীং বাঙালিয়ে লাল-চা খাওয়ার একটা মেকি সচেতনতার লেহেঙ্গা পরছৈন! দুধ চা খাইলে বলে তারার পেট হ্যং অইযায়! গোস্বা করিয়া, উস্কিটান মারিয়া আটগ্রাম থেকে দিলাম পুরুত। এক তালবে-ইলিমে কইলা ‘আর মাত্র ৪কিলোমিটার। তাই আর ‘ওখানে গিয়েই চা পান করব’ সিদ্ধান্তে ছুটলাম। লক্ষ্য: দেশ-বিদেশে খ্যাতি ছড়ানো এক নাম ‘ফুলতলী’।
আমি তখন অনেক ছোট, যখন ফুলতলীর ছা’ব মাওলানা আবদুল লতিফ (রহ.)-র সাথে দাদা মাওলানা ওলিউর রহমান-এর (আমার দাদার চাচাতো ভাই) চিন্তাগত দ্বন্দ্ব দানা বাঁধে। ওলিউর রহমান (রহ.) তাবলিগ জামায়তের কাজ নিয়ে আটগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছলে সংঘর্ষ অনেকটা গায়েগায়ে-পায়েপায়ে অবস্থা! রক্তক্ষয়ী অবস্থায় না পৌঁছলেও উত্তেজনা ছিল থমথমে এবং এ নিয়ে উদ্দীপক অনেক কথাবার্তা সে-বেলা শুনেছি চিত্তরঞ্জক শব্দে!
দোস্তিয়ানাও কম ছিল না। তখন আবদুল লতিফ (রহ.) জোয়ান, বয়স ২৬/২৭বছর। আমাদের বড় দাদা মাওলানা শফিকুল হক (রহ.) আসামের জঙ্গলে। মোড়াঝার, হোজাই, ডবকা অঞ্চলে ইলমে দ্বীনের আলো জ্বালাতে তার মুর্শিদ বানারসের পীর ছাহেবের নির্দেশে ফানাফিল্লাহ। মসজিদ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা সহ আসাম অঞ্চলে এক কর্মময় জীবন তার। আবদুল লতিফ ফুলতলী আসামের মোড়াঝারে গেলেই দাদা শফিকুল হক-এর ঘরে আশ্রয় নিতেন, এর ব্যত্যয় হতো না তার। একবার ফুলতলী গেলেন মোড়াঝার এবং দু’দিন পর শফিকুল হক (রহ.)র সাক্ষাতে গেলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন ‘কুন সময় আইছো? ফুলতলীর উত্তর: দুইদিন অইলো আইছি!
শফিকুল হক উগ্র মেজাজে উষ্মা প্রকাশ করলেন “আমি জানতাম না মোড়াঝারে তোমার উঠবার জন্য অন্য জায়গাও অইগেছে!”- এ ব্যাপারে ফুলতলী (রহ.) স্মৃতিচারণ করেন এভাবে, ‘পীর ছাহেব যখন তার জালালী তবিয়ত নিয়া আমারে এই কথা কইলা, তখন আমার মনে হইছে যেনো আমার পেশাব ছুটি যাইবো। পীর ছাহেব ছিলেন জালালী তবিয়তের। তার কামকাজ, চোখমুখে জালালিয়তের ছাপও ছিল সুস্পষ্ট।’তো, ফুলতলির ছা’ব-এর সাথে জানাশোনার এই ব্যাপ্তি পারিবারিকভাবে শতবর্ষী, আর ব্যক্তিগতভাবে বুঝের কলি ফোটার আগে থেকেই। অবচেতন মনের টান থেকে হোক, আর অজানারে জানার প্রেম থেকে হোক, ফুলতলি যাওয়ার খায়েশ গত সপ্তাহে যে পুরলো, তার সাক্ষী থাকলেন সঙ্গী মাওলানা শহীদুল্লাহ দা:বা:।
মরহুম আবদুল লতিফ ফুলতলী (র.)-কে প্রথম দেখি ১৯৯৯ সালে, সোবহানীঘাটস্থ মাদ্রাসায়, যেখানে তিনি নিয়মিত থাকতেন। মাদ্রাসা আয়োজিত জলসায় তার সৌম্য চেহারার মুগ্ধতা আন্দোলিত করছিল আমাকে। শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জাহানার ইমাম হল’ নামকরণ বিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় সমাবেশে ইবরাহিম তশ্নার উদ্বৃতি দিয়ে তার দেয়া প্রত্যয়ী বক্তব্য এবং এ সূত্রের পূর্ণ সুরাহা করতে তার কাছে যাওয়া আমার জন্যে জরুরি ছিল। আমার জীবদ্দশায় পাওয়া তিনিই ছিলেন শেষ ব্যক্তি যিনি অগ্নিপুরুষ ইবরাহিম তশ্নাকে কাছে থেকে দেখেছেন, এবং আমার পরদাদা উর্দু কবি মাওলানা ইসমাঈল আলম (রহ.)-র সোহবত পেয়েছেন। তাই ইচ্ছে ছিল তার কাছে গিয়ে দুর্লভ কিছু তথ্য উপাত্ত নিয়ে আসব। কারণ, আমি ইবরাহিম তশ্নার জীবনী সংকলন তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজ কাল পরশু করে করে আমার যাওয়া হলো না। তার চোখেদেখা ইতিহাসের নানামুখী বর্ণনা ইতিহাসের পাতায় কলমের অক্ষরে বোনা হলো না- জীবনভর এ আমার বুকে দগদগে এক ক্ষত।
আটগ্রাম থেকে যে রাস্তা ফুলতলী ছুঁয়ে জকিগঞ্জ পৌঁছেছে, তার ডান-বামের দৃশ্য বেশ সুন্দর, মনোলোভা। বিকেলের বাতাস যদি এ সময়ের সঙ্গী হয়, তাহলে যেকোনো শুকনো হৃদয়েও যে ঝিরঝির ঝরবে- এ আমি হলপ করে বলতেই পারি। আশপাশের বাড়িগুলোর দিকে চোখ রেখে শহীদুল্লাহ ভাইকে বললাম: এলাকাটা বউত উন্নত বা, দেখরায়নি যে সুন্দর সুন্দর বাড়ি। আর বাড়ির রাস্তাও খতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তিনিও স্বীকৃতি দিলেন: ‘হু’!
এক দোকানদার বললেন: জিওয়, সামনে গিয়া, পয়লা যে রাস্তা বাউয়ে দি’ ডুকছে, অবায় হামাইযাইবায়। অকটাউ ছা’ব বাড়ির রাস্তা।
হ্যা, বায়ের রাস্তা ধরেই একে একে ফুলতলী ছাহেবের নিদর্শনগুলো নজরে আসতে থাকলো। এ বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। একজন ব্যক্তির চিন্তা-চেতনার প্রায়োগিক স্ফুরণ।
তখন মাদ্রাসা বিদায়ের ঘণ্টা বেজে উঠলো। ঝাঁকে ঝাঁকে সাদা পায়রার দল বেরিয়ে এলো সাদা-দালানের ভেতর থেকে, এ এক অনিন্দ্য সুন্দর দরশন। পুকুরপাড়ে লম্বা দালানের নীচে লাউডস্পিকারে এক বয়োবৃদ্ধের আওয়াজ আসছে। হ্যা, তিনি মরহুম আবদল লতিফ ফুলতলী (রহ.)-র বড়ছেলে মাওলানা ইমাদ উদ্দিন দা:বা:। শহীদুল্লাহ ভাই ছিলেন ক্ষুধার্ত, যেহেতু আমি পেটপুরে গিয়েছি তাই আমার পেটের ক্ষুধা জিভে ওঠেনি, আমি ভাইকে খাওয়ার অনুমতি দিয়ে ইনডোর মাহফিলে যোগ দিলাম। কিছুটা সংকোচ ছিল, একে তো নতুন, তাছাড়া খানকাহ বা সুফি-দরগায় কখনো বসার অভিজ্ঞতা নেই; তারওপর ফুলতলি মসলক নিয়ে আউলবাউল নানা কথা জানা থাকায় কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল মনের কিনারে। আর, ভিন-তরিকার কারো দরবারে গেলে নিয়ম হচ্ছে, তার বা তাদের দরবারের আদবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। না-জানার দুর্বলতায় তাদের প্রতি যেনো অসম্মান প্রদর্শনের কোনো হেতু প্রদর্শিত না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রেখেই ‘বিসমিল্লাহ’ বলে বসে পড়লাম। সম্মুখে সত্তোর্ধ শরীরের জোয়ানী বয়ান চলছে। বক্তব্যে কোনো আত্মম্ভরিতা নেই, লৌকিকতা নেই, অতিকথন নেই। গোছালো, পরিপাটি, ওজনদার আওয়াজের আছর নিজের মাঝে পড়ছে বলে টের পেলাম! এ মজলিশে মাদ্রাসার ছাত্র, আগত মেহমান- যারা দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন তারাও। চোখের সামনে ভেসে উঠলো উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসার ২০বছর আগের চিত্র। মাওলানা ওলিউর রহমান (রহ.) ঠিক এমনি ভাবে জোহরের নামায পরবর্তী সময় ছাত্র-শিক্ষক-সাধারণ উপস্থিতির উদ্দেশ্যে নসিহত রাখতেন; ইমাদ উদ্দীন চৌধুরীর চোখেমুখে, ভরাট আওয়াজে, তর্জনীর ইশারায় একই রঙ-রূপ দেখে মুগ্ধনেত্রে চাইলাম, দেখলাম। ওলিউর রহমান (রহ.)-র সবচে বড় ব্যর্থতা এখানেই যে, তিনি তার কাজের উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেন নি, পিতা ইবরাহিম তশ্নার কাজ তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তার কাজ তার অনুপস্থিতিতে চালিয়ে নেয়ার মতো যোগ্যতা নিয়ে কেউ গড়ে ওঠেনি বা গড়ে তুলতে পারেন নি। এটা একটা বড় ক্ষত কানাইঘাটবাসীর জন্য। শুদ্ধ ধারার চর্চা না থাকায় অসুস্থ ধারা এসে সমাজের সর্বাঙ্গ প্যাঁচিয়ে ধরছে।
সফরের প্রাক্কালে আমার ইচ্ছে ছিল জনাব ইমাদ উদ্দিন চৌধুরীর সাথে সরাসরি কিছু আলাপ করব। কিন্তু ওখানে, মানে ফুলতলি পৌঁছে আমার বুঝে আসলো সরাসরি সাক্ষাত পেলেও একান্ত আলাপের সুযোগ হচ্ছে না, তাছাড়া এখানে যে কর্মচাঞ্চল পরিবেশ, তাতে একান্তে আলাপ সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়, অন্তত ওনার দিক থেকে। সাধারণত সিদ্ধান্তে স্থির থাকি, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘না, পূর্বসূরির পরিচয় বেচে খাবো। আশাকরি চাঞ্ছ পাবো’! তাই তার বক্তব্যের ফাঁকে স্বেচ্ছাসেবক দু’একজন ছাত্রকে বললাম ‘হুজুরের সাথে একটু আলাপ করতাম চাই। কিলা পাইমু তানোরে?’
তুড়া বাদে ছা’ব সাক্ষাতোর সুযোগ দিবা, অনো লাইনো দাঁড়াইলে চাঞ্ছ পাইবা, এছাড়া আর কোনো সুযোগ নাই।’-জওয়াব তালবার।
কি আর করব! বসে রইলাম।
ছা’ব বললেন: যারা রাইত খানকাত থাখবায়, তারা যাওগি’। খাওয়াদাওয়া খরি, রাইতকুর প্রস্তুতি নেও।’- ঘোষণার পরেই যানেওয়ালারা চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়ালো, ছাত্ররা তারও আগে শৃঙ্খলার সাথে দৌড দিল! শিশু-কিশোরদের এ ছুটে-চলার দৃশ্য মুগ্ধকর, স্মৃতি জাগানিয়া। আমরাও ও বয়সে ওভাবে বিদায়-ঘন্টা শুনলে ভোঁ দৌড় দিতাম। কার আগে কে ক্লাসের বন্ধন ছিঁড়বে- সে এক অন্যরকম প্রতিযোগিতা, করতাম। সাথে গলাছাড়া চিৎকার-ফুঁৎকার আর দু’একটা গুঁতোগুঁতি তো থাকতই।
মান্না দে’র গানটা বড়ই বেয়াড়া, যখনতখন এসে হানা দেয়;
“কোথায় হারিয়ে গেল
সোনালী বিকেলগুলো সেই
আজ আর নেই…।”
অবশ্য ফুলতলীতে ছাত্রদের প্রাণোচ্ছাস দেখলেও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখিনি, এটা চোখে লেগেছে।
বিশ্বাস ছিল পরিচয় দিলে তিনি চিনবেন এবং কিছুটা সময়ও দিতে পারেন, তাই সবরের পথ বেছে নিয়ে দাঁড়ালাম। লাইনের একেবারে শেষ ব্যক্তি হিসেবে, সামনে প্রায় দু’শো পুরুষ। দেখেই বুঝা যায় বেশিরভাগ লোকই দূরান্তের, কেউ কেউ যে লন্ডনি তা ছুরতের ছায়াতেই আঁকা। কারও হাতে পানি, কারও বা তৈল, কারও হাতে দুটোই। আমার পেছনে আর কেউ নেই। যেহেতু অন্যরা এসেছে নানা হাজত নিয়ে, আমার তো ওসবের কিছু নেই, তাই সময়ের তাড়া থাকলেও স্বার্থের খাড়া নেই!
দীর্ঘ লাইন দেখে মনে মনে ভাবছি ‘এ লাইন ভাঙতে মাগরিব হয়ে যাবে!’ কেউ একজন আশ্বাস দিলো, ‘১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।- শুনে আশ্বাস পেলাম।
দীর্ঘ লাইনের দ্রুত সমাপ্তিতে ভাল্লাগছিল। সময়ের মূল্য দিলে সময়ের বরকত যেনো এভাবেই বৃদ্ধি পায়!
‘আছছালামুয়ালাইকুম। আমি ইবরাহিম তশ্নার পরিবারোর সন্তান। আপনার লগে একটু একান্তে আলাপ করার খুব ইচ্ছা।’- বলতেই চোখ-মুখ নেচে ওটলো, ঠোঁট হাসলো মুচকি। বিস্মিত চোখে তাকালেন। অনেকটা ঝুকে সামনে এগিয়ে এলেন। বুঝতেই পারলাম, এ দীর্ঘ জীবনে আমার পরিবার থেকে সাক্ষাতের জন্যে এ আমিই প্রথম পুরুষ!
বললেন: ইতা নাম হুনিহারলে আমরার মাথা নীচু অইযায়।
এই (একজন হুজুরকে ইশারা)। অবায় আও। এনরে নিয়া খেদমত করো, খাওয়াদাওয়া করাও। আমি নামাযোর আগে ডাকলে লইয়া আইও।
আমাকে বললেন: আমার অউ কাম। এবলা অউ হরুতাইন অখলোরে গোসল করাইয়া আমি আসরোর নমায পড়তে আইমু, অউ সময় ডাক দিলে আইবা।- সেইসাথে দাঁড়ানোর জায়গা দেখিয়ে দিলেন।
ফাঁক পেয়ে দুটো দানা মুখে দিয়ে এলাম। খাওয়ার দুটো উদ্দেশ্য ছিল: প্রথমত একটা খ্যাতিমান এলাকায় গিয়ে ওখানকার দানাপানি পেটে দিয়ে জীবনের জন্যে সাক্ষ্য হিসেবে রেখে দেয়া, ২য়ত: আবদুল লতিফ ফুলতলি (রহ.) আমাদের বাড়িতে খেয়েছেন, বড় দাদার বাড়িতে (আসামের বাড়িতে) থাকাখাওয়ার পরিমাণ ছিল বেহিসাব, নিজেও তার বাড়িতে দুটো খেয়ে দু-তরফা সম্পর্কের বন্ধন তৈরি করা। তাই ভরা পেটে এক মুটো ভরলাম পেটে! গতর ভারি লাগলেও এতে ভাল্লাগছিলো অনেক।
ইমাদ উদ্দিন চৌধুরীর ছেলে সাদি এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। সুদর্শন যুবক। এবার বিজ্ঞান শাখায় ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে মাদ্রাসায় পড়ছে। ‘বাবা আপনারার লাগি সাক্ষাতোর সময় দিছইন, নিঃসন্দেহে আপনারা গুরুত্বপূর্ণ মেহমান। কেউ বুঝতনায়, বেয়াদবি করতো পারে, এরলাগি আমি আইছি’- বলেই কুশল বিনিময় করলো। স্মিত হাস্যের মালিক সাদি। কথাবার্তায় সৌখিন, রক্তের ওজন বাচনভঙ্গিতে প্রকাশিত। ভালো লাগলো তার আচরণ। আমরা দূর দিগন্তের কেউ নায়, আপনার আব্বায় সম্মান দিছইন, সময় দিছইন, এতে আমরা কৃতজ্ঞ। শুকরিয়া জানাই। আপনার ব্যক্তিগত কামকাজ থাকলে করউক্কা। আমরা আছি, অসুবিধা নাই’- বললেও তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কয়েক হাজার মানুষের কোলাহলে কোনো একজনকে সময় দিয়ে সময়ের অপচয় করার মতো বড় মন দেখিয়ে সাদি আমাদের ঋণী করলো।
পর্যটকের চোখ আটকা পড়ে মাদ্রাসার পুকুর পাড়ে। নারকেলের পাতা-ঝরা বাতাসের ঝিরঝির কানে বাজে, গায়ে লাগে। খুবসুরৎ নারকেল-গাছ আর পুকুরের পাড় ধরে এপারওপার-সম শানবাঁধা-ঘাটে বসতে ইচ্ছা করলেও বসতে পারি নি! কারণ, প্রায় দেড় হাজার মা হারা, বাবা হারা এতিমের গোসলের দৃশ্য অন্তঃপটে রেকর্ড করছিলাম। এ দৃশ্য বর্ণনা করা যায় না। মানুষের অন্তঃপটের কিছু অনুভূতি আছে, তা ভাষাতীত, দুর্বোধ্য ফিতায় বাঁধা। সৃষ্টিকর্তা ওই ভাষা তার নিজের জন্যে রেখেছেন। ওই ভাষার ওজন মাপার ক্ষমতা মানুষের হাতে দেন নি। তাই মানুষ মানুষের কর্মের বিচার অথবা উপহার দুটো পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন করলেও ‘বিশ্বাসের উপর’ যে বিচার তা স্রষ্টার নিজের এখতিয়ারে। এজন্য অন্তরের বিচার কেবল তিনিই করবেন কেয়ামতের ময়দানে। আমি ভাষার সীমাবদ্ধতার জন্যে এতীমের উপর ইমাদ উদ্দিন ছাহেবের এহসানপূর্ণ হাতের বর্ণনা ফুটিয়ে তুলতে পারব না, তার প্রাণের যে পেরেশানি, তার চোখের স্নেহাশিস চাহনি, তার হাতের যে চাঞ্চল্য, তার বুকের যে ব্যথা- তা আমি অল্প হলেও আন্দাজ করতে পেরেছি, কিন্তু আঁকতে পারছি না, পারব না। কেউই পারবে না, তবে অন্তঃচক্ষে দেখলে বিশ্বাস করবে কেবল। বিকেল ৪টার দিকে এতিম বাচ্চাদের নিজহাতে গোসল করালেন তিনি, গোসলের পর মিষ্টি খাওয়ালেন; এসবের প্রতি আমি পক্ষপাতহীন সাফাই গাইছি। কারণ, তখন আমার চোখের উপর আরেকজনের ছায়া এসে ভর করছিল, রূহানী নেত্রে আমি মরহুমের সাথে তার চিত্র-চরিত্র পাশাপাশি রেখে দেখছিলাম। তিনি হলেন মাওলানা ওলিউর রহমান (রহ.)। ওলিউর রহমান (রহ.) প্রতিটি কাজ যে আত্মবিশ্বাসী চোখে শুরু করতেন, যে প্রত্যয় নিয়ে আঙুল-ঝাঁকুনি দিতেন, যেমন মজবুত এবং জোরালো গলায় কাজের তামান্না উগ্রে দিতেন- তার পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি আমি দেখছিলাম ইমাদ উদ্দিন দা.বা.-এর সর্বাঙ্গে। আল্লাহ তার কাজে আরও বরকত দিন।
চারটা বাজতে আর মাত্র ১০মিনিট। আসরের আজানের সময়। ঠিক তখনি তিনি এতিমদের গোসল সমাপ্ত করলেন, স্বেচ্ছাসেবকের একজন আমাদের ডাকলেন ‘ছা’ব-এ ডাকছইন’- বলে। তারে জিজ্ঞেস করলাম ‘ছা’বে কিতা হাত মিলাইন্নানি? (কারণ, আমি বৈঠক-পরবর্তী সাক্ষাতে খেয়াল করেছিলাম তিনি কারো সাথে হাত মেলাচ্ছেন না। আমিও হাত দিলে হাত সরিয়ে নিচ্ছিলেন!)
‘না, কদমবুসি করবা’ বলে আমাকে কদমবুসির তরিকা বাৎলিয়ে দিলো ছাত্র ভাইটি! আমি কখনো, কারও পায়ে হাত দিই নি। এতে পৌরুষের অবমাননা হয়, মানবীয়-সত্ত্বা অপমানিত হয় বলেই বিশ্বাস করি। কদমে চুমা দেয়া, নাদেয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব না করেও, এ কাজ যে বনেদি মানুষের সাথে যায় না- তা আমার অবচেতন মন বলে উঠলো। ইত্যবসরে কদমবুসির পক্ষে দুটো দলিল বা যুক্তি খাড়া করছিলাম। ইমাম আবু হানিফা (র.)-র কবর জিয়ারতে গেলেন ‘হাত তুলে কবর জেয়ারত জায়েজ নয়’ মতামতের পক্ষের ইমাম। কবরের সামনে তিনি হাত তুললেন, দোয়া করলেন প্রাণ ভরে। বিস্মিত অনুসারী প্রশ্ন করলেন: ওস্তাদ, আপনি যে কবরে হাত তুলে দোয়া জায়েজ নয় বলেন!
ওস্তাদের জওয়াব ছিল: হ্যা, জায়েজ নয়। তবে ঐ (আঙুল দিয়ে ইমাম আবু হানিফার কবিরের প্রতি নির্দেশ করে) কবরবাসীর প্রতি সম্মানার্থে হাত তুললাম।
২য়ত: ‘ছবি ওঠানো নাজায়েজ’ মতামতের পক্ষে ছিলেন আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)। ওদিকে জায়েজের পক্ষে ছিলেন বিশ্বখ্যাত চিন্তাবিদ মাওলানা ইউসুফ আল কারযাভী। সম্ভবত ২০০০সালে ইউসুফ আল কারযাভী দারুন-নদওয়া, লক্ষ্ণৌ সফর করেন। সেদিন কারযাভীর সম্মানে আবুল হাসান আলী নদভী ছবি ওঠানোর উপর তার নিষেধাজ্ঞা একদিনের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এ দুটো দলিল সামনে রেখে কদমবুসির পক্ষে-বিপক্ষে এক দোদুল্যমান অবস্থায় ঘুরপাক খেতে থাকি নিজের ভেতর। কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতা গ্রাস করে আমাকে, এবং কদমবুসি না করে, রীতির বিপরীতেই তার সাক্ষাতে মিলিত হই।
তিনি বসলেন। হাতলহীন একটি চেয়ারে বসে নির্দেশ করলেন, ‘আজান ৫মিনিট বাদে দিতে খও, আমি তারারে ৫মিনিট সময় দিছি।’- এই বলে কুশল বিনিময় করলেন নিবিড়ভাবে। তার নানা, একই সাথে তার আব্বা আবদুল লতিফ (রহ.)-র পীর ইয়াকুব বদরপুরী (রহ.)-র সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের সূত্র উল্লেখ করলেন। ইবরাহিম তশ্না (রহ.)-র সাথে ইয়াকুব বদরপুরীর আত্মীক তায়াল্লুক অত্যন্ত গভীর ছিল। তশ্না সম্পর্কে ইয়াকুব বদরপুরীর একটা মন্তব্য ছিল এমন, “আমাদের জ্ঞান বুকের মধ্যে আর তশ্না ছাহেবের জ্ঞান মুখের মধ্যে’। ইবরাহিম তশ্না ভালো বিতার্কিক ছিলেন, ইয়াকুব বদরপুরী তশ্নার তর্কশাস্ত্রের উপর দখলের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন। প্রাসঙ্গিক: একটি মাহফিলে মিলাদ-ক্বিয়াম নিয়ে তর্ক বাঁধলে তশ্না তার প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন এভাবেঃ
জকিগঞ্জের কোনো এক মাহফিলে ইবরাহিম তশ্না-র উপস্থিতিতে দু’দল বিভক্ত হয়ে গেল ‘দাঁড়ানো আর বসা’ নিয়ে! দাঁড়ানেওয়ালারা থাকলেন দাঁড়িয়ে, আর বসনেওয়ালারা থাকলেন মাটি কামড়িয়ে, কোমরভাঙা বিমারির মতো। জান গেলেও নড়বেন না, টানের ছুবে হাত ছিঁড়ে বে-হাত হয় তো হোক, তবুও ‘নো নড়নচড়ন’!
এ দৃশ্যের সাথে আড়ি পাতলেন তশ্না। তিনি শুয়ে পড়লেন! উৎসুক জনতা বিরল এ দৃশ্যের সাথে ছিল অপরিচিত। তারা জানতে চাইলো ‘এ আবার কেমন আমল’?
ইবরাহিম তশ্না কোরানের আয়াত পড়লেন-
“আল্লাহর জিকির করো দাঁড়িয়ে, বসে এবং কাত হয়ে।’’- এরপর বললেন, তোমাদের কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে আল্লাহর জিকির আদায় করছ, বাকি দিকটা না-হয় আমি-ই পুরন করলাম। ভারসাম্যপূর্ণ মানুষের জন্য এ উদাহরণ থেকে রয়েছে চমৎকার শিক্ষা।
ইসলামী বিশেষজ্ঞরা সাধারণত সিলসিলার উপর খুব গুরুত্ব দেন। তা রক্তের হোক অথবা রূহের হোক। রক্তের, মানে বংশধারার তালিকা অথবা রূহানী, মানে পীরের উর্ধধারা, যা রাসুল (স.) পৌঁছেছে; এমন তালিকা অনেকেরই মুখস্থ থাকে। এটা ইসলামি ঐতিহ্যের একটা সমৃদ্ধ সম্পদ। এরই সূত্রে জানতে চাইলেন, তুমি কার ছেলে? দাদা কে?
“আমার আব্বার নাম আবুল কালাম।
আমার দাদা মাওলানা বশিরুল হক।
আমার পর-দাদা মাওলানা ইসমাঈল আলম।” তার চোখ হেসে উঠলো। তোমার পৈড়দাদা তো অনেক বড় আলিম আছলা, বড় শায়ের আছলা। আমি অনেখ আগে তার কেতাব সংগ্রহ করিয়া পড়িছি। আমারগেছে আছিল। বউত বছর তাকি পাইয়ার না। কে যে কুনবায় নিছে, জানি না।”
কইলাম: আছে। আমি অনুবাদোর চেষ্টা করিয়ার।
‘আল্লায় তৌফিক দেউক্কা। চিন হকল রাখো।’
আল্লাহর কাছে তৌফিকের জন্যে দোয়া চাইলাম। দোয়া করলেন।
আমি একটু দ্রুতলয়ে কথা বলে চলছিলাম। কারণ একটাই। তার হাতে কাজের যে পাহাড়, তা দেখে আমার শ্রদ্ধাও উঠেছিল ঠিক চুড়ায়। তাই চাইছিলাম তার যেনো সময়ের অপচয় না হয়। প্রদেয় ৫মিনিটেই যেনো বিদায় নিতে পারি, তাই পূর্ণ সচেতন থেকেছি, আবেগ অথবা বেখেয়ালিকে ঝেড়ে হুশে থেকেছি।
তশ্নার মাঝার কিয়ানো?
বললাম: বাড়িতে।
এখবার যাইতাম।
কইলাম: আলহামদুলিল্লাহ। আমরা খুব খুশি অইমু।
বললেন: আমি বউত জাগায় গেছি। করাচি, পাঞ্জাব, দিল্লী সহ অনেক জায়গায় জিয়ারতে গেছি। আসলে জিয়ারত করলে অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। যারা আল্লাহর পথে চলছইন, তারার রূহানী আছর মনোর উপ্রে পড়ে।
ছেলে সাদী-এর মোবাইল নাম্বার দিলেন (নাম্বারটা ভুল দেখাচ্ছে, যে ছেলেটা এনে দিয়েছিল, সম্ভবত সে ভুল লিখেছে। তার নাম্বারটা জরুরি)। বললেন, আমি মোবাইল চালাই না। মোবাইল চালাইলে সময় পাওয়া যায় না।
আমিও মোবাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগে সম্মতি দিলাম।
এবার হাদিয়ার পালা! কাকে যেনো নির্দেশ দিলেন ‘১হাজারটা টেখা আনো।’ আমি তো অবাক! বলেন কি!
বললাম: হুজুর, টেখা লাগতনায়। অন্য কিচ্ছু দিলাউক্কা!
এই, আমার এক সেট বই আনোছাই।
সাথেসাথে একহাজার টাকা, তার লেখা এক সেট বই আমার হাতে সপে দিলেন। এই ফাঁকে আমিও আমার দুটো কাব্য উপহার দিলাম এক দরদি প্রাণের পাখি আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরীর বিশ্বস্ত হাতে।’রাত্রে বইগুলো আমারে দিও’- এমন নির্দেশ শুনে আশ্বস্ত হলাম আমার কাব্যদ্বয় আজ তার পাঠ করা হবে। ভাল্লাগলো শুনে। আমার বই দিলাম, ওনার বই নিলাম। একপ্রস্ত বইয়ের উজ্জ্বল চোখ আমার দিকে তাকালো। আমি আনন্দে দোলে ওঠলাম। বই আর টাকা; মানুষের জন্যে দুটো জরুরি চিজ। দুটো জরুরি উপহারের মূল্যে আমার হাত ভারী হলো, আমি বললাম: দোয়া করবেন।
তিনি বললেন: চেহারা মনে থাকবে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার চেহারায় এমনভাবে দৃষ্টিপাত করলেন; আমি মানলাম ‘তিনি চিনখানা বুকে এঁকে রাখবেন।’ এমন মহব্বতে বললেন, আমি বুঝলাম; কেমন করে বুকে আগলে নিতে হয়।
রচনা নিয়ে কিছু চয়নঃ
ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী যদি আলেম না হতেন, যদি মানবতার পেছনে নিজেকে উৎসর্গ না করতেন এবং সাহিত্যের ধ্যানে ধ্যানী রাখতেন, তাহলে নির্ঘাত বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কথা সাহিত্যিক যে হতেন-ই, প্রমাণ তার ‘বালাই হাওরের কান্না’। বুকে কী পরিমাণ ঢেউ উথলে ওঠলে, অথবা কি চোখে নিরন্ন মানুষের ছুরতে তাকালে ‘বালাই হাওরের কান্না’ রচনা করা যায়, তার প্রমাণ বালাই হাওরের কান্না-র প্রতি বাক্যে, হরফে হরফে উচ্চকিত। বালাই হাওরের কান্না-য় তার চোখ হাটছে এভাবেই, “বালাই হাওরের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত মায়ামাখা ছায়াঢাকা নিভৃত পল্লী ফুলতলীতে আমার নিবাস। যেখানে নিঝুম নিরালা কবরিস্থানে গহীন রাতে অগণিত জোনাকি জ্বলে আর নিবে। যারা জীবিত তাদের অনেকের ঘরে কেরোসিনের অভাবে সন্ধ্যাদীপ জ্বলে না। রাতের নিঃসঙ্গ মুসাফির চাঁদ গ্রামের আকাশে জাগে। ভাঙ্গা চালা দিয়ে চাঁদের আলো দ্বীন-দুখীদের ঘরে প্রবেশ করে তাদের ব্যথাক্লিষ্ট মুখাবয়ব দর্শন করে মর্মাহত হয়। স্বামীহারা জননী ক্ষুধার আগুনে পোড়া সন্তানদের মাঝখানে বসে গভীর নিশীতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। জীর্ণ শাড়ির আঁচলে অবারিত নয়ন-জল মুছতে মুছতে জনমের মতো সে গ্রামখানা ছেড়ে চলে যায় পরপারে, মাটির ঘরে, আঁধার কবরে।ওদের সম্পর্কে অনেক সকরুণ উপলব্ধি সংরক্ষণ করে রেখেছি সোনালি কৈশোর থেকে আমার পাজরাস্থির বেষ্টনীতে। নির্বাক বিস্ময়ে গভীর নিশীতে হৃদয়ের কানে শ্রবণ করি সে উপলব্ধির রোনাজারি। কাঁদে বালাই হাওর, কাঁদে গোরস্তান, অসহায় বণি আদম। ক্রন্দনরোল ঢেউ তুলে, আমার কলম চলে, আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলে।”- এমন আর্তি যার ঝর্ণায় ঝরে, এমন প্লাবন যার বুকে বয়; তার সঙ্গে আমি সঙ্গী, তার কান্দনে আমি কান্দি।
বালাই হাওরের কান্না-য় এগারোটি ছোটগল্প, কিন্তু গল্পগুচ্ছের ওজন বড় বেশি। না পড়লে বুঝা যাবে না একজন বৃদ্ধের বুকে আফসোসের কত ঢেউ ওঠে, কত সমুদ্র ঝড় তার রূহে বয়। এমন একটি বই হৃদয়-দরিয়ার তট থেকে উপহার নিয়ে এক অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে ঘরে ফিরলাম।
খানকা-ঘরে প্রত্যেক আগন্তুকের হাতে আউশাকদু আর চালকুমড়ার বিচি ধরিয়ে দিচ্ছিল একটি ছেলে। আমি বিচি দেখে ঠিক আঁচ করতে পারছিলাম না ‘কেন’ এ বিচি-উপহার। তাৎপর্য না বুঝলেও ভিন্নধর্মী একটি ধারা দেখে বেশ ভালো লাগছিল। ফুলতলীর খানকায় যে ভাব-চর্চা চলছে, তার মাঝে জীবনের ঘ্রাণ আছে, জীবনের মধ্যে থেকে জীবন-বিরহী একটি তাৎপর্য খুঁজছিলাম কদুর বিচির মধ্যে, কিন্তু নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলাম না। ইমাদ উদ্দিন ছা’ব-এর লেখা একসেট বইয়ের মধ্যে যখন দেখলাম ‘কদুর উপকারিতা ও মধুর উপকারিতা’, ‘ফুলতলি বৃক্ষরোপণ প্রকল্প-২০১৭’ শিরোনামের বইদ্বয়, তাতে অনিশ্চিত ধারণার উপর নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিতে আমার বেগ পেতে হয় নি। কদুর উপর আল্লাহর রাসুল (স.)-এর বেশ কয়েকটি হাদিস এবং কদুর ভেষজ পদ্ধতি বাৎলিয়ে দেয়ার ফলে বইটি যে সুস্থ গতরের জন্যে জরুরি তা বুঝলাম।বৃক্ষরোপণ এর প্রয়োজনীয়তা এবং এ ব্যাপারে আলেম সমাজের উদাসীনতা অনেকদিন ধরেই মনের ভেতর ক্রোধের দানা বাঁধছিল। নিজের এলাকায় দ্বীনীপ্রতিষ্ঠানগুলোর কঙ্কালসার বসতি দেখে প্রতিদিনই চোখে পীড়া পাচ্ছিলাম। যে নবী ‘আগামীকাল কেয়ামত জানলেও আজ একটা গাছ লাগাও’ শিক্ষা দেন, সে নবীর শিক্ষালয়ে, সে নবীর বাণী মুখস্থ করেও বৃক্ষরোপণের ব্যাপারে আলেম সমাজের বিমুখতা আমাকে বিস্মিত করছিল। যে নবী বৃক্ষের ডালে-বসা পাখির জন্যে অথবা ক্লান্ত পথিকের শ্রান্তি লাঘবের জন্যে গাছ লাগানোকে সাদকাহ বলেছেন, সে নবীর শিক্ষা আমাদের আমলের সাথে বৈপরীত্য তৈরি করছে এবং আমাদের দ্বীনী শিক্ষাঙ্গনে তা আরও প্রকট- এমন অভিযোগ আমি আমার মনের সাথে রোজই করছি কোনো সদুত্তর ছাড়াই। কিন্তু বালাই হাওরের তীরে একদল আধ্যাত্মবাদী জিন্দাপ্রাণ তাদের আধ্যাত্ম চর্চার এক জরুরি অঙ্গ হিসেবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীকে গ্রহণ করেছেন দেখে আমার নিরাশ প্রাণেও আশার সন্তরণ শুরু হলো। আমি সত্যিই প্রাণে প্রাণ পেলাম।তার দেয়া প্রত্যেকটি বই-ই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিয়াউন্নবী বইটি নবী প্রেম বাড়ানোর বটিকা হিসেবে কাজ করবে। অনুদিত বই ইমাম বুখারী (র.), শহীদ আহমদ বেরেলবী ও হাফিজ আহমদ জৌনপুরী (র.)-র জীবনী পাঠ করা যাবে শতভাগ সাহিত্যমান সাথে নিয়ে।
ফুলতলী। নামের মাঝেই যার ছন্দ গাঁথা। এ ছন্দের উৎপত্তি ইলমে দ্বীনের তরঙ্গ-মাঝে, এ নামের মাধুর্য তার বিরামহীন কামের মাঝে; এ ফুলতলীতে ঘুরে এলাম। দেখলাম, বুঝলাম।
ফিরবার সময় ছা’ব-এর নির্দেশে এক হুজুর কিছুটা এগিয়ে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন: ভাই, আপনারার বাড়ি কিয়ানো?
কেনো ভাই?
না, ছা’বে ইলা সময় তো কেউরোরে দেইন্না! গত সাপ্তায় এম.পি সেলিম উদ্দিন আইইছলা। এম.পি-রেও ইলা সময় দিছইন্না। কইছৈন, তাইন (এম.পি) এতিম হরুতার কাছতাকি দোয়া লউক্কা। আমার গেছে কিতা। কিন্তু আপনারারে অতো গুরুত্ব দিলা! আজানোর সময় ৫মিনিট ডুলাইদিলা!
আরেক ভাইয়ে জিজ্ঞেস করলা: জনাব, ছা’ব-এ কোন ছা’বোর কথা কইলা? যার কথা হুনলে তানরও মাথা নীচে নামি যায়!
আমি ছিলাম উত্তরহীন। পূর্বসূরির নাম বেচে খাওয়া এক অপদার্থ পথিকের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উত্তর জানা ছিল না। কোনো কামাই যে আমার ঝুলিতে জমা নেই!”