জীবনীমনীষা

ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ. : সময়কে পেছনে ফেলেছে যার সংস্কার

মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী

পিতার দিক থেকে তিনি উমর ইবনে খাত্তাব রা.’র বংশধর। ফারুকী রক্তের আতপ্ত বাষ্প বইছিল তাঁর প্রতিটি শিরায় শিরায়। লেখাপড়ার হাতেখড়ি পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা রহীমিয়ায়। ওখানেই উচ্চশিক্ষা, ওখানেই পিতার হাতে তাসাউফের সবক। পিতার মৃত্যুর পর তিনি মাদরাসা রহীমিয়ার দায়িত্ব নেন এবং আমৃত্যু ওখানেই অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। মাঝখানে ২ বছর কাটিয়েছেন মক্কা-মদীনায়। হেজাজী আলিমদের সাহচর্য তাঁর গভীর জ্ঞানকে আরও শাণিত করেছিল। তাঁর লেখনিতে ভারতের ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম মিল্লাত নববী আদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে পুনরায় উজ্জীবিত হয়েছিল।
একজন মুজাদ্দিদের কর্মপরিধিকে একটি নিবন্ধে সমাবেত করা নেহায়েত বোকামি। অধমের এ ধৃষ্টতাকে আল্লাহ ক্ষমা করুন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ’র জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্তসার নিম্নরূপ-
১. শাহ ওয়ালিউল্লাহ’র প্রধান কৃতিত্ব ছিল, তিনি ভারতীয় মুসলমানদেরকে কুরআন-সুন্নাহ’র দিকে ফেরাতে পেরেছিলেন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, ভারতবর্ষে ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞান কুরআন-সুন্নাহ’র মাধ্যমে বিস্তৃত হয়নি। হয়েছে ফিকহের (ইসলামি আইনশাস্ত্র) হাত ধরে। আলিম-উলামার মজলিসে ফিকহী যুক্তি-তর্কের প্রভাব এতো বেশি ছিল যে, একটি ‘পবিত্র ওযিফা’ (যা পড়ে সাওয়াব পাওয়া যায়) ব্যতীত কুরআনুল কারীমের আর কোনো ভূমিকা মানুষের চিন্তায় উপস্থিত ছিলনা। একইভাবে ইলমে হাদীসের গুরুত্বও ছিল নিতান্ত কম।
শাহ ছাহেব পবিত্র কুরআনের ফার্সি অনুবাদ করে কালামে ইলাহিকে কেবল ওযিফার ভূমিকা থেকে বের করেন এবং উম্মতের আলোকবর্তিকারূপে উপস্থাপন করেন। যদিও এর ফলে তাঁকে প্রথাপূজারী মৌলভীদের পক্ষ থেকে সীমাহীন বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র শাহ রফিউদ্দীন এবং শাহ আবদুল কাদির পবিত্র কুরআনের উর্দু অনুবাদ ও ব্যাখ্যা রচনা করেছেন। এর ফলেই কুরআন ভারতের বুকে যথাযথ পরিচয়ে বিস্তার লাভ করেছিল।
একইভাবে তিনি আবদুল হক দেহলভী রহ.’র হাতে প্রোথিত ইলমে হাদীসের বীজকে সযত্নে লালন করে বিশাল মহীরুহে পরিণত করেছিলেন। বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, উপমহাদেশের ঘুণেধরা মুসলিম সমাজে কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে নববীকে নবরূপ-নবরসে উপস্থাপন করার কৃতিত্ব শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর রহ.’র। পরবর্তীতে ইলমে হাদীসের এ মহান আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ আবদুল আযীয দেহলভী রহ.।
২. শাহ ছাহেবের আরেকটি কৃতিত্ব হচ্ছে, ফিকহে হানাফির অনুসারী হয়েও তিনি তুলনামূলক ফিকহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পেরেছিলেন। কাজটি নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। মক্কা শরীফ থেকে ফিরে তিনি হানাফি ও শাফেয়ী মাযহাবের মধ্যকার দূরত্বকে সুশৃঙ্খলভাবে নিরসনের প্রচেষ্টা চালান। মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যকার মতপার্থক্যের কারণসমূহ (أسباب الإختلاف) তিনি ব্যাখ্যা করেন। যুগের প্রয়োজনে নতুন ইজতিহাদের দরজা খুলেন। প্রবৃত্তিনির্ভর মা-বাপহীন ইজতিহাদ নয়; তাঁর ইজতিহাদ ছিল ইমামদের উসূলের ওপর ভিত্তি করে যুগ-জিজ্ঞাসার সমাধান। স্বভাবতই, শাহ ছাহেবের মতো মুজতাহিদ আলিম ব্যতীত অন্য কারও পক্ষে এটি সমীচীন হতোনা।
৩. শাহ ছাহেবের আরেকটি মহান কৃতিত্ব হচ্ছে, তিনি ঈমানের শাখাপ্রশাখা এবং ইসলামি শরিয়তের কারণ ও উদ্দেশ্য (Purpose and Objectives) সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইসলামের প্রচার-প্রতিষ্ঠা এবং বাতিলের মোকাবিলা করার জন্য জ্ঞান-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ঈমানের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন দীন ও শরিয়তের হিকমত ভালোভাবে অনুধাবন করা। শাহ ছাহেব এই সাগর সেঁচার কাজটি নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। যদিও ইতোপূর্বে অনেকে দীনি হিকমতের কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন; কিন্তু হিকমতে দীনকে একটি মৌলিক দলিল আকারে সন্নিবেশিত করে قُلْ هَٰذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِ আয়াতের হক আদায় করেছেন একমাত্র শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ.। ঈমানের সাথে হিকমত এবং ইলমের সাথে তাজদীদের সমন্বয় করার ব্যাপারে শাহ ছাহেব যে শতভাগ সফল হয়েছিলেন- এটি দুষমনও সাক্ষী দেবে।
৪. শাহ ছাহেব একটি ‘সমন্বিত মুসলিম মানস’ (Comprehensive Muslim Mind) গঠন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দীন ও শরিয়তের ব্যাখ্যাদান করার পাশাপাশি সামাজিক বিষয়াবলীকে তিনি পাকাহাতে চিত্রিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ-
★ সামাজিক দায়িত্বকে তিনি ভাগ করে বিভিন্ন স্তরে। ভাষা, জীবিকা নির্বাহ, সাংগঠনিক গুণাবলী, পারিবারিক ব্যবস্থাপনা, সমবায়ের স্বরূপ ও গঠন তিনি খুলে খুলে বর্ণনা করেছেন। খোদা প্রদত্ত জ্ঞান এবং অর্জিত যোগ্যতার মধ্যে সুষম সমন্বয় সাধন করেছেন।
★ কুক্ষিগত অর্থনীতিকে ভেঙ্গে গতিশীল অর্থনীতির ধারণা স্পষ্ট করেছেন। শ্রমবিমুখ উপার্জনের নিন্দা করেছেন। পুঁজি এবং মানসিক দক্ষতাকে শ্রমের সমপরিমাণ মর্যাদা দিয়েছেন। জাতীয় কল্যাণ এবং কর (Tax) ব্যবস্থার স্বরূপ ও আকার নির্ধারণ করেছেন। সামন্তবাদের (Feudalism) নাকের নিচে বসে তিনি অত্যাচারের সমালোচনা করেছেন। আজকের যুগে এসে এসব তত্ত্ব আমাদের কাছে খুব সহজ মনে হতে পারে। কিন্তু শাহ ছাহেব যখন এসব তত্ত্ব প্রণয়ন করছেন, পুঁজিবাদ (Capitalism) তখনও মায়ের কোলে। সমাজবাদ (Socialism) এবং গণতন্ত্রের (Democracy) তখন জন্মও হয়নি।
★ তিনি خلافة على منهاج النبوة পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ধারণাটি সামনে এনেছেন। ইতিহাসে নামকাওয়াস্তে গড়ে ওঠা খেলাফত নামক রাজতন্ত্রগুলোর ভুল খুঁজে বের করেছেন। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, মানুষের খেলাফত, পরামর্শভিত্তিক শাসন এবং ন্যায়বিচার- যে তত্ত্বগুলো যুগের গহ্বরে একপ্রকার হারিয়ে গিয়েছিল- পুনরায় মুসলিম চিন্তায় অনুপ্রবেশ করিয়ে مُّحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ দ্বারা সংঘটিত মহান বিপ্লবের চেতনাকে তিনি সজীব করতে পেরেছিলেন।
এর ফলাফল হচ্ছে, উপমহাদেশে এরপর যত ইসলামি আন্দোলন হয়েছিল বা হচ্ছে, হোক সফল কিংবা ব্যর্থ, কোনোটিই শাহ ওয়ালিউল্লাহ’র প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। বিশেষত, শহীদে বালাকোট সায়্যিদ আহমদ বেরলভী রহ. কখনোই ‘আমিরুল মুসলিমীন’ হতে পারতেননা, যদি তাঁর পেছনে ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ.’র বিপ্লবী চিন্তা না থাকতো।
৫. শাহ ছাহেব দিল্লীতে বসে দুনিয়া দেখছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন যে, দক্ষিণ ভারতের মারাঠা শক্তি দিনকে দিন যেভাবে মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে ওঠছে, তাতে ক্ষয়িষ্ণু মোঘল সম্রাজ্যের পক্ষে ভারতবর্ষে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা করা অসম্ভব। হয়তো মুসলমানরা বিলীন হয়ে যাবে, নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে তাঁদের ইসলামি স্বাতন্ত্র্যবোধ। এ চিন্তা থেকেই তিনি আফগান শাসক আহমদ শাহ আবদালিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মারাঠাদের প্রতিরোধ করার জন্য। ১৭৬১ সালে পানিপথের ৩য় যুদ্ধে তুলনামূলক কম শক্তির আফগান সেনাদল যেভাবে অজগরসম মারাঠা বাহিনীকে পরাজিত করেছিল, তা আজও ইতিহাসের বিস্ময় হয়ে আছে।
৬. তাসাউফের জগতে শাহ ওয়ালিউল্লাহ এক বিস্ময়কর নাম। পিতার কাছেই তিনি তাসাউফ এবং মানবসেবার দীক্ষা পেয়েছিলেন। ইমাম জুনায়েদ বাগদাদী, ইমাম গাযালী ও ইমাম আহমদ সেরহিন্দীর পথ ধরে কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে তাসাউফকে দীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করার সমুদয় কৃতিত্ব শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর… অন্তত ভারতের বুকে। শাহ ছাহেব তাসাউফের তাত্ত্বিক জটিলতাকে সহজবোধ্য করেছেন, মুসলিম মননে আল্লাহর মারিফতের সিঞ্চন করেছেন, আত্মীক পরিশুদ্ধতাকে মুসলিম মানস গঠনের পাথেয় বানিয়ে হাজির করেছেন। মক্কা-মদীনা সফরকালে যে রূহানী ফয়েজ তিনি লাভ করেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার জন্য তিনি তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর পরে এ খেদমতের দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আযীয এবং শাহ আবদুল গনি। শাহ আবদুল আযীয রহ. প্রথম ব্যক্তি, যার ইংরেজ-বিরোধী ফতোয়া শুনে ভারতের মুসলমানরা ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল।
৭. ইলমে হাদীসের পাশাপাশি শাহ ছাহেব রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ককে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে জীবিত রেখেছিলেন। তিনি মিলাদুন্নবী মাহফিল করতেন, শানে রিসালতের কসিদা পাঠ করতেন এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এসবের বারাকাত লিপিবদ্ধ করে গেছেন। খোলাফায়ে রাশিদীনের ব্যাপারে রাফেজিদের কটূক্তির ক্ষুরধার জবাব দিয়েছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ.।
আল্লাহর কাছে তাঁর খেদমত এতো মাকবুল হয়েছে যে, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীকে বাদ দিয়ে ভারতবর্ষে কারও ইলমি সনদ রাসূলুল্লাহ ﷺ পর্যন্ত পৌঁছানো অসম্ভব।
আজ ২০ আগস্ট। ১৭৬২ সালের এই দিনে (২০ আগস্ট) উপমহাদেশের অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ আলিম, মুজাদ্দিদে মিল্লাত, ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ. পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
২০১৫ সালে অধমের সুযোগ হয়েছিল তাঁর কবর যিয়ারত করার। পুরাতন দিল্লীর শাহজাহানাবাদে পুরোনো কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে বারবার মনে হচ্ছিল, এমন সার্থক জীবন ক’জনের ভাগ্যে জুটে? যে দীপ্তি তিনি ছড়িয়ে গেছেন, যে স্বপ্ন তিনি দেখিয়ে গেছেন- তার তুলনা ইতিহাসে অপ্রতুল। উম্মতে মুহাম্মদীর পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা’আলা তাঁকে সর্বোত্তম প্রতিদান দান করুন। আমীন।।

Related Articles