
[প্রফেসর মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান, সাবেক চেয়ারম্যান, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।]
সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) উত্তর ভারতের রায়বেরেলীর একটি বিখ্যাত হাসানী সায়্যিদ পরিবারে ১৭৮৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৩১ সালের ৬ ই মে পাঞ্জাবের হাযারা জেলার বালাকোট প্রান্তরে শহীদ হন। তাঁর শাহাদাতের পর ১৭৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর জীবন ও আদর্শের উপর ইংরেজীসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচিত হয়েছে।
প্রধানতঃ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এসব রচনায় একদিকে যেমন তাঁকে স্বাধীনতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিপাহসালার এবং সত্যিকার ইসলামের একজন প্রকৃত ধারক ও বাহকরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে, তেমনি আবার কারো কারো পক্ষ থেকে তাঁকে সাম্প্রদায়িক ও ওয়াহাবী বলেও চিত্রিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আমরা তাঁর সঠিক পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করবো এবং সে সাথে সমকালে তাঁর আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা বিচার করবো।
প্রথম কথা হলো, সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) ওয়াহাবী ছিলেন না। এর অনেক কারণের একটি হলো- ওয়াহাবীরা যেখানে তাসাউফ অস্বীকার করে, সেখানে তিনি হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.)-এর সুযোগ্য সন্থান ও খলীফা শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী (র.)-এর বিখ্যাত খলীফা ছিলেন। তিনি আমাদের ভারতবর্ষের সুপরিচিত চার তরীকা- চিশতিয়া, কাদিরীয়া, নকশবন্দিয়া ও মুজাদ্দিদিয়া তরীকায় খিলাফতপ্রাপ্ত ছিলেন এবং তাসাউফে এমন উন্নতি ও পারদর্শিতা অর্জন করেন যে তিনি পরবর্তীতে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদিয়া’ নামে একটি শিরক ও বিদআতমুক্ত সমন্বিত সূফী তরীকা প্রবর্তন করেন।
দ্বিতীয়ত, ওয়াহাবীরা সবখানে ওলীআল্লাহ, নবী- রাসুল এমনকি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) কেও মৃত মনে করে, সেখানে তিনি প্রিয়তম রাসূল (সা.) কে জিন্দা নবী হিসেবে বিশ্বাস করেন। অসংখ্য বার তিনি স্বপ্নে রাসূল (সা.) এর দীদার লাভ করেন ও তাঁর কাছ থেকে নির্দেশ ও হিদায়াত লাভ করেন।
তৃতীয়ত, অবিভক্ত বাংলা ও আসামে যে সব সূফী তরীকা তথা দরবার প্রধান যথা- ফুরফুরা, জৌনপুর, ছারছীনা ইত্যাদি এগুলোর সিলসিলা এক পর্যায়ে সায়্যিদ আহমদ বেরলভীতে যেয়ে মিলিত হয়েছে।
সুতরাং তাকে ওয়াহাবী বলা মানে এমন সূফী তরীকাকেও ওয়াহাবী বলে সাব্যস্ত করার শামিল।
বাংলা ও আসামের প্রভাবশালী সূফী আলিম বর্তমান আসামের করিমগঞ্জের বিখ্যাত বুযুর্গ মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (র.) তাঁরই সূফী তরীকার একজন পরবর্তীকালীন শায়খ। আর হযরত বদরপুরীর বিখ্যাত খলীফা সিলেটের ফুলতলী দরবার শরীফের পীর হযরত আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ চৌধুরী (র.), সুতরাং যেসব বক্তা ও লেখক সায়্যিদ আহমদ বেরলভীকে ওয়াহাবী বলে চিহ্নিত করেন তাঁরা তথ্য সংকটের শিকার।
তবে তাঁকে যে ওয়াহাবী বলে অপবাদ দেওয়া হয় তার একটি কারণ আছে। আর তা হলো- ইংরেজরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম আলিমদের আরবের মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের অনুসারী বলে চিত্রিত করার অপচেষ্টা করেছিল। উইলিয়াম হান্টারসহ অনেক লেখকই এ ধারার অপতৎপরতার সাথে যুক্ত। ইতিহাস স্বাক্ষী দেয় যে, ভারতে বিশেষ করে উত্তর ও পূর্ব ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল সূফীগণের মাধ্যমে। তাই এখানে যে ইসলাম জনগণের হৃদয়ের গভীরে শেকড় গেড়েছে সেটি সূফী আদলের ইসলাম। তাই যদি কোনভাবে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী আলিমদের সূফীবাদবিরোধী তথা ওয়াহাবী বলে চিত্রিত করা সম্ভব হয় তাহলে জনমনে তাঁদের যে উচ্চ স্থান আছে সেটা চলে যাবে এবং জনসাধারণ তাঁদের অনুবর্তী হবে না। এই গভীর মনোসামাজিক ধর্মীয় কারণে সায়্যিদ আহমদসহ সেইসব সর্বত্যাগী সাহসী আলিমদের বিরুদ্ধে ওয়াহাবিয়াতের অভিযোগ উত্থাপন করার অপচেষ্টা করা হয়।