
আপন কর্মে শুকতারার মতো প্রোজ্জ্বল
হযরত আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী (র.)
মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান
(আজ ১ অক্টোবর উস্তাযুল আসাতিযা শায়খুল হাদীস হযরত আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী (র.)-এর ২৬তম ইন্তিকাল বার্ষিকী। তাঁর সম্পর্কে আমার এ লেখা অনেক পুরনো। যেহেতু বর্তমান সময়ের অনেক শিক্ষার্থী তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে খুব কমই জানেন সেহেতু পূর্বের লেখা আবার নতুন করে প্রকাশিত হলো, যাতে অনুসন্ধিৎসু পাঠক কিছুটা হলেও জানার সুযোগ পান।)
তাঁকে আমি খুব বেশিদিন দেখিনি, যত দেখেছি এর চেয়ে অনেক অনেক বেশি শুনেছি তাঁর কথা। শুনেছি, তিনি এমন মহান ছিলেন, এমন বিশাল ছিলেন… ইত্যাদি, ইত্যাদি। সত্যি তিনি জ্ঞানের সুবিশাল অঙ্গনে এক বিরাট বটবৃক্ষ। তিনি মেধা-মননে অতুলনীয়, চরিত্র-মাধুর্যে সত্য-সুন্দরের ধারক-বাহক, যোগ্যতায় নিজের উপমা তিনি নিজে। তিনি জীবনযুদ্ধে হার না মানা এক সেনাপতি, মৃত্যুকে চাক্ষুষ দেখে দেখে মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গনকারী ব্যতিক্রমী পুরুষ। দ্বীনী জ্ঞানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তিনি দ্বীনের একনিষ্ঠ খাদিম, হাদীসে নববীর নিভৃতচারী সাধক, হুব্বে রাসূলে অবগাহনকারী এক মহান পুরুষ।
হ্যাঁ, আমি শায়খুল হাদীস হযরত আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী (র.)-এর কথাই বলছি। তিনি খুব দীর্ঘ জীবন লাভ করেননি, কিন্তু রেখে গেছেন সুদীর্ঘ কর্মধারা। তাঁর একনিষ্ঠ কর্মের ফলরূপ শত শত জ্ঞানবৃক্ষের মধ্য দিয়ে তিনি আজো বেঁচে আছেন আপন মহিমায়। ‘মানুষ বাঁচে তাঁর কর্মে, জীবনের দীর্ঘতায় নয়’-এ সত্যকে তিনি শাশ্বত রূপ দিয়েছেন তাঁর পূর্বসূরী আরো অনেক মনীষার মতো।
হযরত আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী (র.) ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার নিভৃত পল্লী গোটারগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জনাব করামত আলী ছিলেন একজন প্রতিভাবান ও অধ্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব। দাদা মরহুম আরমান আলী ছিলেন একজন সূফী কবি।
আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী (র.) প্রখর মেধা ও ধীÑশক্তির অধিকারী ছিলেন। ছাত্রজীবনেই তাঁর মেধা ও প্রতিভার স্ফূরণ ঘটেছিল। তিনি গ্রামের মক্তবে ধর্মীয় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর হাড়িকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাড়িকান্দি মোহাম্মদিয়া মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। অতঃপর সড়কের বাজার মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সেখান থেকে দাখিল পাশ করেন। এরপর গাছবাড়ি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৫৮ সালে আলিম এবং ১৯৬০ সালে মেধাবৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে ফাযিল পাশ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল (হাদীস) বিভাগে মেধাবৃত্তিসহ সিলেটের মধ্যে প্রথম বিভাগে প্রথম এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় স্থান লাভ করেন।
শিক্ষকতার মধ্য দিয়েই তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এবং সিলেট বিভাগের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইলমে দ্বীন ও ইলমে হাদীসের খিদমতে জীবন অতিবাহিত করেন। কামিল পাশ করার পর তিনি জকিগঞ্জ উপজেলার গঙ্গাজল হাসানিয়া মাদরাসায় প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসায় যোগদান করে অত্যন্ত যোগ্যতা ও সুনামের সাথে শিক্ষাদান করেন। এরপর স্বীয় পীর ও মুরশিদ হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নির্দেশে বিভিন্ন মাদরাসায় দ্বীনের খিদমত আঞ্জাম দেন। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসায় মুহাদ্দিস, ইছামতি কামিল মাদরাসায় উপাধ্যক্ষ ও খণ্ডকালীন অধ্যক্ষ এবং মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সফাত আলী সিনিয়র মাদরাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের জুন মাস থেকে ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসায় উপাধ্যক্ষ ও প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে ইলমে হাদীসের খিদমতে নিজেকে নিবেদিত রাখেন।
ইলমে দ্বীনের সকল বিষয়ে তিনি সমান পারদর্শী এবং শিক্ষাদানে অত্যন্ত দক্ষ ও আন্তরিক ছিলেন। ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয় অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাবলীল ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন। ইলমে তাসাওউফে তিনি ছিলেন গভীর জ্ঞানসম্পন্ন ও নিভৃতচারী একজন ওলীআল্লাহ। মুজাদ্দিদে যামান, শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর সান্নিধ্যে থেকে তিনি এক্ষেত্রে কামালিয়াত অর্জন ও খেলাফত লাভ করেন। ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসারে তিনি আজীবন নিবেদিত ছিলেন। প্রয়োজনের তাগিদে যখনই যে প্রতিষ্ঠান থেকে ডাক এসেছে সেখানে তিনি ছুটে গিয়েছেন। নিজ বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেছেন গোটারগ্রাম দাখিল মাদরাসা।
তিনি একজন সুলেখক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ‘ইসলামের দৃষ্টিতে সালাম ও কদমবুছি’ তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ। কদমবুছি নিয়ে এদেশের আলিম-উলামার মধ্যে যখন মতানৈক্য দেখা দেয় তখন তিনি এ বিষয়ে অকাট্য দলীল-প্রমাণাদি সম্বলিত এ রিসালাহ প্রণয়ন করেন।
তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক ও আদর্শ অভিভাবক, সর্বোপরি একজন আদর্শ মানুষ। ‘আলিমগণ নবীদের উত্তরসূরী’ এ হাদীসের বাস্তব প্রতিফলন ছিল তাঁর জীবনে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার, বিনয়ী, দুনিয়াবিমুখ ও পরহেজগার এক মহান বুযুর্গ। কথা-বার্তা, আচার-আচরণ ও চিন্তা-চেতনায় ছিলেন এক আদর্শ মানব ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য ও ভালোবাসায় সিক্ত। প্রিয় মুরশিদের প্রতিও ছিল তাঁর নিখাঁদ ভালোবাসা। ইন্তিকালের আগে তিনি সুযোগ পেলেই প্রিয় মুরশিদের সান্নিধ্যে সময় কাটানোর চেষ্টা করতেন। একই দিনে বার বার কদমবুছি করতেন আর বলতেন, এ মুবারক কদমখানা আর কত দিন পাবো? আমরা তখন মনে মনে ভাবতাম, হয়তো ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে আমরা আর বেশিদিন পাবো না এবং এ ভাবনা থেকে কষ্ট অনুভব করতাম। কিন্তু কিছুদিন পর যখন আল্লামা গোটারগ্রামী (র.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন তখন মনে হলো তিনি তাঁর দুনিয়ার জীবন সমাপ্তির ইঙ্গিত পূর্বেই পেয়ে গিয়েছিলেন। দুনিয়া থেকে তাঁর বিদায় মুহূর্তের বাস্তবতা আমাদের এ ধারণাকে আরো শক্তিশালী করেছিল।
হযরত আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রমী (র.) ১৯৯৩ সালের ১ অক্টোবর ইন্তিকাল করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। জুমআর নামাযের পূর্বে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে নসীহত পেশ করছেন। পুণ্যবানদের রূহ কিভাবে কবজ করা হবে এ বর্ণনা দিচ্ছেন। তিলাওয়াত করেছেন পবিত্র কুরআন মজীদের সূরা ফজর এর আয়াত:
يَاأَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ – ارْجِعِي إِلٰى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً – فَادْخُلِي فِي عِبَادِي -وَادْخُلِي جَنَّتِي-
অর্থাৎ, “হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার রবের দিকে এমনভাবে প্রত্যাবর্তন করো, যেন তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। আর তুমি আমার বান্দাদের মধ্যে শামিল হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।”
আলোচনার এক পর্যায়ে শরীরে দুর্বলতা অনুভব করায় তখনই দুআর উদ্দেশ্যে হাত উঠান, পরম মমতায় উচ্চারণ করেন- ‘রাব্বানা’। সাথে সাথে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। সময়ের সামান্য তফাতে পাড়ি জমান পরপারের ঠিকানায়। পরদিন শনিবার বাড়ির নিকটস্থ বিশাল মাঠে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাঁকে স্বপ্রতিষ্ঠিত গোটারগ্রাম দাখিল মাদরাসা প্রাঙ্গনে সমাহিত করা হয়।
নানাবিধ গুণাবলির সমাহারে বিভূষিত হযরত আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী (র.) হাদীসে নববীর একনিষ্ঠ খাদিম তথা শায়খুল হাদীস হিসেবে স্বনামখ্যাত। তিনি ‘গোটারগ্রামী মুহাদ্দিস ছাহেব’ হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলেন।
আমাদের সৌভাগ্য যে, আমাদের ওয়ালিদ মুহতারাম হযরত মাওলানা আব্দুছ ছালাম খান (র.) হুজুরের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছাত্র ছিলেন । আল্লাহ তাআলা আমাকেও হুজুরের ছাত্র হবার ও তাঁর সান্নিধ্যে অল্প কিছুকাল কাটানোর মহান সুযোগ নসীব করেছেন। শেষ জীবনে হুজুর যখন ফুলতলী কামিল মাদরাসায় আসেন তখন আব্বা আমাকে হুজুরের কাছে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। হুজুর সস্নেহে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আর ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত অকৃত্রিম স্নেহ-ভালোবাসায় আগলে রেখেছিলেন। মাদরাসায় এসে প্রতিদিনই আমি হুজুরকে কদমবুছি করতাম। তাঁর ইন্তিকালের আগের দিন বৃহস্পতিবার মাদরাসায় এসে যখন কদমবুছি করি তখন তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘আমাকে প্রতিদিন কদমবুছি করা তোমার জন্য ওয়াজিব।’ কিন্তু তখন কি আর জানতাম এ কদমবুছিই শেষ কদমবুছি। আজো প্রতিনিয়ত হুজুরের সে কথা মনে পড়ে। যখনই তাঁর মাজারের পাশ দিয়ে অতিক্রম করি তখনই চেতন কিংবা অবচেতন মনে সালাম বিনিময় করি। হৃদয়ের গভীর থেকে তাঁর জন্য আখিরাতের সর্বোত্তম নেয়ামত কামনা করি।
হযরত আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী (র.) দুনিয়া থেকে চলে গেলেও লক্ষ প্রাণের গভীরে আজো দীপ্তিমান, আপন কর্মে শুকতারার মতো প্রোজ্জ্বল। আল্লাহ তাঁর এ মকবূল বান্দার ফায়য আমাদের নসীব করুন এবং তাঁকে জান্নাতে আ’লা মাকাম দান করুন। আমীন।