জীবনীমনীষা

এক দরবেশ বাদশাহর বিস্ময়কর কাহিনী

মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী

এক.
মিম্বরে দাঁড়িয়েছেন মুসলিম জাহানের খলিফা সায়্যিদুনা উমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিআল্লাহু আনহু। নাকের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন এক সাধারণ নাগরিক। প্রশ্ন করলেন, আপনি এতো লম্বা জামা কিভাবে তৈরি করেছেন? বাইতুল মাল থেকে আমাদেরকে যেটুকু কাপড় দেয়া হয়েছে, তাতে এই জামা তৈরি হওয়ার কথা নয়! খলিফা-পুত্র আবদুল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “চাচা আপনার কথা ঠিক আছে। তবে আমি আমার কাপড়ের অংশ বাবাকে দিয়ে দিয়েছি। তিনি তাঁর অংশ এবং আমার অংশ মিলিয়ে এই জামা তৈরি করেছেন।”

সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার ওয়াজ অনেক হয়েছে। কিন্তু সততা-জবাবদিহিতার এরকম উদাহরণ আর কেউ দেখাতে পেরেছেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ যথার্থ বলেছেনঃ
إِنَّ اللَّهَ جَعَلَ الْحَقَّ عَلَى لِسَانِ عُمَرَ وَقَلْبِهِ
“উমরের জিহ্বা এবং অন্তরে আল্লাহ হক স্থাপন করে দিয়েছেন।”
[জামে আত-তিরমিযি ; কিতাবুল মানাকিব]

দুই.
সেনাপতি আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ রা.’র বাহিনী জেরুজালেম শহর অবরোধ করে রেখেছে। জেরুজালেমের শাসনকর্তা পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস শর্ত দিয়েছেন, “যদি খলিফা নিজে আসেন, তাহলে আমরা জেরুজালেম হস্তান্তর করব।”
খলিফা উমর চললেন জেরুজালেমের পথে। ব্যক্তিগত সফর নয়; রাষ্ট্রীয় সফরে। সাথে একটিমাত্র উট এবং একজন খাদিম। যেহেতু উটের পিঠে রাস্তার প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয় চড়ানো হয়েছে, তাই একজনের বেশি বসার সুযোগ নেই। অগত্যা এক ক্রোশ পথ খলিফা উটের পিঠে বসা, খাদিম চলছে উটের লাগাম ধরে। আরেক ক্রোশ পথ খাদিম ওপরে বসা, খলিফা চলছেন উটের লাগাম ধরে। পথিমধ্যে এক জায়গায় কাদা ছিল বলে জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিয়েছেন। জেরুজালেম শহরে যখন প্রবেশ করছেন, তখন পালাক্রমে খাদিম উটের পিঠে। বেচারা খাদিম হাত জোড় করে বলেছে, “আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি ওপরে উঠুন। লোকে কী বলবে!” খলিফার জবাব ছিলঃ الدور دورك
“এখন পালা তোমার, তুমিই বসবে।”

খাদিমকে উটের পিঠে বসিয়ে এক হাতে কাদামাখা জুতা আর অন্য হাতে উটের লাগাম ধরে জেরুজালেম শহরে প্রবেশ করলেন মুসলিম জাহানের খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব রা.। মুসলিম সেনাবাহিনীর মুখ ঝুলে পড়ল। কী ভাববে রোমান সৈন্যিরা? মুসলিম বিশ্বের খলিফার এই অবস্থা?
পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস দৌড়ে আসলেন। বললেন, “আমরা শুনেছি, এক দরবেশ বাদশার হাতে আমাদেরকে জেরুজালেম ছেড়ে দিতে হবে। আপনাকে দেখে কোনো সন্দেহ রইল না যে, সেই দরবেশ বাদশা আপনিই।” রাসূলুল্লাহ ﷺ যথার্থ বলেছেনঃ
لَوْ كَانَ بَعْدِي نَبِيٌّ لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ
“যদি আমার পরে কেউ নবী হতেন, তাহলে উমর ইবনে খাত্তাব হতেন।”
[জামে আত-তিরমিযি ; কিতাবুল মানাকিব]

তিন.
উমর রা.’র খেলাফতকালে ইরাক, ইরান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, মিশর প্রভৃতি এলাকাজুড়ে মুসলমানরা সগৌরবে ইসলামের পতাকা উড়িয়ে যাচ্ছেন। ঠিক সে সময় বিজিত এলাকার ভূমি মালিকানা নিয়ে জটিলতা দেখা দিল। প্রস্তাব দেয়া হলো, বিজিত এলাকার ভূমি মুজাহিদদের মধ্যে গণিমত হিসেবে বণ্টন করে দেয়া হোক। কিন্তু বাধ সাধলেন স্বয়ং খলিফা উমর। বললেন, যুদ্ধ চলাকালীন সময় যুদ্ধের ময়দান থেকে লব্ধ সম্পদ ব্যতীত আর কিছুই মুজাহিদদের মধ্যে গণিমত হিসেবে বণ্টন করা হবেনা। বিজিত ভূমির মালিকানা ইসলামি রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত থাকবে এবং এর থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় কর সরাসরি বাইতুল মালে (State Treasury) চলে আসবে। খলিফার যুক্তি ছিল, প্রাপ্ত ভূমির মালিকানা ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দিলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। একদিকে বিজিত এলাকার অমুসলিমরা নির্দিষ্ট ব্যক্তির গোলাম হয়ে পড়বে। তাদের ভূমি থেকে প্রাপ্ত কর চলে যাবে ওই ব্যক্তির হাতে। এতে করে পুরো মুসলিম বিশ্ব পরিণত হবে এক বৃহৎ জায়গিরদারিতে। অপরদিকে মুসলিম মুজাহিদগণ দুনিয়ার সম্পদের মোহে পড়ে যাবেন এবং জমিদার হয়ে বসে থাকবেন।

এমন নয় যে, খলিফা তাঁর রায়কে সবার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। বরং ভূমি সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। উক্ত কমিটি সবদিক যাচাই-বাছাই করে শেষ পর্যন্ত খলিফার রায়কে বলবৎ রেখেছিল। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে,
১. বিজিত এলাকার ভূমি গণিমত নয়; বরং ফাঈ হিসেবে গণ্য হবে। যেহেতু পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ফাঈ ইসলামি রাষ্ট্রের সম্পত্তি, সুতরাং এতে কোনো ব্যক্তি মালিকানা থাকবে না।
২. মুসলমানদের মালিকানাধীন ভূমি মুসলমানদের হাতে থাকবে। এ ধরণের ভূমির জন্য খারাজ (Land Tax) দিতে হবেনা, বরং এক-পঞ্চমাংশ বা এক-দশমাংশ হারে উশর (Crop Tax) দিতে হবে।
৩. অমুসলিমদের ভূমি তাদের হাতেই থাকবে। তারা যেভাবে চাষাবাদ করে আসছে, সেভাবে করে যাবে। এ ধরণের ভূমির জন্য খারাজ (Land Tax) দিতে হবে। যেহেতু এগুলো বিজিত এলাকার ভূমি, তাই এর থেকে উশর (Crop Tax) আদায় করা হবেনা। অমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের ওপর জিযিয়ার (Security Tax) পরিবর্তে মুসলমানদের ন্যায় যাকাত আরোপিত হবে। কিন্তু ভূমির অবস্থা পরিবর্তন হবেনা।
৪. আবাদকৃত ভূমির মালিকানা আবাদকারী ব্যক্তির হাতে থাকবে।
৫. যদি কেউ নিজের কৃষিভূমি ৩ বছর পর্যন্ত পতিত অবস্থায় ফেলে রাখে, তাহলে সেটি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চলে যাবে।
৬. বিজয়ী মুজাহিদরা বিজিত শহরের ভেতরে থাকতে পারবেন না। তাঁদেরকে শহরের বাইরে ছাউনি বানিয়ে সেখানে অবস্থান করতে হবে। এতে করে পার্থিব সম্পদের প্রতি তাঁদের মোহ সৃষ্টি হবেনা। অপরদিকে বিজিত এলাকার অমুসলিমরাও সর্বদা হীনমন্যতায় ভূগবে না।

এক সুদূরপ্রসারী বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে উমর রা. পুরো মুসলিম জাহানকে জায়গিরদারি এবং পরোক্ষ জমিদারির অভিশাপ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। যেন এই রায় উমরের নয়; স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ ﷺ যথার্থ বলেছেনঃ
قَدْ كَانَ يَكُونُ فِي الأُمَمِ قَبْلَكُمْ مُحَدَّثُونَ فَإِنْ يَكُنْ فِي أُمَّتِي مِنْهُمْ أَحَدٌ فَإِنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ مِنْهُمْ
“তোমাদের পূর্বেকার উম্মতের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি ছিলেন মুহাদ্দাছ (আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশপ্রাপ্ত)। যদি আমার উম্মতের মধ্যে এমন কেউ থাকেন, তাহলে তিনি উমর ইবনে খাত্তাব।”
[সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ; কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা]

চার.
সংবাদ আসল, ইরানে নিযুক্ত গভর্নর সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. তাঁর বাসভবনের সামনে একটি সেন্ট্রি ঘর বসিয়ে দিয়েছেন। তাঁর সাথে দেখা করতে হলে দারোয়ানের অনুমতি নিতে হয়।
দরবারে খেলাফত থেকে বিলাল রা.-কে একটি চিঠি দিয়ে ইরানে পাঠানো হলো। বলে দেয়া হলো, “প্রথমে গিয়ে ওই সেন্ট্রি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবে। এরপর গভর্নরের হাতে আমার পৌঁছে চিঠি দেবে।”

খলিফার কথামতো বিলাল রা. গিয়েই ওই সেন্ট্রি ঘর জ্বালিয়ে দিলেন। এরপর খলিফার চিঠি দিলেন গভর্নরের হাতে। কাপা কাপা হাতে চিঠি খুললেন সা’দ রা.। ভেতরে লেখা ছিল- “লোকদেরকে তাদের মায়েরা স্বাধীন জন্ম দিয়েছে। তোমরা কবে থেকে তাদেরকে তোমাদের গোলাম বানিয়ে নিলে?”

উল্লেখযোগ্য যে, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. যেনতেন ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি নিজে পারস্য সম্রাজ্য বিজয়ের সেনাপতি ছিলেন। ঘোড়ায় চড়ে সাগর পাড়ি দিয়ে মাদায়েনের শুভ্র প্রাসাদসমূহে আল্লাহু আকবার-এর পতাকা উড়িয়েছেন এই সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা.। কিন্তু ইরান বিজয়ী সা’দ হোন, সিরিয়া বিজয়ী খালিদ ইবনে ওয়ালিদ হোন কিংবা মিশর বিজয়ী আমর ইবনুল আস; খলিফা উমরের দরবারে আইন সবার জন্য সমান। এক চিঠিতে মহাবীর খালিদকে সেনাপতির আসন থেকে সাধারণ সৈনিক বানিয়ে দিতে উমরের হাত কাঁপেনি। সাধারণ এক মিশরীয় খ্রিস্টানকে প্রহার করার অপরাধে গভর্নর আমর ইবনুল আস-এর পুত্রকে পিতাসমেত মদীনায় ডেকে এনে শাস্তি দিতেও উমর রা. দ্বিধাবোধ করেননি। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেনঃ
إن إسلام عمر كان فتحا، وإن هجرته كانت نصرا، وإن إمارته كانت رحمة
উমর রা.’র ইসলাম গ্রহণ ছিল (আমাদের জন্য) বিজয়, তাঁর হিজরত ছিল সহযোগিতা এবং তাঁর শাসন ছিল রহমত।
[সীরাতে ইবনে হিশাম, মুজমা’ আয-যাওয়ায়িদ]

পাঁচ.
উমর রা. বলেছিলেন, “শাসন করার পূর্বে জ্ঞান অর্জন করো।” আর উমরের জ্ঞানের সাক্ষী দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহর নবী। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
بَيْنَا أَنَا نَائِمٌ إِذْ رَأَيْتُ قَدَحًا أُتِيتُ بِهِ فِيهِ لَبَنٌ فَشَرِبْتُ مِنْهُ حَتَّى إِنِّي لأَرَى الرِّيَّ يَجْرِي فِي أَظْفَارِي ثُمَّ أَعْطَيْتُ فَضْلِي عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ.‏ قَالُوا فَمَا أَوَّلْتَ ذَلِكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ‏الْعِلْمَ.
“আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম, আমার সামনে একটি দুধের পাত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি এর থেকে পান করলাম। এমনকি আমি আমার নখের মধ্যেও এর সজীবতা অনুভব করলাম। এরপর দুধের বাকি অংশ উমর ইবনে খাত্তাবকে দিয়ে দিলাম।”
সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি এর দ্বারা কী ব্যাখ্যা করছেন? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন- জ্ঞান।
[সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ; কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা]

এই জ্ঞান উমরকে অহংকারী করে তুলতে পারেনি। ক্ষমতা তাঁকে স্বেচ্ছাচারী করে তুলতে পারেনি। শয়তান তাঁর দোয়ারে কদম রাখতে পারেনি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
إِيهًا يَا ابْنَ الْخَطَّابِ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا لَقِيَكَ الشَّيْطَانُ سَالِكًا فَجًّا قَطُّ إِلاَّ سَلَكَ فَجًّا غَيْرَ فَجِّكَ.
“হে খাত্তাবের পুত্র, কসম সেই সত্ত্বার যার হাতে আমার প্রাণ। যখনই শয়তান তোমাকে রাস্তা দিয়ে চলতে দেখে, তখনই সে তোমার পথ ছেড়ে অন্য পথ ধরে।”
[সহীহ বুখারী ; কিতাবু ফাদ্বায়িলু আসহাবিন নবী, সহীহ মুসলিম ; কিতাবু ফাদ্বায়িলুস সাহাবা]

বলা হয়, “আইন সবার জন্য সমান”। উমর সেটি করে দেখিয়েছেন। বলা হয়, “নেতা জনগনের সেবক”। উমর সেটি করে দেখিয়েছেন। সুশাসনের আশায় মানবজাতি অনেক চেষ্টাচরিত্র করেছে। এক সময় পৃথিবীতে গোত্রীয় শাসন ছিল। বছর জুড়ে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। সেখান থেকে উন্নত হয়ে মানবজাতি রাজতন্ত্রে পা দিল। সেখানে রাজা হয়ে উঠল নমরুদ-ফেরাউন। শুরু হলো অমানবিক অত্যাচার, ভোগ এবং স্বেচ্ছাচারিতা। মানুষ আরেক লাফে চলে আসলো গণতন্ত্রে। সেটি হয়ে গেল পুঁজিপতিদের জুয়াখানা। সেখান থেকে দুই লাফ দিয়ে পাড়ি জমালো সমাজতন্ত্রে। সেটি হয়ে উঠল প্রলেতারিয়েতদের বর্বর দলতন্ত্র। অথচ যে সাম্য, মুক্তি ও ন্যায়বিচার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ নিয়ে এসেছিলেন, তার ধারক-বাহকরা আজ সম্পূর্ণ বেখেয়াল। যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উমর ইবনে খাত্তাব রা., সেই সুশাসনের উত্তরাধিকারীরা আজ বিমশ্র, রঙহীন, হতাশ, দ্বিধাবিভক্ত, জীবন্মৃত। পৃথিবী তাকিয়ে আছে, আমরা ঘুমিয়ে আছি!

আমিরুল মু’মিনীন…
আমিরুল মু’মিনীন…
আমিরুল মু’মিনীন…
আর আসবেন না আপনি?

Related Articles