জীবনীমনীষা

ফুলতলীর বড়সাহেব : মানবসেবাব্রতীর এক অনন্য প্রতিকৃতি

ইউসুফ শরীফ

পরিবারে, সমাজে আজ যা সব হচ্ছে, তাতে মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা সবই তিরোহিত হচ্ছে। ছোটরা বড়দের মান্যগণ্য বা অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতে চাইছে না। তারা মনে করছে, শ্রদ্ধা করার মত লোকের যথেষ্ট অভাব এই সমাজে। এমনকি বাবা-মাও শ্রদ্ধা পেতে পারে না। ছোটদের এই মনোভাবের বিষয়টি এক প্রকার অনালোচিতই থেকে যাচ্ছে। ছোটদের এই মনোভাবের মূল উৎস সন্ধান করা হচ্ছে না। বড়দের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ছোটরা বখে যাচ্ছে। বড়রা মনে করছে, শান্তি-স্বস্তি, সমৃদ্ধির আধার যে স্নেহ-মায়া-মমতামাখা পারিবারিক বন্ধন, তা সবুজ-শ্যামল স্নিগ্ধতাসিক্ত এই দেশটি থেকে কর্পূরের মত উবে যাচ্ছে। এর কারণ বেপরোয়া আকাশ-সংস্কৃতি, অনিবার্য তথ্য-প্রযুক্তির আন্তঃজালীয় বিরূপ প্রভাব। এ সবই হয়ত সত্য, হয়ত কেন, সত্যই- খুবই সত্য। কিন্তু এ-ও তো সত্য, আকাশ-সংস্কৃতি আমরা ঠেকাতে পারব না, তথ্য-প্রযুক্তির আন্তঃজাল থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারব না। তাহলে এগুলো হজম করতে হবে- হজম করার উপায় বের করতে হবে। এ কাজটা কি আমরা আদৌ করছি, না করার চিন্তা করছি? করছি না, বরং আমরা হাল ছেড়ে বসে আছি, আমাদের সন্তানদের নির্বিবাদে বখে যেতে দিচ্ছি।

নিতান্ত প্রাসঙ্গিক বলে এখানে ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে। গত জানুয়ারি মাসে ফুলতলী (রহ.)-এর ইসালে সওয়াবের দুদিন আগে সিলেট গিয়েছিলাম। সিলেট গেলে হযরত শাহজালাল (রহ.) এবং হযরত শাহপরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করি। এরপর আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের জন্য জকিগঞ্জের ফুলতলীতে যাই। এবারও ফুলতলী যাই ইসালে সওয়াবের আগের দিন ১৪ জানুয়ারি সকালবেলা। ফুলতলীতে গেলে বড়সাহেব আল্লামা ইমাদউদ্দীন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। পরের দিন ইসালে সওয়াব। তাই তিনি খুবই ব্যস্ত। যাওয়ার পর দেখা হয়নি। বাড়ির দক্ষিণে প্রায় দেড়/দুই লাখ লোকের স্থান সংকুলান হওয়ার মত বিশাল সামিয়ানা খাটানো হয়েছে। পূবদিকে রান্না ও খাওয়ার জায়গা করা হয়েছে, তাও বিশাল এলাকাজুড়ে।

সব কিছুর চূড়ান্ত তদারকি বড়সাহেবের। দুপুরেও তিনি ব্যস্ত। বিকেলে গাড়ি এসে গেছে। ছোটসাহেব হুছামউদ্দীন চৌধুরী খবর নিয়ে জানালেন, বড়সাহেব পুকুরঘাটে আছেন। গাড়ি মাজারের কাছে গিয়ে থেমেছে। আমি হেঁটে যাচ্ছি। ফুলতলী সাহেবের নাতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহমদ হাসান চৌধুরী শাহান বললেন, চাচা একটু অপেক্ষা করেন, আমি বড়সাহেবকে আপনার কথা বলি। পুকুরের ঘাটে তাকিয়ে এমন এক বিরল দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম, যা মুহূর্ত আগেও আমি কল্পনা করিনি।

ফুলতলীর বর্তমান পীরসাহেব এতিম ছেলেদের গায়ে-মাথায় সাবান লাগিয়ে সস্নেহ যত্নে তাদের গোসল করিয়ে দিচ্ছেন। এ কাজ এত গভীর মনোযোগ দিয়ে করছেন যে, কোনদিকেই তাঁর খেয়াল নেই। হাজারেরও ওপর এতিম লাইন দিয়ে বড়সাহেবের স্নেহ গায়ে মেখে সুশৃঙ্খলভাবে গোসল করছে। গোসলের সময় বাবা-মার সস্নেহ স্পর্শ যাদের কপালে নেই, তারা পীরসাহেবের দরদভরা স্নেহস্পর্শে আপ্লুত হচ্ছে। পিতৃস্নেহের বিকল্প হয় না, এ কথা ঠিক। তবে ফুলতলীতে গেলে যে কেউ দেখতে পাবেন, আল্লামা ইমাদউদ্দীন চৌধুরী বড়সাহেবের সার্বক্ষণিক মমতামাখা স্পর্শ প্রায় সাড়ে বারোশ’ এতিমের মাথার উপর ছায়াবৃক্ষের মত প্রসারিত হয়ে আছে। ফুলতলী সাহেব কিবলাহ বছরের পর বছর যে দরদ ও যত্নে অসহায় এতিম শিশুদের বড় করে তোলার সবক দিয়ে গেছেন, বড়সাহেব পরম আন্তরিকতায়-নিষ্ঠায় তা অনুকরণ করে যাচ্ছেন। শিশু বেড়ে উঠার সময় পিতা-মাতার সান্নিধ্য চায়, স্নেহ, মায়া-মমতা চায়। পারিবারিক পরিবেশে সেই স্নেহ, মায়া-মমতা আজ যেখানে বিরল হয়ে উঠেছে, সেখানে ফুলতলীর এতিমখানার শিশুরা বড়সাহেবের কী অপরিসীম স্নেহ, মায়া-মমতায় মানুষ হয়ে উঠছে, তার প্রমাণ এই এতিম শিশুদের মধ্য থেকে অসংখ্য আলেম, হাফেজ, কারী হিসেবে ইতোমধ্যে সম্মানজনক জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছেন।

এদেশে ফুলতলী যে ভিন্ন কিছু, এটা লিখে বা বলে প্রমাণ করার দরকার নেই। মানবসেবামূলক কার্যক্রমের সূত্রপাত ঘটিয়ে ফুলতলী সাহেব কিবলাহ তার দায়িত্ব দীর্ঘকাল ধরে সাফল্যের সঙ্গে পালন করে গেছেন। ফুলতলী সাহেবের প্রদর্শিত পথে আল্লামা ইমাদউদ্দীন চৌধুরী বড়সাহেব সেবামূলক কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে চলেছেন। এখন মানবসেবার ৪৪টি প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছেন। এতিম, বিধবা ও দুঃস্থ মহিলা, অসহায় নওমুসলিম, মেহনতি মানুষের কর্মসংস্থানে সহায়তা, চিকিৎসাসেবা ছাড়া এমন সব প্রকল্প বড়সাহেব চালিয়ে যাচ্ছেন, দুঃস্থ মানুষের অসহায়ত্বকে পরম মমতায় সূক্ষ্মদৃষ্টিতে না দেখলে, যা চিন্তা করাও সম্ভব নয়।

॥ দুই ॥

আল্লামা ইমাদউদ্দীন চৌধুরী বড়সাহেবের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় সম্ভবত ১৯৯৩ সালে। চুনারুঘাটের মুজিবুর রহমান সাহেব তখন ঢাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত। সন্ধ্যার পর তিনি আমাকে নিয়ে যান ঝিগাতলায় অ্যাডভোকেট বসির সাহেবের বাড়িতে। খোলা ছাদের উপর একটি প্রশস্ত কক্ষ- বড়সাহেব ঢাকায় এসে সেবার ওখানেই উঠেছিলেন। বড়সাহেবকে দেখে, কথা বলে পীর সাহেবের বড় সাহেবজাদা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে কোনই মিল খুঁজে পেলাম না। শুধু তাই নয়, মুজিবুর রহমান সাহেব বিভিন্ন সময়ে তাঁর সম্পর্কে যা যা বলেছেন, মনে হল, তিনি বেশ কম করেই বলেছেন।

অল্পক্ষণের মধ্যেই আলোচনা সাহিত্য, সমাজ, ইতিহাস এবং ধর্ম-দর্শন পর্যন্ত গড়াল। তিনিই বললেন বেশি, আমি শুনলাম। সাহিত্য, সমাজ, ইতিহাসের ভিন্ন ব্যাখ্যা- নতুন আলোর বিচ্ছুরণ, যা একইসঙ্গে যুক্তিগ্রাহ্য ও আবেগ-সমর্থিত। সেই সন্ধ্যারাতে যে অনুরাগের বীজ তিনি বপন করেছিলেন, আমার মধ্যে তা এখনও সক্রিয় রয়েছে। সেদিন ফুলতলী সাহেব কিবলাহর যোগ্য ও সময়োপযোগী উত্তরসূরিকেই যেন আমি প্রত্যক্ষ করলাম। সময়োপযোগী বললাম এ জন্য যে, ফুলতলী সাহেবের শুরু করা মানবসেবার কর্মকা-কে শুধু এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নয়, ভিন্ন এক মাত্রায় পৌঁছে দেয়ার চিন্তা ও প্রস্তুতি তার মধ্যে স্পষ্ট লক্ষ্য করা গেল। পীর সাহেবদের জন্য আপাতদৃষ্টিতে এটি ভিন্ন এক বিষয়। যদিও এদেশে সেই সুলতানী আমল থেকে পীর-আউলিয়া ও সুফী-দরবেশদের খানকা বরাবরই নিঃস্ব, অসহায় মানুষের আশ্রয় ও ভরসার স্থল হিসেবে গণ্য হয়ে আছে। শুধু এদেশে কেন, বিশ্বের কোথাও সত্যিকার অর্থে ইসলাম তরবারি শক্তির জোরে প্রচারিত হয়নি। নির্যাতিত-নিপীড়িত অসহায় মানুষ পীর-আউলিয়া ও সুফী-দরবেশদের মাধ্যমে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করেছে। আজকের যুগে বিস্মৃতপ্রায় এই ঐতিহ্যকে যুগোপযোগী বাস্তবতায় শুরু করেন ফুলতলী সাহেব কিবলাহ এবং তার দায়িত্বভার আন্তরিক নিষ্ঠায় বহন করে চলেছেন বড়সাহেব কিবলাহ। ফুলতলীর এই নানামুখী বিশেষ সেবাকর্ম বিশদ আলোচনার দাবিদার, যার সুযোগ এই স্বল্প পরিসরে নেই।

মনে পড়ছে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে জননেতা ও ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে সে সময় রাতারাতি প্রভাবশালী হয়েওঠা একজন পীর সাহেবের কিছু প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন করায় তিনি সরাসরি জবাব না দিয়ে একটি আপাত ভিন্নতর কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, মানুষের শুধু খাদ্যেরই বদহজম হতে পারে না, আরও অনেক কিছুরই বদহজম হতে পারে। যেমন ধরো, অর্থবিত্তের, ক্ষমতার, মান-সম্মানের, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বা শিক্ষার। ধর্মীয় চিন্তা বা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও অনেকে এই বদহজম থেকে মুক্ত হতে পারে না। এই মনীষী মাওলানার কথাটার মর্মার্থ তখন খুব ভালভাবে বুঝতে পারিনি। বুঝতে পেরেছিলাম এর প্রায় দেড় যুগ পর। আল্লামা আবদুল লতিফ চৌধুরী, যিনি ‘ফুলতলী সাব’ নামে মশহুর। তাকে দেখে বুঝেছিলাম ধর্মচিন্তা বা আধ্যাত্মিকতা হজম বা আত্মস্থ করার পর সার্বিকভাবে একজন ওলি কি রূপে প্রতিভাত হন মানুষের কাছে। আধ্যাত্ম স্বরূপটি নিয়ে কথা বলার যে বোধ ও জ্ঞান, সেসব আমার একদমই নেই। আমি সেদিকে যাবও না। একজন উৎকর্ষচিত্তের মানুষ, একটি ছায়াবৃক্ষের কথাই বলতে পারি।

ফুলতলী (রহ.)-এর শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। প্রকৃতপক্ষে কোন মানুষের শূন্যতাই পূরণ হবার নয়। কারণ মহান আল্লাহর সৃষ্ট মানব জাতির বৈশিষ্ট্য এমনই যে, একজন আরেকজনের মত নয়। ফুলতলী সাবের আধ্যাত্মিকতা ও মানবসেবার সকল কাজের আঞ্জাম যোগ্যতা-দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সঙ্গে দিয়ে যাচ্ছেন আল্লামা ইমাদউদ্দীন চৌধুরী বড়সাহেব কিবলাহ। তাঁর অনুপম আন্তরিক আচরণ ভক্তসাধারণের কাছে এক বড় পাওয়া। তাঁর সরলতা আধ্যাত্মিকতাকে গতিশীল, লক্ষ্যভেদী করে তোলে, এটা বোঝা যায়। সরল জীবনযাপন দুনিয়াবী ঝুট-ঝামেলার ভারমুক্ত রাখতে সহায়তা করে। আল্লাহপাকের ইবাদত-বন্দেগি থেকে শুরু করে মানুষের সেবা সবই নরম হৃদয়ের অনুভবের বিষয়। সাদাসিধে জীবনযাপন ও নিরহঙ্কার সরল আচরণ তাঁর আধ্যাত্ম-চর্চায় যেমন গতি সঞ্চার করছে, তেমনি ভক্তকুলের সঙ্গে রূহানী সম্পর্ককে নিগূঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করছে। এ কথা তাঁর ভক্ত-মুরীদানের জানা আছে।

ফুলতলী সাহেব কিবলাহর রাসূল-প্রেম এ যুগে কিংবদন্তিস্বরূপ। তার উত্তরাধিকার যিনি বহন করছেন, তিনিও রাসূল-প্রেমে নিজেকে মগ্ন রেখেছেন। স্নেহ নিম্নগামী-ফুলতলী সাহেবকে দেখলে, তাঁর কাছে গেলে যে কেউ এই স্নেহস্পর্শ লাভ করতেন। ছায়াবৃক্ষের শীতল-স্নিগ্ধতার পরশ পেতেন। মহান এ ওলির ইন্তেকালের পর এক লেখায় এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতির কথা লিখেছিলাম। এ লেখায় তার পুনরুল্লেখ থেকে বিরত থাকলাম।

আল্লামা ইমাদউদ্দীন চৌধুরী বড়সাহেব ভক্তদের জন্য প্রেমময় আশ্রয়ের উৎস। আল্লাহ-প্রেম, রাসূল-প্রেমের ধারায় যে মানব-প্রেম কি করে মানুষের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তা কতটা নিঃস্বার্থ হতে পারে, তা বোঝা যায় বড়সাহেবের কাছে গেলে। তাঁর কাছে গেলে বোঝা যায়, নরম মানুষ বিষয়টা

আসলে কি নরম মানুষ, নরম মনের মানুষ সকল মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকেন। সর্বোপরি মানুষ যে আধ্যাত্ম- চেতনার সঙ্গে সেবা ও কল্যাণ-কর্মকে সমান্তরালে কত সুন্দর ও সৃজনশীলতার সঙ্গে চালিয়ে যেতে পারেন, তা-ও বড়সাহেবের সার্বিক কর্মকান্ডে সহজ সরলতায় পরিস্ফুট হয়ে আছে। মানব-কল্যাণ ও মানবসেবা ভিন্ন আর কোন উদ্দেশ্য যেখানে নেই, সেখানে আন্তরিকতা-নিষ্ঠা, দরদ ও মমতা নিঃস্ব ও বিপন্ন মানুষকে ভরসা দেয়, আল্লাহ-রাসূলের পথে চালিত হওয়ার দৃঢ়তা ও শক্তি যোগায় এবং অসহায় মানুষের হাতে প্রাথমিক সম্বলেরও সংস্থান করতে পারে। এ সবই লক্ষ্য করা যায় ফুলতলী সাহেব বাড়িকেন্দ্রিক আধ্যাত্ম-চর্চাসহ নানামুখী কার্যক্রমে। ফুলতলী সাহেব কিবলাহর সময় থেকেই সেবামূলক কর্মকা- পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছেন আল্লামা ইমাদউদ্দীন চৌধুরী বড়সাহেব। অসহায় বিধবা মহিলাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি খোঁজ-খবর রেখেছেন, সাহায্য-সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন। এখন দায়িত্ব বেড়েছে, তারপরও সময় করে সশরীরে নিঃস্ব, বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর কাজটি ঠিকই করে চলেছেন। ফুলতলী (রহ.) প্রায় ষাট বছর আগে প্রতিষ্ঠিত দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট, এতিমখানাসহ বিভিন্ন সংস্থার কাজকর্ম দিনের দীর্ঘ সময় বড়সাহেব নিজে সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন।

॥ তিন ॥

আল্লামা ইমাদউদ্দীন চৌধুরী বড়সাহেবের প্রাত্যহিক রুটিনের বড় অংশ জুড়ে যে আধ্যাত্ম-চর্চা, ইসলামী জ্ঞান-চর্চা- তার আলোচনা ভিন্ন বিষয়। এ বিষয়ে আলোচনা বর্তমান নিবন্ধকারের পক্ষে সম্ভবও নয়। আজকের লেখা শেষ করব আরবী-ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে বড়সাহেবের যে ব্যাপক বুৎপত্তি, তার একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে।

আজ থেকে এগারো বছর আগে কবি আল মাহমুদ, কবি আবিদ আজাদ (মরহুম) ও কথাশিল্পী আবু বকর সিদ্দিকীসহ জকিগঞ্জ সাহিত্য সম্মেলনে গিয়ে ফুলতলী সাহেব কিবলাহর বাড়িতে রাতযাপন করেছিলাম। ফুলতলী সাহেবের সাক্ষাৎলাভের দীর্ঘকালের ইচ্ছা ছিল কবি আল মাহমুদের। সে রাতে এই সাক্ষাৎ হয়েছিল। রাত এগারোটার পর কবি আল মাহমুদ ও আবিদ আজাদকে নিয়ে দারুল কেরাতের অফিসে বড়সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। বড়সাহেব আল মাহমুদের কবিতার সূত্র ধরে আরবী-ফার্সি-উর্দু ভাষার খ্যাতনামা ক্লাসিক কবিদের কবিতা নিয়ে গভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক আলোচনার সূত্রপাত করেন। আমরা এমন তন্ময় হয়ে পড়ি যে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় কোথা দিয়ে পার হয়ে যায়, টেরই পাইনি। শেষ পর্যন্ত আমাদের ঘুমের তাগিদ দিয়ে বড়সাহেবই আলোচনা মাঝপথে থামিয়ে দেন। ওই মধ্যরাতে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে ঢুকলেন, আমরা বেরিয়ে এলাম। কবি আল মাহমুদ সেদিন বিস্মিত কণ্ঠে বলেছিলেন, এ কোথায় নিলে এলেন? এ তিনি তো দেখি ক্লাসিক্যাল কাব্য-সাহিত্যের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও বোধ-বিবেচনার এক বিশাল ভান্ডার নিয়ে নিভৃতে বসে আছেন।

আনজুমানে আল ইসলাহ’র ছাত্র সংগঠন তালামীযে ইসলামিয়ার একটি ওয়ার্কশপ উপলক্ষে সহকর্মী বন্ধু মুনশী আবদুল মাননান আর আমি ফুলতলী গিয়েছিলাম। তিনদিন পর ঢাকা ফেরার পথে ট্রেনে বসে মাননান সাহেব বললেন, ইউসুফ ভাই, এত ভাল মানুষ এক সঙ্গে তো দেখা যায় না। ফুলতলী সফরের অভিজ্ঞতার অন্যতম গুরুত্ব একটি দিকের প্রকাশ ঘটেছে তার এ কথায়। ফুলতলী সাহেব কিবলাহর মত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) প্রেমে মগ্ন ওলি যেখানে আছেন, ইমাদউদ্দীন চৌধুরী বড় সাহেবের মত নরম মনের দরদী মানুষ যেখানে আছেন, সেখানে ভাল মনের, ভাল কর্মের মানুষ হওয়া খুবই সম্ভব।

 

লেখকঃ প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, বিভাগীয় সম্পাদক- দৈনিক ইনকিলাব

Related Articles