এক.
কয়েক বছর আগের কথা। কাতারের MTv নামক মিডিয়া উমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিআল্লাহু আনহু’র জীবনের ওপর আরবি ভাষায় একটি ধারাবাহিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিল। মিশরে অধ্যয়নকালে চলচ্চিত্রটি দেখেছিলাম। এক কথায়, অসাধারণ। ইসলামের ইতিহাসের ওপর (প্রায় সঠিকভাবে) নির্মিত এরচেয়ে দীর্ঘ এবং গ্রহণযোগ্য ডকুমেন্টারি আমি আর দেখিনি।
কিন্তু একটি জায়গায় এসে বিরক্তি চেপে রাখতে পারিনি। প্রথমদিকের কয়েকটি পর্বে হামযা রাদ্বিআল্লাহু আনহুকে হত্যাকারী ওয়াহশী (পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, রাদ্বিআল্লাহু আনহু) এবং রায়হানা নামক এক নারীর দীর্ঘ কথোপকথন বারবার চিত্রায়িত করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এই কথোপকথন ছিল প্রেম-মিশ্রিত।
আল্লাহ আমাকে যেটুকু সীরাত অধ্যয়নের তাউফিক দিয়েছেন, তাতে ওয়াহশী-রায়হানার প্রেমালাপ আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। যদি কোনো সীরাত গ্রন্থের কোণায় পড়ে থাকেও; তবু এগুলো নিতান্ত গুরুত্বহীন।
আমার শিক্ষককে ব্যাপারটি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি হেসে বললেন, চলচ্চিত্র চালাতে হবে তো! আমি অবাক, উমর রাদ্বিআল্লাহু আনহু’র বর্ণাঢ্য জীবনকে চিত্রায়িত করার জন্য যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেটি চালাতে হলেও এরকম একটি অযাচিত প্রেমালাপ ঢুকাতে হবে? দেখে মনে হয়েছে, তারা প্রেম করতে না চাইলেও চলচ্চিত্র পরিচালক তাদেরকে জোরপূর্বক প্রেম করিয়ে ছাড়বেন। মনে পড়েছিল, টাইটানিক জাহাজডুবির ট্রাজেডি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রেও একটি রগরগে প্রেমকাহিনী ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। জাহাজটি কেন বা কিভাবে ডুবেছিল, সেটি অনেকের মনে না থাকলেও ওই প্রেমকাহিনী সবার মনে আছে। বুঝলাম, এই সংস্কৃতি আমরা পশ্চিমাদের কাছ থেকে ধার করে এনেছি।
দুই.
অনেকে বলেন, ইমাম গাযালী (আবু হামিদ) নাকি মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করেছিলেন। কারণ তিনি তাঁর পূর্বেকার মুসলিম দার্শনিকদের চিন্তা-দর্শনের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন। আমি এ দাবীর সাথে দ্বিমত পোষণ করি।
ইতিহাসে “মুসলিম দার্শনিক” নামে খ্যাত আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখ ব্যক্তিদের দর্শন “মৌলিক ইসলামি দর্শন” ছিলনা। গ্রীক দর্শন থেকে প্রাপ্ত উচ্ছিষ্টকে তাঁরা কিছুটা “ইসলামিকরণ” করেছিলেন মাত্র। ওই প্লেটোর আইডিয়ালিজম, ওই এরিস্টটলের রিয়েলিজম, ওই মহাজাগতিক যুক্তি-তর্ক দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। এর ফলে কিছুটা লাভ হয়তো হয়েছিল; কিন্তু যে ক্ষতি হয়েছিল তা অনস্বীকার্য। আমাদের দার্শনিকদের কেউ কেউ আলমে গায়েব যেমন কবরের আযাব, আখেরাত, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি বিষয়কে সমূলে অস্বীকার করে বসেছিলেন। ইমাম গাযালী ওই ক্ষতিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যদি আমাদের খ্যাতিমান দার্শনিকরা ইসলামি দর্শন (কুরআন থেকে গৃহীত) বা ন্যুনতম একটি মৌলিক দর্শন নিয়ে উঠে দাঁড়াতেন, আর ইমাম গাযালী তাঁদের বিরোধিতা করতেন, তাহলে তাঁকে দোষ দেয়া যেত।
কেউ কেউ নাক ছিটকাতে পারেন, কুরআন থেকে আবার দর্শন গ্রহণ করা সম্ভব নাকি? মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী যদি তাঁর পুরো চিন্তাদর্শনকে কুরআনের আলোকে সাজাতে পারেন, আধুনিক যুগে এসে আল্লামা ইকবাল যদি কুরআনের একটি আয়াত (সুরা হাশর : ১৯) থেকে তাঁর বিখ্যাত “খুদি দর্শন” (Philosophy of Self) গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে ওই মুসলিম দার্শনিকরা কেন পারেননি? কী দায় পড়েছিল নিওপ্লেটোনিক যুক্তি দিয়ে নতুন আকীদা বিনির্মাণ করার? কুরআনের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল যে চাবুকের আঘাতগুলো সহ্য করেছেন, সেসব আঘাতের হিসেব কিয়ামতের দিন কে দেবে?
আমরা জানি, এই সবকিছুর মূলে রয়েছে মানসিকতার সংকট। সাহাবায়ে কেরামের সিরাতুল মুস্তাকীম ছেড়ে দার্শনিক যুক্তি দিয়ে ইসলামি আকীদা বিনির্মাণ করা থেকে শুরু করে উমর রাদ্বিআল্লাহু আনহু’র জীবন নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রে ওয়াহশি-রায়হানার অযাচিত প্রেমালাপ সংযোজন- সবকিছুর পেছনে রয়েছে ওই একটি কারণ। আমরা, মুসলমানরা নিজেদের জন্য একটি সর্বোপরি স্বতন্ত্র মুসলিম মানসিকতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই ইসলাম তো আছে, যেভাবেই থাকুক, কিন্তু মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ আমাদের মাঝে নেই।
তিন.
মানসিক সংকটের কালো ছায়া পড়েছে আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সংস্কৃতিজুড়ে। আজ পৃথিবীতে কোনো সর্বাঙ্গীণ স্বতন্ত্র ইসলামি অর্থনীতি নেই। আমাদের সুযোগ্য (!) ইসলামি অর্থনীতিবিদরা পুঁজিবাদ এবং সমাজবাদের সাথে প্লাস-মাইনাস করে একটি বোকাসোকা ইসলামি অর্থনীতি উপহার দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন। বিষয়টি কতোটুকু হাস্যকর, তা অর্থনীতির একজন সাধারণ ছাত্রও জানে।
একই ব্যাপার রাজনীতির ক্ষেত্রেও সত্য। আধুনিক যুগে একটি যুগোপযোগী স্বতন্ত্র মৌলিক ইসলামি রাজনীতি বা রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপ দাঁড় করানো প্রায় অসম্ভব। কারণ এর পেছনে যে ইসলামি স্বাতন্ত্র্যবোধ থাকা প্রয়োজন, সেটি আমরা বহু আগেই ত্যাগ দিয়েছি। গত শতাব্দী পর্যন্ত যারা দুনিয়াজুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে, সেই মুসলিম জাতি আজ ঝরে পড়া পাতার মতো প্রাণহীন, মূল্যহীন। ফিলিস্তিনের জন্য কিছু করার সামর্থ নেই, রোহিঙ্গা গণহত্যা রুখে দেয়ার শক্তি নেই, চীনের দশ লক্ষ উইঘুর মুসলমানকে বর্বর বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার উপায় নেই, ইয়েমেনের অনাহারী শিশুদের মুখে এক লোকমা খাবার তুলে দেয়ার মুরদ নেই- আমাদের আছেটা কী? পৃথিবীর ইতিহাসে এতো কম সময়ে কোনো জাতির এতো অধঃপতিত হওয়ার উদাহরণ আর নেই।
খোলাফায়ে রাশিদীনের বরকতময় যুগ শেষ হওয়ার পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে মৌলিকত্ব এবং ইসলামি স্বাতন্ত্র্যবোধের যে সংকট শুরু হয়েছিল, গত শতকে অটোমান সালতানাত ভেঙ্গে যাওয়ার পর সেই অধঃপতন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরপর থেকে আমাদের কথিত ইসলামি রাজনীতি চলে আসছে পশ্চিমের তেল দিয়ে। পশ্চিমে যখন রাজতন্ত্র ছিল, তখন আমাদের এখানে ছিল “ইসলামি রাজতন্ত্র”। আমাদের সুলতানদের বিলাসিতার কাছে রোমান সম্রাটের বিলাসিতা হার মেনেছে। তাদের গণতন্ত্রের সাথে তাল মেলাতে আমাদেরটা হয়ে গেল “ইসলামি গণতন্ত্র”। তাদের ওখানে যখন সমাজতন্ত্র আসলো, আমাদের এখানে আসলো “ইসলামি সমাজতন্ত্র”। তাদের আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা, আমাদের আদর্শ “ইসলামি ধর্মনিরপেক্ষতা”। সবই এক, মাঝখান থেকে ইসলাম বদনাম।
এর ফলাফল হাড়ে হাড়ে টের পেতে হয়েছে। খোলাফায়ে রাশিদীনের অনুসরণে একটি আত্মনির্ভরশীল স্বতন্ত্র মৌলিক ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে এক সময়ের শক্তিধর আব্বাসি-অটোমান-মোঘল সম্রাজ্যগুলো খুব সহজেই টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। আর আজ পৃথিবীতে মুসলমানদের যে অবস্থা, সেটি তো আমাদের চোখের সামনে। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে আজ এর পা ধরি, কাল ওর লেজ। আত্মসম্মানবোধ নামক সূর্য যেন আমাদের আকাশ থেকে চিরতরে অস্তমিত হয়ে গেছে।
চার.
মানসিকতার সংকট সবচেয়ে প্রকটভাবে ধরা পড়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। আমরা দিলে-জানে পশ্চিমা সংস্কৃতির গোলামিকে কবুল করে নিয়েছি। একটি উপন্যাস, একটি চলচ্চিত্র নেই যেটি পশ্চিমের বা বৃহৎ অর্থে অমুসলিমদের ছায়া থেকে শতভাগ মুক্ত। আমাদের চেতনা তাদের, আমাদের চাহিদা তাদের, বিচার তাদের, ভাষা তাদের, শিক্ষাব্যবস্থা তাদের, দিনপঞ্জিকা তাদের, ঔষধের নামগুলো পর্যন্ত তাদের। একটি মুসলিম সমাজের সার্বিক স্বতন্ত্র পরিচয় কী- তা নির্ধারণ করা আজ সাগর সেঁচার মতো কঠিন। যে রোগের কথা বলছি, আমি নিজেও আপাদমস্তক সেই রোগে আক্রান্ত।
পাঁচ.
প্রশ্ন আসতে পারে, একটি স্বতন্ত্র মুসলিম পরিচয় বা মানসিকতার প্রয়োজন কী? জবাবটি নিহিত আছে আমার নবী ﷺ-এর পুরো জীবনজুড়ে। তৎকালীন আরবের চিত্রটি একবার মিলিয়ে দেখুন। এমন একটি বিষয়ও খুঁজে পাবেন না, যেটি ইসলাম আসার পূর্বে যেভাবে ছিল, পরেও সেভাবে বাকি রয়ে গেছে।
কিছু ইবরাহিমী সুন্নাত ছিল, যেগুলো মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ পুনর্জীবিত করেছেন। বাদ বাকি সবকিছু তিনি নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন। আকীদা, ইবাদাত, আচার-অনুষ্ঠান, পরিবার ব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সামরিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে চিন্তা, চেতনা, চাহিদা, রুচিবোধ- সবই নতুন করে দিয়েছেন আমার নবী। তিনি নিজে যেমন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ছিলেন, উম্মতকেও তিনি একটি আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আত্মনির্ভরশীল স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বায় (উম্মাহ) পরিণত করেছেন। তিনি তাঁর সাহাবিদেরকে ইহুদি-খ্রিস্টান কিংবা পৌত্তলিকদের সাথে প্লাস-মাইনাস করতে শেখাননি। শিখিয়েছেন “নিজ” হতে। এদিকে লক্ষ্য রেখেই কমরেড মহেন্দ্রনাথ রায় (MN Roy) তাঁর The Historical Role of Islam নামক লেখনিতে বলেছেনঃ “পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বব্যাপী এবং পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব ছিল সেটি, যা মুহাম্মদের হাত ধরে এসেছিল। মুসলমানদের বিজয়গুলো অন্যান্য বিজয়ীদের বিজয়ের মতো নয়। অন্যরা যেখানে পা রেখেছে, কেবল ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। অপরদিকে মুসলমানরা যেখানে গেছে, সেখানে নতুন সভ্যতা নির্মাণ করেছে, নতুন সংস্কৃতি দিয়েছে, জ্ঞানকে জীবিত করেছে, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেছে।”
আজ আমাদের মাঝে সেই ইসলামি স্বাতন্ত্র্যবোধের লেশমাত্র বাকি নেই। তাই যতই আমরা হাত-পা মারি, সাময়িকভাবে কিছুটা সাহায্য-সহযোগিতা পেলেও, পরিপূর্ণভাবে আমাদের দুরবস্থার পরিবর্তন হচ্ছেনা। অন্তত আগামী কয়েক দশক, কিংবা কয়েক শতক। কে জানে!