আক্বীদা

রাসূল ﷺ এর জানাযার নামাযের পদ্ধতি

মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান

রাসূল ﷺ এর জানাযার নামায ছিল সর্বসাধারণের জানাযা থেকে ভিন্ন। হাদীস এবং সীরাতের কিতবাদিতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ইমাম তিরমিযী র. তাঁর ‘আশ-শামায়িলুল মুহাম্মাদিয়্যা’ কিতাবে “বাবু মা জাআ ফি ওয়াফাতি রাসূলিল্লাহ ﷺ ” শীর্ষক অধ্যায়ে রাসূল ﷺ এর ইন্তিকালের পূর্ব মূহুর্ত থেকে নিয়ে দাফন পর্যন্ত সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন। দীর্ঘ এ হাদীসে রাসূল ﷺ এর জানাযার নামাযের পদ্ধতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

হাদীসটির এক অংশ হলো-
قَالُوا : يَا صَاحِبَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، أَيُصَلَّى عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ؟ قَالَ : نَعَمْ ، قَالُوا : وَكَيْفَ ؟ قَالَ : يَدْخُلُ قَوْمٌ فَيُكَبِّرُونَ وَيُصَلُّونَ وَيَدْعُونَ ، ثُمَّ يَخْرُجُونَ ، ثُمَّ يَدْخُلُ قَوْمٌ فَيُكَبِّرُونَ وَيُصَلُّونَ وَيَدْعُونَ ، ثُمَّ يَخْرُجُونَ ، حَتَّى يَدْخُلَ النَّاسُ.

অর্থ : (রাসূল সা. এর ইন্তিকালের পর সাহাবায়ে কিরাম তাঁর কাফন-দাফন সহ বিভিন্ন বিষয়ে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রা. এর কাছ থেকে জানতে চাচ্ছিলেন।) সাহাবায়ে কিরাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ওগো আল্লাহর রাসূলের সাথী! রাসূল ﷺ এর কি জানাযার নামায পড়া হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ পড়া হবে। তারা আবার জানতে চাইলেন কিভাবে পড়ব? হযরত আবূ বকর রা. বললেন, লোকজনের (সাহাবায়ে কিরাম) একদল হুজরা শরীফে প্রবেশ করবে, তারা তাকবীর দিবে, দুরূদ পড়বে এবং দুআ করে বেরিয়ে যাবে। অতপর আরেক দল প্রবেশ করবে, তাকবীর দিবে, দুরূদ পড়বে এবং দুআ করে বেরিয়ে যাবে। এভাবে সকল লোক প্রবেশ করবে।

এ হাদীস থেকে কয়েকটি বিষয় জানা গেল। জানাযার জন্য সাহাবায়ে কিরামের
১। দলে দলে হুজরা মুবারকে প্রবেশ করা
২। তাকবীর দেওয়া
৩। দুরূদ পড়া এবং
৪। দুআ করা।

ইমামতি প্রসঙ্গ
রাসূল ﷺ এর জানাযার নামায হয়েছে, তবে তাতে কোন ইমাম ছিলেন না। এ বিষয়টির উপর মুসলমানদের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নবী কারীম ﷺ এর জানাযায় কোন ইমাম না থাকার ব্যপারে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কয়েকটি হাদীস নিচে উপস্থাপন করছি।

ইমাম ইবনু সা’দ তার ‘আত তাবকাত’ এ উল্লেখ করেন-
عن جعفر بن محمد عن ابيه قال صُلى على رسول الله صلى الله عليه وسلم بغير إمام يدخل عليه المسلمون زمرًا زمرًا يصلون عليه

অর্থ- ইমাম জাফর ইবনু মুহাম্মদ স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল ﷺ এর জানাযার নামায হয়েছে ইমাম ব্যতীত, মুসলমানগণ দলে দলে তার ঘরে প্রবেশ করেছেন এবং তার উপর দুরূদ পড়েছেন।

আত তাবকাত এর অন্য জায়গায় আরো স্পষ্ঠভাবে বর্ণিত হয়েছে। যখন রাসূল ﷺ কে খাটের উপর রাখা হলো তখন হযরত আলী রা. বললেন-
لا يؤم أحد، هو إمامكم حيا وميتا. فكان يدخل الناس رسلا رسلا فيصلون عليه صفا صفا ليس لهم إمام ويكبرون

অর্থ : কেউ ইমামতি করবে না, কেননা তিনি (নবী কারীম ﷺ) হলেন ইহকালীন জীবনে এবং ইন্তিকাল পরবর্তী জীবনে তোমাদের ইমাম। অতপর লোকেরা দলে দলে (হুজরা মুবারকে) প্রবেশ করলেন, ইমাম ছাড়াই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তার উপর দুরূদ পড়লেন, তাকবীর দিলেন। (আত তাবকাত লি ইবনি সা‘দ, ২য় খণ্ড, ২৫৪ পৃ.)

এ বর্ণনাটি ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী র. তাঁর ‘জামউল জাওয়ামে’ কিতাবে, ইমাম যুরকানী ‘শরহুল মাওয়াহিব’-এ, ইউসুফ সালেহী ‘সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ’-এ বর্ণনা করেছেন।

ইমাম ইবনু আবি শায়বাহ তার ‘আল মুসান্নাফ’-এ বর্ণনা করেন-
عن: سعيد بن المسيب: قَالَ: لَمَّا تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وُضِعَ عَلَى سَرِيرِهِ, فَكَانَ النَّاسُ يَدْخُلُونَ زُمَرًا زُمَرًا، يُصَلُّونَ عَلَيْهِ وَيَخْرُجُونَ، وَلَمْ يَؤُمَّهُمْ أَحَدٌ

অর্থ : হযরত সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব বলেন, যখন রাসূল ﷺ ইন্তিকাল করলেন তখন তাঁকে খাটের উপর রাখা হলো। লোকেরা দলে দলে তার কাছে (হুজরা মুবারকে) প্রবেশ করলো এবং দুরূদ শরীফ পড়ে বেরিয়ে গেল। তবে কেউ তাতে ইমামতী করেন নি।

এ বর্ণনাটি মুরসাল, তবে হাসান স্তরের। তাছাড়া বর্ণনাটি সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাবের ‘মারাসীল’ এর, যে মারাসীলটি সহহীহ হিসাবে মুহাদ্দিসগণের নিকট প্রসিদ্ধ। রাসূল ﷺ এর জানাযায় ইমাম না থাকা প্রসঙ্গে ইবনু মাজাহ, বায়হাকী ও মুসনাদে আহমদেও একটি বর্ণনা আছে। তবে এর সনদ দূর্বল।

উপরের সবগুলো বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন শব্দে হলেও এ কথার উপর এক মত যে, রাসূল ﷺ এর জানাযায় কোন ইমাম ছিলেন না।

আইম্মায়ে কিরামের অভিমত
এ বিষয়ের উপর আইম্মায়ে কিরামের ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিচে কয়েকজন সালফে সালেহীনের মতামত উপস্থাপন করা হলো।

১। ইমাম ইবনু আব্দিল বার র. বলেন-
وأما صلاة الناس عليه أفذاذاً – يعني : على النبي صلى الله عليه وسلم – فمجتمع عليه عند أهل السير وجماعة أهل النقل ، لا يختلفون فيه

-লোকেরা তাঁর অর্থাৎ নবী কারীম ﷺ এর জানাযার নামায আদায় করেছিলেন একাকীভাবে। এ বিষয়ে সীরাতবিদগণ এবং হাদীস বর্ণনাকারীগণ ঐক্যমত্য, কোন মতভিন্নতা নেই। (আত-তামহীদ: খণ্ড ২৪, পৃ. ৩৯৭)

২। ইমাম শাফেঈ র. বলেন-
صلى الناس على رسول الله صلى الله عليه وسلم أفرادا لا يؤمهم أحد
অর্থ : লোকজন একাকী রাসূল ﷺ এর নামায আদায় করেন, তাতে কেউ ইমামতি করেন নি। (কিতাবুল উম্ম: খণ্ড ১, পৃ. ৩১৪)

৩। ইমাম ইবনু কাসীর র. বলেন-
وَهُوَ صَلَاتُهُمْ عَلَيْهِ فُرَادَى لَمْ يَؤُمَّهُمْ أَحَدٌ عَلَيْهِ، أَمْرٌ مُجْمَعٌ عَلَيْهِ لَا خِلَافَ فِيهِ.

অর্থ: রাসূল ﷺ এর ক্ষেত্রে সাহাবীদের জানাযার নামায ছিল একাকী, তাতে কেউ ইমামতী করেন নি। এ বিষয়টি সর্বসম্মত, তাতে কোন দ্বিমত নেই। (আল-বেদায়াহ ওয়ান নেহায়াহ: খণ্ড ৩, পৃষ্টা ২৮৮)

ইমাম না থাকার কারণ
রাসূল ﷺ এর জানাযায় ইমাম না থাকার কারণ হিসাবে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়। তবে এ বিষয়ে আইম্মায়ে কিরামের মধ্যে মতানৈক্য আছে। প্রণিধানযোগ্য কয়েকটি কারণ নিচে উপস্থাপন করা হলো।

ইমাম শাফেঈ র. ‘কিতাবুল উম্ম’ এর ১ম খণ্ডের ৩১৪ পৃষ্ঠায় এর দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

এক. রাসূল ﷺ এর সম্মান ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করে কেউ তার জানাযার ইমামতি করেন নি।

দুই. পরস্পর বিবাদ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কেউ ইমামতী করেন নি। কেননা রাসূল ﷺ এর জানাযায় ইমামতী করা পরম সম্মানের বিষয়। যে কেউ এ সম্মান গ্রহণ করতে চাইবেন। তাই যাতে তাদের পরস্পরে এ নিয়ে কোন দ্বন্দ না হয় তাই ইমামতীর বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।

ইমাম রামালী বলেন-
لأنه لم يكن قد تعين إمام يؤم القوم ، فلو تقدم واحد في الصلاة لصار مقدما في كل شيء ، وتعين للخلافة
অর্থ: যেহেতু তখনো এমন কাউকে মুসলিম জাতির ইমাম নির্দিষ্ঠ করা হয় নি যিনি নামাযে ইমামতী করবেন। যদি কাউকে ইমামতীর জন্য এগিয়ে দেওয়া হতো তাহলে তিনি হতেন সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের ইমাম, পরোক্ষভাবে তিনি খেলাফতের জন্য নির্দিষ্ঠ হয়ে যেতেন। (নিহায়াতুল মুহতাজ: খণ্ড ২, পৃ ৪৮২)

ইমাম কুরতুবী র. বলেন,
أرادوا أن يأخذ كل أحد بركته مخصوصا دون أن يكون فيها تابعا لغيره
অর্থ : সাহাবায়ে কিরাম সকলের ইচ্ছা ছিল যেন অন্যের অনুসরণ তথা মধ্যস্থতা ছাড়াই সরাসরি রাসূল ﷺ এর বরকত গ্রহণ করতে পারেন। (আল জামে লি আহকামিল কুরআন : খণ্ড ৪, পৃ ২২৫)

হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে একটি কারণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন
لا يؤم أحد، هو إمامكم حيا وميتا
অর্থ : কেউ তাঁর নামাযে ইমামতী করবে না কেননা তিনি হলেন তোমাদের সর্বাবস্থায় ইমাম, ইহকালীন এবং ইন্তিকাল পরবর্তী অবস্থায়ও। (আত তাবকাত লি ইবনি সা‘দ, ২য় খণ্ড, ২৫৪ পৃ.)

দুআ
রাসূল ﷺ এর জানাযার নামায সংক্রান্ত বর্ণনায় এটাও আছে যে, সাহাবাযে কিরাম দুআ করেছেন। ইমাম তিরমিযী তাঁর শামায়েলে বর্ণনাটি এনেছেন। কিন্তু দুআ কিভাবে ছিল, সাহাবায়ে কিরাম কী বলে দুআ করলেন তার বর্ণনা সীরাত এবং ইতিহাসের কিতাবে রয়েছে। ইবনু সা’দ তার তাবাকাতের ২য় খণ্ডের ২৫৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন হযরত আবূ বকর রা. ও উমর রা. দুআ করছিলেন আর উপস্থিত সাহাবীরা ‘আমীন’ ‘আমীন’ বলছিলেন। আরেক বর্ণনায় আছে হযরত আলী রা. দুআ করছিলেন আর অন্যরা আমীন আমীন বলছিলেন। তাবকাতুল কুবরার এই বর্ণনা পরবর্তীতে অনেক মুহাদ্দিসীনে কিরাম গ্রহণ করেছেন।

ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী র. তাঁর ‘জামউল জাওয়ামে’ কিতাবে, ইমাম যুরকানী ‘শরহুল মাওয়াহিব’-এ বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাটি হলো-
لما كفن رسول الله صلى الله عليه وسلم ووضع على سريره دخل أبو بكر وعمر فقالا : السلام عليك أيها النبي ورحمة الله وبركاته، ومعمهما نفر من المهاجرين والأنصار قدر ما يسع البيت، فسلموا كما سلم أبو بكر وعمر وصفوا صفوفا لا يؤمهم عليه أحد، فقال أبو بكر وعمر وهما في الصف الأول حيال رسول الله صلى الله عليه وسلم: اللهم إنا نشهد أن قد بلغ ما أنزل اليه ونصح لأمته وجاهد في سبيل الله حتى أعز الله دينه وتمت كلماته فآمن به وحده لا شريك له، فاجعلنا يا الهنا ممن يتبع القول الذي أنزل معه واجمع بيننا وبينه حتى يعرفنا ونعرفه فإنه كان بالمؤمنين رؤفا رحيما، لا نبتغي بالإيمان بدلا ولا نشتري به ثمنا أبدا، فيقول الناس: آمين آمين
অর্থ : যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাফন দেওয়া হলো এবং তাঁর খাটের উপর রাখা হলো তখন হযরত আবূ বকর রা. ও উমর রা. প্রবেশ করে সালাম জানালেন, السلام عليك أيها النبي ورحمة الله وبركاته তাদের সাথে আনসার ও মুহাজিরগণের একদলও প্রবেশ করলেন এবং আবূ বকর রা. ও উমর রা. এর মতো সালাম দিলেন। তারা সকলে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালেন তবে কেউ তাদের ইমামতী করেন নি। হযরত আবূ বকর রা. ও উমর রা. প্রথম কাতারে রাসূল সা. এর পাশে ছিলেন, তারা দুআ করতে লাগলেন-
اللهم إنا نشهد أن قد بلغ ما أنزل اليه ونصح لأمته وجاهد في سبيل الله حتى أعز الله دينه وتمت كلماته فآمن به وحده لا شريك له، فاجعلنا يا الهنا ممن يتبع القول الذي أنزل معه واجمع بيننا وبينه حتى يعرفنا ونعرفه فإنه كان بالمؤمنين رؤفا رحيما، لا نبتغي بالإيمان بدلا ولا نشتري به ثمنا أبدا
অন্যান্য সাহাবীরা (তাদের দুআর সাথে) আমীন আমীন বলছিলেন।

Related Articles