
মায়ের দুধকে রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করে রাখা। এই পদ্ধতিকে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বলা হয়। পশ্চিমা বিশ্বে প্রায় বিশ বছর আগে এটি শুরু হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে এ পদ্ধতি সূচনা করতে চাইলে উলামায়ে কিরাম এর বৈধতা নিয়ে আপত্তি তুলেন। এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটি পর্যালোচনা নিচে উপস্থাপন করছি। তার জন্য আমাদের রেদাআত তথা দুধ সম্পর্ক কি এবং কিভাবে স্থাপন হয় তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
জন্মদাত্রী মা ছাড়া অন্য কোন মহিলা শিশুকে দুধ পান করালে সেটাকে দুধ সম্পর্ক বলে। আরবীতে ইহাকে রিদ্বাআত বলে। দুধ সম্পর্ক বংশীয় আপন সম্পর্কে মতোই। আপন ভাই-বোন, জন্মদাত্রী মা, তাদের যে হুকুম হবে দুধ সম্পর্কের কারণে একই হুকুম দুধ ভাই, দুধ বোন, দুধ মাতা, বাবা তাদের সাথেও হবে। সকল ফকীহগণ এ বিষয়ে একমত যে, বংশীয় কারণে যেভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম তদ্রুপ দুধ পানের মাধ্যমে যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় তাতেও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হারাম। হাদীস শরীফে এসেছে,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, يحرم من الرضاعة ما يحرم من النسب (বংশীয় সম্পর্কের ভিত্তিতে যারা হারাম, দুধ সম্পর্কের ভিত্তিতে তারাও হারাম। (বুখারী, ৭/১৫) তবে কতটুকু দুধ পান করলে এ সম্পর্ক স্থাপন হবে এ নিয়ে ফকীহগণ মতানৈক্য করেছেন।
উলামায়ে আহনাফের তথা হানাফী মাযহাবের আইম্মায়ে কিরামের কাছে রেদ্বাআত বা দুধ সম্পর্ক সাব্যস্ত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ঠি কোন পরিমাণ নেই। বরং দুধের পরিমাণ কম বা বেশি হোক তাতে দুধ সম্পর্ক স্থাপন হবে। (আল বেনায়া শরহুল হিদায়াহ, ৪/৮০৪) ফুকাহায়ে আহনাফের এ সিদ্ধান্তের দলীল হলো আল্লাহ তাআলার বাণী- وَأُمَّهَاتُكُمُ اللَّاتِي أَرْضَعْنَكُمْ(তেমাদের সে সকল মাতা যারা তোমাদের স্তন্যপান করিয়েছেন) এ আয়াতে মুতলাকানভাবে রিদ্বাআতুন শব্দ এসছে, যা কম এবং বেশি উভয়কেই অন্তর্ভূক্ত করে। এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস … يحرم من الرضاعة এ হাদীস থেকে প্রমাণ হয় দুধ পান কম হোক বা বেশি হোক তাতে রেদ্বাআত সাব্যস্থ হবে। কেননা রাসূল সা. হুরমতে রেদ্বাআতের ইল্লত বা কারণ বলেছেন শুধুমাত্র দুধ পান করানো। সেটা কম হোক বা বেশি হোক। ইমাম আইনী বলেন, পাঁচবার, সাতবার, দশকার এরূপ শর্তারূপ ছাড়াই হুরমতে রেদ্বাআত সাব্যস্থ হবে। (আল বেনায়া শরহুল হিদায়াহ, ৪/৮০৭) সুতরাং শিশুর পেটে যদি এক ফোটা দুধও প্রবেশ করে তাতে হুরমতে রিদ্বাআ সাব্যস্থ হবে।
এ মাসআলায় মালেকী মাযহাবের ইমামগণ হানাফীদের সাথে একমত। ইমাম শাফেঈ ও আহমদ দুধের পরিমাণে শর্তারোপ করেছেন।
#কোন দিক দিয়ে দুধ পেটে পৌঁছলে দুধ সম্পর্ক সাব্যস্ত হবে:
শিশু যদি স্তনে মুখ না লাগিয়ে দুধ পান করে অর্থাৎ যদি স্তনের দুধ সিরিঞ্জ, ড্রপ বা অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে শিশুর গলা পর্যন্ত বা সরাসরি পাকস্থলিতে অথবা মগজে পৌঁছিয়ে দেয়া হয় তাতেও হুরমতে রেদ্বাআত সাব্যস্থ হবে। এ বিষয়ে চার মাযহাবের অধিকাংশ ফকীহ একমত পোষণ করেছেন। (বাদায়ে‘ ৩/৪০৭, বেদায়াতুল মুজতাহিদ ৩/৯৯৯, আল মুগনী ১১/৩১৩)
তবে দুধ যদি কান দিয়ে প্রবেশ করে তাতে রেদ্বাআত সাব্যস্থ হবে না। অথবা যদি শরীরের অন্য কোন স্থানে ইনজেকশন পোশ করে দুধ দেওয়া হয় তাতেও হুরমত সাব্যস্থ হবে না। (বেনায়াহ ৪/৮২৬, আল মুগনী ১১/৩১৩)
#কত বয়সে দুধ পান করলে দুধ সম্পর্ক হবে:
এ মাসআলায় আহলে জাওয়াহির ব্যতীত সকলে একমত যে, দুধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হওয়ার জন্য অবশ্যই শিশুকে শিশু বয়সেই দুধ পান করতে হবে। শিশু বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার পর কোন মহিলার দুধ পান করলে দুধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হবে না। তবে কত বছর বয়স পর্যন্ত শিশু বয়স সেটা নিয়ে ফকীহগণের ভিন্নমত আছে।
(এক) ইমাম আবূ হানীফা রা. এর মতে জন্ম থেকে ত্রিশ মাস তথা আড়াই বৎসর বয়স পর্যন্ত শিশু বয়স । আড়াই বছরের উর্ধ্বে কোনো শিশু দুধ পান করলে দুধ সম্পর্ক সাব্যস্থ হবে না।
(দুই) ইমাম মালেক, শাফেয়ী ও হানাফী মাজহাবের ইমাম আবু ইউসূফ ও মুহাম্মাদ (রাহ.) প্রমুখের মত হচ্ছে, জন্ম থেকে দুই বৎসর পর্যন্ত শিশু বয়স। এর উর্ধ্বের কোনো শিশু দুধ পান দ্বারা দুধ সম্পর্ক স্থাপন হবে না। প্রত্যেকেই স্বপক্ষে কোরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করেছেন। আয়াতের সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বিতীয় মতটিকে সমর্থন করায় পরবর্তী ফকিহগণ এ মতটিকেই গ্রহণ করেছেন।
শিশুকে দুধ পানের সর্বোচ্ছ সীমা যেহেতু দুই বছর তাই দুই বছরের পর শিশুকে দুধ পান করানো জায়েজ হবে না। তবে বিশেষ কারণে দুধ পান করানো যেতে পারে। এবং এই সীমার বাইরে কেউ দুধ পান করলে দুধ সম্পর্ক সাব্যস্ত হবে না।
#উপরোক্ত আলোচনা থেকে কয়েকটি বিষয় সম্পষ্ঠ হলো-
১। কোন শিশুর পেটে বা মগজে জন্মদাত্রী মা ছাড়া অন্য কোন মহিলার দুধ গেলে তাতে ঐ মহিলার সাথে শিশুর দুধ সম্পর্ক স্থাপিত হবে। এ বিষয়ে সকল মাযহাবের ফকীগণ একমত।
২। হানাফী এবং মালিকী মাযহাবের ইমামগণের মতে দুধের পরিমাণ এক ফোটা হোক বা তার থেকে বেশি হোক সেটা ধর্তব্য নয়। বরং দুধের পরিমাণ কম হোক বা বেশি হোক তাতে হুরমত সাব্যস্থ হবে। অন্যান্য মাযহাবের ইমামগণ দুধের পরিমাণ নির্দিষ্ঠ করেছেন।
৩। শিশু যদি সরাসরি কোন মহিলার স্তন থেকে দুধ পান না করে, বরং তাকে ভিন্ন কোন পন্থায় তথা সিরিঞ্জ, ড্রপ বা অন্য কোন পদ্ধতিতে দুধ পান করানো হয়, বা পাকস্থলিতে অথবা মগজে পৌঁছানো হয় তাতেও এই মহিলার সাথে শিশুর দুধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হবে। এ ব্যপারে মাযহাবচতুষ্ঠয়ের জমহুর ফুকাহা একমত।
৪। দুধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হবে দুই বছর বয়সের আগে দুধ পান করলে।
#কখন দুধ-সম্পর্ক স্থাপন হবে না?
১। শিশু বয়স অতিক্রম করার পর যদি কোন বাচ্চা কোন মহিলার দুধ পান করে তাহলে দুধ সম্পর্ক স্থাপিত হবে না।
২। সন্দেহ থাকলে দুধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হবে না। অর্থাৎ কোন মহিলার দুধ পান করা হয়েছে এ নিয়ে যদি সংশয় তৈরী হয় তাহলে দুধ সম্পর্ক স্থাপন হবে না। যদি দুজন মহিলার দুধ এক পেয়ালায় রেখে শিশুকে পান করানো হয় তাহলে দুই মহিলার সাথেই দুধ সম্পর্ক স্থাপন হবে। (বেনায়াহ ৪/৩৫৭)
#হিউম্যান #মিল্ক #ব্যাংক
পশ্চিমা বিশ্বের ইউরোপ-আমেরিকায় প্রথম এই পদ্ধতি শুরু হয়েছে। যে সকল মহিলার শিশু মারা গেছে বা অন্য কোন প্রয়োজনে চাইলে এখানে দুধ জমা রাখতে পারেন। কর্তৃপক্ষ সেটা অন্য শিশুকে বিক্রি করে বা দান করে। পশ্চিমাদের অনুকরণে কোন কোন মুসলিম দেশে এরকম ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে বিশ্বের আলেমগণ এটার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফিকাহ বোর্ড ও.আই.সি’র মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী এ মাসআলা নিয়ে বৈঠকে বসেন এবং হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বা মানব দুধ ব্যাংক পদ্ধতিকে অবৈধ ঘোষনা দেন। مجلة مجمع الفقه الإسلامي، ع:٢ ،١/٤١٧ .
#এরকম ব্যাংকের কায়েকটি অসুবিধা
১। দ্বীনদারীর অভাব
এরকম ব্যাংক থেকে দুধ পান করলেও দুধ সম্পর্ক স্থাপন হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্যাংক পরিচালনায় যারা আছেন তারা আদৌ দুধ দাতা মহিলার নাম-ঠিকান লিখে দুধ আলাদা রাখবেন কি না ? তাছাড়া আমাদের সমাজে যে সকল অভিভাবক শিশুর জন্য সেখান থেকে দুধ আনবেন তারা দুধ দাতা মহিলার খোঁজ করবেন কি না? সেটাও বিবেচনার বিষয়।
২। আল-লাবান আল মুখাল্লাত
এরকম ব্যাংকে এক মহিলার দুধের সাথে অন্য মহিলার দুধের মিশ্রণ থাকার সম্ভাবনা বেশি। মিশ্রিত দুধ পান করলে উভয় মহিলার সাথে হুরমতে রেদ্বাআত সাব্যস্থ হবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিবে মহিলা নির্দিষ্ঠ করতে। যদি দুধ প্যাকেটজাত বা বোতলজাত করার পর তাতে মহিলার ঠিকানা লেখা না থাকে তাহলে কোন মহিলার সাথে হুরমত সাব্যস্থ হবে এ নিয়ে দ্বিধা-সংশয়ে থাকতে হবে। এখন যদি কেহ সন্দেহের মাসআলার উপর মিশ্রিত দুধের মাসআলা কিয়াস করতে চান তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়, ইচ্ছাকৃতভাবে শরীআতের কোন মাসআলায় সন্দেহ তৈরী করা জায়য আছে কি?
৩। দুধ সম্পর্কের দ্বারা ইসলামী শরীয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে এ রকম আত্মীয়তার সম্পর্ককে হেফাজত করা। দুধ ব্যাংক থেকে দুধ পান করানো হলে সেটা হেফাযত থাকা কঠিন।
#দুধ ব্যাংকের বিষয়ে কয়েকটি দিক আলোচনা করলে যথেষ্ঠ হবে।
১। শিশু বয়সে একজন বাচ্চা যে কোন মহিলার দুধ পান করলে দুধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হবে। সেটা মহিলার স্তন থেকে সরাসরি দুধ পান করলেও হবে বা বাটি-পেয়ালায় নিয়ে মুখে বা গলায় ঢেলে দিলেও হবে অথবা ড্রপ, সিরিঞ্জ দিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছে দিলেও হবে। দুধ ব্যাংক থেকে নিয়ে দুধ পান করালেও দুধ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হবে। যেহেতু শিশু বয়সে কারো দুধ পেটে গেলে মাতৃ-সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
২। দুই বা ততোধিক মহিলার মিশ্রত দুধ পান করালে সকলের সাথেই দুধ সম্পর্ক তৈরী হবে। যেহেতু ইসলামী ফিকহের নিয়ম অনুযায়ী কয়েক মহিলার দুধ একত্রে পান করলেও সকলের সাথে দুধ সম্পর্ক তৈরী হবে।
৩। কোন মহিলার দুধ পান করেছে সেটা যদি জানা না থাকে অথবা জানার কোন মাধ্যম না থাকে তাহলে দুধ সম্পর্ক স্থাপন হবে না। কিন্তু মিল্ক ব্যাংক এর ক্ষেত্রে এ মাসআলা প্রজোয্য নয়। কেননা সেখানে দুধ দাতা মহিলাকে সনাক্ত করে তার দুধ পৃথক রাখা সম্ভব। তাই যারা সন্দেহের মাসআলার উপর কিয়াস করে দুধ ব্যাংক থেকে দুধ পান করালে হুরমত সাব্যস্থ হবে না বলছেন তাদের যুক্তি সঠিক নয়।
৪। বাজারে শিশুর জন্য বিকল্প দুধের ব্যবস্থা আছে। যা শিশুরা জন্মের পর থেকে পরিমিত বয়স পর্যন্ত পান করতে পারে। সেখানে মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা এতে বংশীয় পবিত্রতা নষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
৫। সর্বোপরি, একটি বিষয় যখন হালাল এবং হারামের মধ্যখানে অবস্থান করে তখন সে বিষয়টি পরিত্যাগ করাই উত্তম।
বিষয়টি নিয়ে উলামায়ে কিরামের গবেষণামূলক সিদ্ধান্ত সময়ের দাবী। আর যেহেতু বিষয়টি ইসলামী শরীআতের সাথে সম্পর্কিত তাই উলামায়ে কিরামের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে মিল্ক ব্যাংকের সাথে সর্বপ্রকার সম্পর্ক থেকে দূরে থাকা জরুরী। এ বিষয়ে যারা বিস্তারিত জানতে চান তারা কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধ পড়তে পারন-
১। الرضاع المحرم في الفقه الإسلامي
২। الرضاع وبنوك الحليب لإبراهيم الحفناوي
৩। مجلة مجمع الفقه الإسلامي، ع:٢ ،١/٤١٧