আ’মল

মহিলাদের চেহারা : পর্দার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক

মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান

পর্দা ইসলামের গুরুতত্বপূর্ণ একটি বিধান। কুরআন এবং হাদীসে পর্দা রক্ষার প্রতি জোর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি ইলমুল ফিকহে পর্দাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত আলোচনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে মুসলমানদের কারো কাছেই দ্বিমত নেই যে, পর্দা করা ফরয। পর্দার ক্ষেত্রে পুরুষদের জন্য নাভী হতে হাটু পর্যন্ত ঢেকে রাখা ফরয। মহিলারা তাদের গোটা শরীর ঢেকে রাখবে। মহিলাদের শরীরের সবটুকুই হাদীসের ভাষায় ‘আওরাহ’ বা পর্দা। এটাই চার মাযহাবের পরবর্তী ফকীহগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। এটা বললে হয়ত কোন অতুক্তি হবে না যে, ফিতনার আশংকায় মহিলাদের মাথার চুল থেকে নিয়ে পায়ের নিচ পর্যন্ত গোটা শরীর পর্দার অন্তর্ভূক্ত হওয়ার বিষয়ে চার মাযহাবের মুতাআখখিরীন ফকীহগণ একমত। তবে এ বিষয়ে পূর্বসূরী কিছু কিছু ফকীহগণের ভিন্নমতও পাওয়া যায়। তাদের অনেকে মহিলাদের হাত এবং চেহারাকে পর্দার অন্তভূক্ত করেন নি। কিছু শর্ত সাপেক্ষে চেহারা এবং হাত খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের এ ভিন্নমতে শ্রদ্ধা রেখে যুগ এবং বাস্তবতার চাহিদায় পরবর্তী ফকীহগণ পর্দার ব্যাপারে কঠোরতা আরোপ করেছেন। এখানে আমরা শুধুমাত্র মহিলাদের চেহারার পর্দার বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে কুরআন, হাদীস এবং ফকীহগণের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করব।

কুরআন কারীমের নির্দেশনা
এক. আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ. وَكَانَ اللَّـهُ غَفُورًا رَّحِيمًا
অর্থ: হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আহযাব : ৫৯)

এ আয়াতে মহিলাদেরকে ‘জিলবাব’ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। ‘জিলবাব’ বলা হয় এমন প্রশস্ত কাপড়কে যা মাথায় রাখা হয়। নিচের দিকে ছেড়ে দিলে তা মুখমন্ডলকে আবৃত করে। ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন, ‘জিলবাব’ বলা হয় মাথার এমন কাপড়কে যা পুরো শরীরকে আবৃত করে। এ আয়াতকে দলীল উপস্থাপন করে অধিকাংশ মুফাসসির বলেন, আয়াতে চেহারা আবৃত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন,
” أمر الله نساء المؤمنين إذا خرجن من بيوتهن في حاجة أن يغطين وجوههن من فوق رؤوسهن بالجلابيب ويبدين عيناً واحدة

অর্থ: আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে ওড়না/চাদর টেনে স্বীয় মুখমন্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে।-(ফাতহুল বারী ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪, তাফসীর ইবনু কাসীর)

ইমাম ইবনু সীরীন বলেন, আমি (বিখ্যাত তাবেয়ী) উবাইদা আস সালমানীকে উক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, কাপড় দ্বারা মাথা ও চেহারা আবৃত করবে এবং এক চোখ খোলা রাখবে। ইমাম নাসাফী (র.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তারা চাদর তাদের উপর টেনে দিবে, যাতে ইহা দ্বারা তারা তাদের চেহারা আবৃত করে। (মাদারিকুত তানযীল, ৩/৭৯)

আয়াতের সারাংশ: অধিকাংশ মুফাসসিররের মতে উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা নারীদেরকে চেহারা ঢেকে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

দুই. আল্লাহ তাআলার বাণী-
وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ
অর্থ : এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে। (সূরা নূর : ৩১)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী (র.) স্বীয় বুখারী শরীফের কিতাবুত তাফসীরে একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন,
يرحم الله نساء المهاجرات الأول، لما أنزل الله : وليضربن بخمرهن على جيوبهن شققن مورطهن فاختمرن بها.

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা প্রথম শ্রেণীর মুহাজির নারীদের প্রতি দয়া করুন। কেননা আল্লাহ তাআলা যখন وليضربن بخمرهن على جيوبهن
আয়াত নাযিল করলেন তখন তারা নিজেদের চাদর ছিঁড়ে তা দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করেছিলেন।-(সহীহ বুখারী ২/৭০০)
হযরত আয়শা সিদ্দীকা রা. এর হাদীস থেকে জানা গেল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই মুসলিম রমনীগণ চাদর ছিড়ে ছিড়ে নিজেদের পর্দা করতেন। হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী র. এ হাদীসের বক্তব্যকে আরো স্পষ্ঠ করেছেন এভাবে,‘ফাখতামারনা’ (তারা আবৃত করতেন) এর অর্থ হলো- তারা মুখমন্ডল আবৃত করেছেন।-(ফাতহুল বারী ৮/৩৫৭) ইমাম বদরুদ্দীন আইনী হানাফী (র.)ও ‘ফাখতামারনা বিহা’ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যে চাদর তারা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তা দিয়ে নিজেদের মুখমন্ডল আবৃত করলেন। (উমদাতুল কারী ১৯/৯২)

আয়াতের সারাংশ : এ আয়াতের ব্যাখ্যা থেকে জানা গেল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেই মুসলিম নারীগণ তাদের চেহারা ঢেকে রাখতেন।

হাদীস শরীফের নির্দেশনা
এক. বুখারী শরীফে কিতাবুত তাফসীরে ইফকের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। এ দীর্ঘ হাদীসের একটি অংশ হলো, হযরত আয়শা রা. বলেন-
وكان صفوان بن المعطل السلمي ثم الذكواني من وراء الجيش فأدلج فأصبح عند منزلي فرأى سواد إنسان نائم فأتاني فعرفني حين رآني ، وكان يراني قبل الحجاب فاستيقظت باسترجاعه حين عرفني فخمرت وجهي بجلبابي.

অর্থ : …. সফওয়ান ইবনে মুয়াত্তাল আসসুলামী ছিলেন বাহিনীর পিছনে আগমনকারী। তিনি যখন আমার অবস্থানস্থলের নিকট পৌছলেন তখন একজন ঘুমন্ত মানুষের আকৃতি দেখতে পেলন। এরপর তিনি আমার নিকট এলে আমাকে চিনে ফেললেন। কারণ পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। তিনি তখন ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলে ওঠেন, যার দরুণ আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি এবং ওড়না দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি। (বুখারী, হাদীস নং-৪৫৬৫)

হাদীসাংশের সারাংশ : হযরত আয়শা সিদ্দীকা রা. এর বর্ণনা থেকে বুঝা গেল পর্দার বিধান নাযিলের পূর্বে মহিলাগণ চেহারা খোলা রাখার অবকাশ ছিল। কিন্তু পর্দার বিধান নাযিলের পর তারা চেহারা ঢেকে রাখতেন।

দুই. হযরত আসমা বিনতে আবি বাকর রা. বলেন- كُنَّا نُغَطِّيَ وُجُوهَنَا مِنَ الرِّجَالِ
অর্থ :, আমরা পুরুষদের সামনে মুখমন্ডল আবৃত করে রাখতাম। …-(মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪৫৪) হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ।

তিন. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا تنتقب المرأة المحرمة ولا تلبس القفازين
অর্থ : ইহরাম গ্রহণকারী নারী যেন নেকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৮৩৮)

এ হাদীস থেকে বুঝা যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়েও মহিলাদের নেকাব পড়ার বিধান ছিল। ইহরাম অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগুলো পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। আবার হযরত আয়শা রা. এর হাদীসে পাওয়া যায়, মহিলা সাহাবীগণ প্রয়োজনের তাকীদে ইহরাম অবস্থায়ও চেহারা ঢেকে রেখেছেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়শা সিদ্দীকা রা. বলেন-
كان الركبان يمرون بنا ونحن محرمات مع الرسول صلى الله عليه وسلم فإذا حاذونا سدلت إحدانا جلبابها على وجهها من رأسها فإذا جوزنا كشفنا

অর্থ : আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম তখন আমাদের পাশ দিয়ে অনেক কাফেলা অতিক্রম করত। তারা যখন আমাদের সামনাসামনি চলে আসত তখন আমাদের সকলেই চেহারার ওপর জিলবাব টেনে দিতাম। তারা চলে গেলে আবার তা সরিয়ে নিতাম। (মুসনাদে আহমাদ ৬/৩০; ইবনে মাজাহ,হাদীস: ২৯৩৫)

মালিকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী বলেন, নারীর জন্য বোরকা দ্বারা মুখমন্ডল আবৃত রাখা ফরয। তবে হজ্বের সময়টুকু এর ব্যতিক্রম। কেননা, এই সময় তারা ওড়নাটা চেহারার উপর ঝুলিয়ে দিবে, চেহারার সাথে মিলিয়ে রাখবে না। পরপুরুষ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবে এবং পুরুষরাও তাদের থেকে দূরে থাকবে। (আরিদ্বাতুল আহওয়াযী ৪/৫৬)

সারকথা : উপরোক্ত হাদীসগুলো বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় পরিষ্কার হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেও মহিলা সাহাবীগণ পর পুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখতেন না। তারা তাদের চেহারা ঢেকে রাখতেন।

ফকীহগণের দৃষ্টিতে চেহারার পর্দা
মহিলাদের চেহারা আবৃত করা আবশ্যক হওয়া সম্পর্কে চার মাযহাবের মুতাকাদ্দিমীন কিছু ফকীহগণের ভিন্নমত পাওয়া যায়।

মুতাআখখিরীন ফকীহগণ যুগের ফিতনা এবং বাস্তবতার চাহিদায় মহিলাদের চেহারাকে পর্দার অন্তর্ভুক্ত বলেছেন এবং পর পুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখাকে আবশ্যক বলেছেন। ফকীহগণের এ সিদ্ধান্তের অনুকূলে রয়েছে কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কিরামের আছারের যথেষ্ঠ দলীল। নিচে আমরা চার মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিছু ফকীহগণের মতামত উল্লেখ করছি।

হানাফী মাযহাব
হানাফী মাযহাবের পরবর্তী ফকীহগণের নির্ভরযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য ফতওয়া হলো যুবতী মহিলাদের চেহারা আবৃত করা আবশ্যক। একজন মহিলার জন্যে গায়র মাহরাম পুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখা জায়য নেই। ইমাম ইবনু আবিদীন শামী (র.) উলামায়ে আহনাফের গ্রহণযোগ্য মত উল্লেখ করে বলেন,
ونقل عن علماء الحنفيّة وجوب ستر المرأة وجهها، وهي محرمة، إذا كانت بحضرة رجـال أجانب

অর্থ: হানাফী উলামায়ে কিরাম থেকে বর্ণিত আছে যে, মহিলাদের চেহারা আবৃত করা আবশ্যক। গায়র মাহরাম পুরুষদের উপস্থিতিতে তার চেহারা খোলা রাখা হারাম। (ফতওয়ায়ে শামী, ২/৫২৮)

হানাফী মাযহাবের অধিকাংশ ফকীহ’র সিদ্ধান্ত হলো, যুবতী মহিলা গায়র মাহরাম পুরুষের সামনে চেহারা আবৃত রাখবে। কাযীখানের ফতওয়া হলো, মহিলা পর-পুরুষের সামনে চেহারা খোলা রাখবে না। (আন নাহরুল ফায়িক, ২/৯৮ ইমাম আহমদ ইবনু মুহাম্মদ তাহতাবী (র.) বলেন- تمنع المرأة الشابَّة من كشف الوجه بين رجال অর্থ: যুবতী মহিলাদের (গায়র মাহরাম) পুরুষদের সামনে চেহারা খোলা রাখা নিষেধ। (শরহে তাহতাবী, পৃষ্টা নং-১৩১)

ইমাম ইবনু নুজায়ম বলেন, আমাদের (হানাফী)উলামায়ে কিরাম বলেন, ফিতনার আশংকায় এ যুগে মহিলাগণ পুরুষদের সামনে চেহারা খোলা রেখে বের হওয়া নিষেধ। (বাহরুর রায়েক, ১/২৮৪) ইমাম আবূ বকর আল জাসসাস (র.) বলেন, ‘যুবতী মহিলা গায়র মাহরাম পুরুষের সামনে বের হওয়ার জন্য চেহারা আবৃত রাখার সাথে আদিষ্ঠ’। (আহকামুল কুরআন, ৩/৪৫৮) আল্লামা ইবনু আবিদীন শামী তাঁর নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপন করে বলেন, মহিলাগণ চেহারা খোলা রাখা নিষেধ। কেননা পুরুষগণ চেহারা দেখে ফিতনায় পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। (হাশিয়ায়ে ইবনু আবিদীন, ৩/২৬১)
আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমিরী র. বলেন, ফিতনার আশংকায় আমাদের ঐক্যমত হলো মহিলাদের চেহারা পর্দার অন্তর্ভূক্ত এবং তা পর্দা করা আবশ্যক। (ফয়দ্বুল বারী, ১/২৫৪)

মালিকী মাযহাব
ইমাম মালিক র. তার ‘আল মুআত্তা’ কিতাবে বর্ণনা করেন, ফাতিমা বিনতে মুনযির বলেন,
كنا نُخمّر وجوهنا ونحن محرمات ، ونحن مع أسماء بنت أبي بكر الصديق
আমরা ইহরাম অবস্থায়ও আমাদেও চেহারা ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখতাম, আমরা তখন হযরত আসমা বিনতে আবি বাকর রা. এর সাথে ছিলাম। ইমাম যুরকানী শরহে মুআত্তায় লিখেন, এ হাদীস বর্ণনা করার পর ইমাম মালিক কোন ভিন্নমত করেন নি। কেননা তার কাছে ইহরাম অবস্থায়ও একজন মহিলা পর পুরুষদের চোখ থেকে পর্দা করার উদ্দেশ্যে চেহারা চেহারা ঢাকা বৈধ। (শরহুয যুরকানী, ২/২৩৪)

মালিকী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আবূ বাকর ইবনুল আরাবী বলেন, মহিলাদের সমস্ত শরীরই পর্দা এমনকি তার গলার আওয়াজও পর্দার অন্তর্ভূক্ত। সাক্ষ্য দেওয়া বা চিকিৎসা করানোর মতো একান্ত প্রয়োজন না হলে শরীরের কোন অংশ অনাবৃত করা বৈধ নয়। (আহকামুল কুরআন, ৩/৬১৬) ইমাম কুরতুবী বলেন, শরীআত একজন মহিলার শরীরের সকল অংশকেই পর্দা হিসাবে গণ্য করে। সাক্ষ্য প্রদান বা এজাতীয় জরুরী প্রয়োজন ছাড়া পর্দা খোলা বৈধ নয়। (আল জামে‘ লি আহকামিল কুরআন, ১৪/২২৬) ইবনু মারযূক আল মালিকী বলেন- আমাদের প্রসিদ্ধ রায় হলো মহিলাদের হাত এবং চেহারা আবৃত করা ওয়াজিব। (জাওয়াহিরুল ইকলীল, ১/৪১)

শাফেঈ মাযহাব
শাফেঈ মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আবুল মাআলি আল জুয়াইনী (মৃ.৪৭৮ হি.) বলেন, মুসলমানদের ঐক্যমত্যেও ভিত্তিতে নেকাব তথা চেহারার পর্দা ছাড়া বাহিরে যাওয়া নিষেধ। (নিহায়াতুল মাতলাব, ১২/৩১) ইমাম বায়যাবী বলেন, স্বাধীনা মহিলার গোটা শরীর পর্দার অন্তর্ভূক্ত। মুহরিম এবং স্বামী ছাড়া অন্য কারো জন্যে মহিলার দিকে তাকানো বৈধ নয়, তবে চিকিৎসা বা সাক্ষ্যদান ছাড়া। (তাফসীরে বায়যাবী, ৪/১০৪) যিয়াদী বলেন, পর পরুষের সামনে একজন মহিলার সমস্ত শরীর পর্দা, এমনকি হাত এবং চেহারাও। এ বক্তব্য সমর্থন করেছেন ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী। (তুহফাতুল মুহতাজ, ২/১১২) ইমাম নববী র. বলেন, একজন মুসলিম মহিলার জন্য ইয়াহুদী বা নাসারা বা অন্য কাফির মহিলার সামনেও চেহারা খোলা রাখা বৈধ নয়। এটাই শাফেঈ মাযহাবের বিশুদ্ধ মত। (আল ফাতাওয়া, পৃ. ১৯২) এ ছাড়াও ইমাম সুবুকী ‘নিহায়াতুল মুহতাজ’ কিতাবের ৬/১৮৭ পৃষ্ঠায়ম ইমাম সুয়ূতী তার তাফসীরে মহিলাদের চেহারাকে পর্দার অন্তর্ভূক্ত বলেছেন।

হাম্বলী মাযহাব
ইবনু রজব হাম্বলী বলেন, পর্দার বিধান নাযিলের পূর্বে মহিলাগণ জিলবাব ছাড়া বের হতেন। মহিলাদের হাত এবং চেহারা দেখা যেত। অতপর মহিলাগণকে তাদের চেহারা এবং হাত ঢেকে রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো। তবে এ নির্দেশ শুধু স্বাধীনা মহিলার ক্ষেত্রে, দাসীগণ এর অন্তর্ভূক্ত নয়। (ফতহুল বারী, ২/১৩৮) আল্লামা মানসূর বাহুতী বলেন, স্বাধীনা মহিলার হাতের দুই তালু, চেহারা নামাযের বাহিরে পর্দার অন্তর্ভূক্ত। (কাশশাফ, ১/২৬৬)

চার মাযহাবের অধিকাংশ আলেমের মতে মহিলাদের চেহারা পর্দার অন্তর্ভূক্ত। পরবর্তী যুগের কোন আলেম এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন নি। সে হিসাবে এ মাসআলায় পরবর্তী যুগের সকল আলেমের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সামান্য সংখ্যক আলেম এ বিষয়ে দ্বিমত করেছেন। উসূলে ফিকহ’র নিয়ম অনুযায়ী জমহুরের সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণকারী কিছু আলেম থাকলেও সেটা ধর্তব্য নয়। সর্বোপরি ফকীহগণ চেহারা আবৃত করা আবশ্যক হওয়ার জন্য যে ইল্লত পেশ করেছেন তা কোন আলেমই অস্বীকার করতে পারবেন না। এ ইল্লত (ফিতনা) ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই কুরআন সুন্নাহর চিন্তাবিদ ফকীহগণ পর পুরুষের সামনে মহিলাদের চেহারা আবৃত রাখার উপর একমত। এর বিরুধিতা করার অর্থ হলো সমাজে ফিতনা বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি কওে দেওয়া। আল্লাহ আমাদের সকলকে বুঝার তাওফিক দান করুন।

Related Articles