শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)। আমার বাবা। বাবার জীবন ছিল এক বিশাল সংগঠন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ পিতা। সংসার ও সমাজ জীবনে একজন দক্ষ অভিভাবক। ইনসাফের ক্ষেত্রে একজন ন্যায়পরায়ণ মুন্সিফ (আদিল)। আধ্যাত্মিকতায় এ যুগের শ্রেষ্ঠ ওলী। রাজনীতিতে দেশের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ। শিক্ষকতায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। লেখক হিসেবে একজন কবি, একজন সাহিত্যিক, একজন গবেষক, একজন দার্শনিক ও বিশ্লেষক। তিনি ছিলেন ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রত্যয়ী ব্যক্তিত্ব। আচার আচরণে অত্যন্ত বিনয়ী। ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জিহাদের ময়দানে সিপাহসালার। দুনিয়ার সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে অন্যায়, অনাচার, যুলুম, নির্যাতন, ভ্রষ্টাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে জিহাদ করে গেছেন সারা জীবন। কোন অশুভ শক্তির সামনে কোন দিন মাথা নত করেননি।
বাবা নামটি অতি প্রিয় যাহা বুঝেছিলাম তাঁহার ইন্তেকালের পর। বাবাকে কদমে ধরিয়া যখন কবরে রাখিলাম তখন মনে হইল এই পৃথিবীতে যত মায়া, যত আদর সব আজ দাফন হইতে যাচ্ছে। তখন বাবা বাবা বলে বুক ফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়িয়াছিলাম। বাবার কফিন বাড়িতে আসিলে লক্ষ লক্ষ মানুষ কান্নায় ভেঙ্গে পড়িল, সেই সাথে বালাই হাওরও। মাটির মানুষকে আবার মাটিতে রাখা হইল। প্রবাসে (ইংল্যান্ডে) থাকিয়া আমার বড় মেয়ে হুমায়রা ছিদ্দিকা একটি চিঠিতে আমাকে উদ্দেশ্য করিয়া কথা প্রসঙ্গে লিখিয়াছিল, “পৃথিবীতে অনেক বাবা দেখিয়াছি, আমার বাবার মতো কোন বাবা দেখি নাই।” আমিও আজ বলিতে চাহি, ‘‘পৃথিবীতে আমার বাবার মতো কোন বাবা দেখি নাই।’’
নিজের সন্তানদের প্রতি সকল মানুষের স্নেহ মমতা সবচেয়ে বেশি থাকে। আমার বাবা আমাদিগকে তাঁর চেয়েও বেশি স্নেহ করিতেন। আমি যখন ছোট তখন আমরা আমাদের পুরাতন বাড়িতে ছিলাম। বর্তমানে যে বাড়িতে আছি এর পূর্ব দিকে আমাদের পুরাতন বাড়ি। সেই বাড়ির সামনে বাংলা ঘর পরেই একটি বড় পুকুর ছিল। বাবা অনেক সময় বাড়িতে থাকিতেন না, কোথায় থাকিতেন তাহা বুঝিতাম না। যখন বাড়িতে আসিতেন, তখন আমাদেরকে পুকুর ঘাটে নিয়া গোসল করাইতেন ও সাঁতার শিখাইতেন। কোলে করিয়া পানিতে নামাইয়া হাতের উপর রাখিয়া সাঁতার কাটিতে বলিতেন। কোন সময় হাত হইতে ফসকিয়া গেলে ডুবিয়া যাওয়ার ভয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাইতাম, তখন পুনরায় কোলে উঠাইয়া নিতেন। সাঁতার শিখিতে গিয়া যখন বাবার চেহারার দিকে তাকাইতাম, তখন তাহাকে বাদশাহর মত মনে হইত। খাবার সময় বাবা নিজ হাতে আমাদের মুখে খাবার তুলিয়া দিতেন। সেই খাবারের স্বাদ আর কোন দিন কোথাও পাই নাই। ঈদের সময় আমাদের যে সমস্ত জামা কাপড় দিতেন তাহা আমাদের গ্রামের অন্যান্য ছেলেদের কাপড়ের তুলনায় অনেক উন্নত মানের হইত। ফলে আমরা বাড়ির বাহিরে গেলে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি কাপড়ে হাত দিয়া দেখিতেন।
আমি কিছু বড় হওয়ার পর বাবার দৈনন্দিন জীবনের কিছু বিষয় দেখিয়াছি। অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। তখনকার সময়ে রমদানের ঈদ, কুরবানীর ঈদ, শবে বরাত, মুহররম, রবিউল আউয়াল ইত্যাদি দিনগুলো মুসলিম সমাজে বৎসরের উল্লেখযোগ্য দিন হিসেবে বিবেচিত হইত। কুরবানির ঈদের সময় বাবা নিজ হাতে গরু জবাই করিতেন। নিজে বসিয়া থাকিয়া মিসকীনদের গোশত বিতরণ করিতেন। কুরবানীর গোশতের আমাদের অংশ হইতে একটা অংশ পৃথক করিয়া নিজ হাতে ভাগ করিয়া আশপাশ গ্রামের বয়স্ক ও সম্পর্কিত ব্যক্তিদের বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিতেন। আমাদের এখানে সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা কাহারো বাড়িতে কুরবানীর গোশত নিতে আসিতেন না। তখন তাহাদের বাড়িতে গোশত পৌঁছাইয়া দেওয়ার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দিতেন।
তখনকার সময়ে বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জায়গা হইতে চিতল, বোয়াল, রুই, কাতলা, আইড়, রিটা ইত্যাদি মাছ নিয়া মেহমানরা আমাদের বাড়িতে আসিতেন। এই মাছ কাটার পর মাছের একটি বড় অংশ আলাদা করিয়া প্রতিবেশী গ্রামের বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষের জন্য ভাগ করিয়া রাখিতেন এবং আমাদেরকে পৌঁছাইয়া দিতে হুকুম দিতেন। এলাকার বয়স্ক ও মুমূর্ষু রোগীদের হাল পূর্ছির জন্য দেখা করিতে যাইতেন এবং সাথে কিছু খাবার নিতেন। অনেক সময় আশপাশ গ্রামে মুমূর্ষু রোগীদের দেখিতে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতেন যে, আপনি কী খাইতে চান? তখন কেহ কেহ বিভিন্ন ফল খাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করিতেন । তখন ঐ ফলের মওসুম না হইলেও বাবা যে কোন উপায়ে, এমনকি দেশে না থাকিলেও পার্শ্ববর্তী দেশ হিন্দুস্থান হইতে সেই ফল সংগ্রহ করিয়া রোগীর আশা পূর্ণ করিতেন। তখনকার দিনে আঙ্গুর, আপেল, কিছমিছ, মনাক্কা, আম, আনারস ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণ ফলফ্রুট নিয়া মেহমানরা আমাদের বাড়িতে আসিতেন। এই সমস্ত ফলের একটা অংশ বয়স্ক প্রতিবেশী ও রোগীদের জন্য পাঠাইয়া দিতেন। আমাদের বাড়িতে যে সমস্ত মেহমান আসিতেন তাহারা বিভিন্ন ধরনের খাবার (হাদিয়া) নিয়া আসিতেন। এইগুলা ভাগ করিতে গিয়া কোন কোন সময় বলিতেন সকলে মিলিয়া ভাগ করিয়া খাইও, কাহার কিসমতে আসিয়াছে কেহ বলিতে পারিবে না।
রান্না-বান্নার ব্যাপারে বাবা অত্যন্ত অভিজ্ঞ ছিলেন। আমাদের বাড়ির মেহমানখানায় সবসময় গরু বকরী ইত্যাদি পাক করা হয়। পাক করা খাদ্যের ঘ্রাণ নিয়া বলিয়া দিতেন কোন মসলা কতটুকু কম বেশি হইয়াছে এবং সঠিকভাবে সিদ্ধ হইয়াছে কি না। রমদ্বান শরীফে দারুল কিরাতের ছাত্র ও মেহমানদের ইফতার অনেক সময় নিজেই পাক করিতেন এবং নিজ হাতে ভাগ করিয়া দিতেন। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে বর্তমান মাদরাসার সামনে ছোট্ট একটি বাজার ছিল। প্রতি রবি ও বুধবারে সেই বাজার বসিত। রমদান শরীফে ইফতার প্রস্তুত হওয়ার পর ঐ বাজারে লোক পাঠাইয়া ইফতারের দাওয়াত দিতেন। তাছাড়া প্রতি বৎসর রমদান মাসে আশ-পাশ গ্রামের মুরব্বিয়ানদের দাওয়াত করিয়া এক সাথে একদিন ইফতার করিতেন। বাড়ির কোন লোক অথবা কোন কাজের লোককে বাহিরে কোথাও পাঠাইলে এবং রাত্রে ফেরার কথা থাকিলে ইশার পর তাহার জন্য অপেক্ষা করিতে থাকিতেন এবং গভীর রাত্রে বাড়িতে ফেরার পর প্রথমে জিজ্ঞাসা করিতেন যে, তোমার কোন অসুবিধা হইয়াছে কি-না এবং খাওয়া দাওয়া করা হইয়াছে কি-না।
মেহমানদারীর ব্যাপারে বাবা সব সময় অত্যন্ত আন্তরিক খেয়াল রাখিতেন। বাড়িতে অনেক মেহমান মুসাফির আসিতেন। খাওয়ার সময় হইলে যথাসম্ভব মেহমানদের নিয়া এক সাথে খাওয়া দাওয়া করিতেন। বাংলা ঘরে যে সকল মেহমান বিশ্রাম নিতেন বাবা বিশ্রামে যাওয়ার আগে তাহাদের খোঁজ খবর নিতেন এবং অনেক সময় নিজে আসিয়া তাহাদের বিছানাপত্র কিভাবে দেয়া হইয়াছে তাহা দেখিতেন। শীতের দিনে বাবার কাছে একটি লেপ ও একটি কম্বল থাকিত, যাহা শীত নিবারনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। অনেক সময় মেহমানদের জন্য তাহার সেই কম্বলটিও দিয়া দিতেন।
বিশেষ কোন মেহমানের খাবার ব্যাপারে বাবার আলাদা একটি রুচিবোধ ছিল। কুমড়ার মিঠা, বিরইন ভাত, নারিকেলের মিঠা, দুধ ও গুড় থাকিতেই হইবে। তিনি নিজে সব সময় চৌকির উপর দস্তরখান বিছাইয়া খাওয়া দাওয়া করিতেন।
বাবা সারা জীবন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়াও সমাজ, রাষ্ট্র ও পারিবারিক ক্ষেত্রে বিপদগ্রস্থ মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়াইয়া দিয়াছেন। মানুষের বিপদ আপদে তাহার কোমল হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হইত। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করিতেছি-
আমাদের হাওরে দলিয়া ও ছাবরা নামে ২টি বিল আছে। ১৯৮৬ ইং সনে বৈশাখ মাসের মাঝরাতে ভীষণ ঝড় বৃষ্টি হয়। ঐ সময় উল্লেখিত বিলের ইজারাদারের পক্ষে বিলে ২জন পাহারাদার ছিলেন। বিলের ইজারাদার ফুলতলী গ্রামের ইয়াছিন আলী মেম্বার সাহেব ঝড়ের পর পাহারাদারদের খুঁজে বাহির হইয়া ছাহেব বাড়ির বাংলার সামনের পথ দিয়া যাইতেছিলেন। তখন গভীর রাত। হঠাৎ সামনে দেখিলেন, লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা অবস্থায় একজন লোক হাঁটিতেছেন। কাছে গিয়া দেখিলেন তিনি আর কেহ নন, আমার বাবা। ইয়াছিন মিয়া হতভম্ব হইয়া ছাহেব কিবলাহকে সালাম কদমবুছি করিলে তিনি বলিলেন, তুমি এত রাত্রে কোথায় যাইতেছ? তিনি তাহার বিলের পাহাদারদের খুঁজে যাইতেছেন বলিয়া জানাইলেন। ছাহেব কিবলাহ বলিলেন, ইনশাআল্লাহ তাহাদের কোন অসুবিধা হইবে না। তখন ইয়াছিন মিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, ছাহেব এত রাত্রে এখানে, কী ব্যাপার। উত্তরে বলিলেন, ভারী তুফান হইয়াছে। এলাকায় কোন মানুষ বিপদে পড়িয়াছে কি-না চিন্তা করিতেছি।
এলাকায় কোন রাস্তা-ঘাট ও বাড়ি বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে কেহ ভ‚মি চাহিলে তাহা দিয়া দিতেন। বিশেষত রাস্তা ঘাটের ব্যাপারে আমাদের বলিতেন, কেহ জমি চাহিলে তাহা বিনামূল্যে দিয়া দিও।
প্রতিবেশির প্রতি আন্তরিকতার দৃষ্টান্ত হিসাবে একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করিতেছি। বাবা সবসময় এলাকায় যে কোন অন্যায়, অনাচার, যুলুম, নির্যাতন, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি দমনে অত্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন। আগেকার দিনে আমাদের এখানে কোন কোন সময় চুরির ঘটনা ঘটিলেও ডাকাত বা ডাকাতি সম্পর্কে মানুষের তেমন ধারনা ছিল না। একবার ১৯৭৪ ইং সনে আমাদের গ্রামের পূর্ব সীমানায় রাত্রে গুলির শব্দ শুনা গেল এবং লোকজন চিৎকার করিতেছিল। বাবা বাড়িতে ছিলেন। যখন জানিতে পারিলেন যে গ্রামের পূর্ব দিকে একটি বাড়িতে ডাকাত হানা দিয়াছে (আমাদের বাড়ি গ্রামের পশ্চিম দিকে) তখন লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা অবস্থায় সুপারী খাওয়ার কুটনী নিয়া গ্রামের পূর্ব দিকে দ্রুত চলিলেন। যখন ঐ বাড়ির কাছে পৌঁছিলেন তখন ডাকাতরা পূর্ব দিকের মাঠ দিয়া পালাইয়া যাইতেছিল। বাবা তাহাদের ধাওয়া করিলেন, তখন কে একজন লোক বলিলেন ছাব, তাহাদের সাথে বন্দুক আছে, তাহারা গুলি করিবে। তিনি বলিলেন, ওরা ডাকাত, আর আমরা মালিক, ভয় পাওয়ার কিছুই নাই। এর পরপরই ডাকাতরা পালাইয়া যায়।
আমাদের এলাকায় কার্তিক মাসে অভাব (নিদান) দেখা দিত। তখন প্রতিবেশি গ্রামের অনেক মানুষের গোলায় ধান থাকিত না। ফলে মানুষের খুব কষ্ট হইত। তখন বাবা প্রতি বৎসর কার্তিক মাস আসিলে আমাদের জিজ্ঞাসা করিতেন, এলাকার মানুষের ঘরে ধান আছে কি না? আমরা যখন বলিতাম এলাকায় অভাব অনটন দেখা দিয়াছে। তখন আমাদের হুকুম দিতেন আমার গোলায় (উগারে) যে ধান আছে এক মাসের খাওয়ার পরিমাণ রাখিয়া বাকি সমস্ত ধান্য যাহাদের প্রয়োজন তাহাদের দিয়া দাও। তখন আমরা আশপাশ গ্রামের লোকদেরকে ধান কর্জ দেয়া হইবে এই মর্মে অবগত করিতাম। তখন বিভিন্ন গ্রাম হইতে লোকজন ভার (প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র) নিয়া আসিত এবং নতুন ফসল পাওয়ার আগ পর্যন্ত যাহাদের প্রয়োজন তাহাদিগকে যার যার চাহিদা মুতাবিক ধান কর্জ দেয়া হইত। অগ্রহায়ণ মাসের ফসল পাওয়ার পর সকলে এই ধান বাড়িতে আনিয়া দিয়া যাইতো। কোন কোন বৎসর পোকার আক্রমণে ক্ষেত নষ্ট হইয়া গেলে কর্জকারীদের ইচ্ছার উপর ছাড়িয়া দেয়া হইত।
প্রতিবেশী গরীব দুঃখি মানুষের দুঃখে বাবার হৃদয়ে ভারাক্রান্ত হইয়া যাইতো। এলাকায় অভাব অনটন দেখা দিলে আমাদের বলিতেন তোমরা পেট ভরিয়া ভাত খাইও না। আরও বলিতেন এই সময়ে কোন মানুষ খাওয়ার চাহিলে না পারিলেও নিজের প্লেইট হইতে কিছু খাবার দিয়া দিও। শীতের সময়ে বড় ভাই সাহেবের মাধ্যমে শীতবস্ত্র এবং অন্যান্য সময়ে শাড়ী, লুঙ্গি ইত্যাদি গরীব মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হইত। বন্যার সময়ে বাড়িতে লঙ্গরখানায় খাবার পাক করিয়া নৌকা দিয়া বিতরণ করা হইত। এই দায়িত্বও বড় সাহেব আন্জাম দিতেন। বন্যার সময় ঝড় তুফান হইলে আমাদের হাওরে নৌকা ডুবিয়া মানুষ বিপদগ্রস্থ হইতো। তখন রাত্রে অথবা দিনে আমাদের ডাকিয়া নৌকা নিয়া হাওরের দিকে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিতেন এবং বলিতেন, দেখ কোন মানুষ বিপদে পড়িয়াছে কিনা? আগেকার দিনে আমাদের এলাকায় কোন বাড়িতে আগুন লাগিলে শোনামাত্র বাবা গেঞ্জি, লুঙ্গি পরা অবস্থায় বালতি নিয়া দৌঁড়াইয়া আগুন নিভাইতে যাইতেন। রাত্রিবেলা দূরে কোথাও আগুনের ঝলক দেখিলে সেইদিকে খেয়াল করিয়া দু‘আ পড়িতেন।
এলাকার মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। এলাকাবাসীর জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত ছিলেন। এই ধরনের অনেক বিষয় আমার জানা আছে। এখানে ছোট একটি বিষয় উল্লেখ করিতেছি। ১৯৯০ ইং সনে আমি এবং আমার সমবয়সী পরগণনার ব্যক্তিবর্গের নিয়া রতনগন্জ হাইস্কুলে বিরাট চক্ষু শিবির করিয়াছিলাম এবং আমরা বাজেট করিয়া মোটামোটি টাকা সংগ্রহ করিয়াছিলাম। এক পর্যায়ে চক্ষু শিবিরের পরিধি বড় হওয়ায় এবং খরচ বৃদ্ধি হওয়ায় তহবিলে বড় অঙ্কের টাকার ঘাটতি দেখা দেয়। এই বিষয়ে পরামর্শক্রমে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, সমস্যাটি ছাহেব কিবলার খেদমতে পেশ করা হউক। আমার সাথের সবাই ছাহেব কিবলাহর খিদমতে হাযির হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং বিষয়টি তাঁহাকে অবগত করিলেন। তখন তিনি বলিলেন, যে কাজ করিতেছ তাহা আমার কাজ। যত টাকা লাগে তাহা আমি আপনাদেরকে দিব। আপনারা কোন চিন্তা করিবেন না।
ছাহেব কিবলাহ মুরব্বিদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন। আশ-পাশের বয়স্ক কোন লোক গরু রাখিতে আসিয়া অথবা হাল-চাষ হইতে উঠিয়া আমাদের বাড়িতে আসিলেও বাবা চেয়ার হইতে দাঁড়াইয়া তাহাকে বসাইতেন, পরে নিজে বসিতেন।
আমাদের উপজেলার হিন্দু ধর্মাবম্বলী মানুষের প্রতি বাবা ছিলেন অত্যন্ত সদয়। অনেক সময় আমাকে বলিতেন হিন্দু লোকেরা সংখ্যায় কম তাই তাহারা নিজেকে দুর্বল মনে করে। তাহাদের যে কোন বিপদ আপদে বিশেষ খেয়াল রাখিও। তাহারা যেন কোন কষ্ট না পায়। এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আকারে দু’একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করিতেছি।
আমাদের এলাকায় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গ্রাম (দাউদপুর, জিয়াপুর, মঙ্গলপুর, কেরাইয়া, তিরাশি, মুলিকান্দি ইত্যাদি) আছে যে গ্রামগুলোর বাসিন্দা প্রায় সকলেই হিন্দু ধর্মাবম্বলী। বেশ কয়েক বৎসর আগে দাউদপুর গ্রামের যতিন্দ্র বিশ্বাস গ্রামবাসীকে নিয়া বিরাট আকারে নৌকা পূজার আয়োজন করেন। দেবদেবী স্থাপন করার পর কিছু দুষ্ট প্রকৃতির লোক পুজায় বিঘœ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। তখন ঐ গ্রামের হিন্দু লোকেরা বাবার খেদমতে উপস্থিত হইয়া বিষয়টি তাঁহাকে অবগত করেন। তখন বাবা আমাকে এই পূজার নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। তখন আমি গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়া পূজাস্থলে উপস্থিত হই। পূজাস্থলে উপস্থিত হইয়া ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ব্যাপারে কেহ বিঘœ সৃষ্টি না করার কথা বলি এবং দুষ্ট প্রকৃতির লোকদেরকে সতর্ক করিয়া দেই। বাড়িতে আসিয়া ঐ দিন থানার ওসী সাহেবকে সরেজমীনে নিজে উপস্থিত থাকিয়া নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম চালাইবার ব্যবস্থা নিতে বলি। পরে ঐ পূজার স্থলে আর কোনো অসুবিধা হয়নি।
কোন সময় দুষ্ট প্রকৃতির কোন লোক গরীব হিন্দু মানুষের কোন ভূ-সম্পত্তি জবরদখল করিতে চাহিলে এর বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতেন। কয়েক বৎসর আগে আমাদের বাড়ি হইতে প্রায় এক মাইল দূরে জিয়াপুর গ্রামের অনিল দাস, পিতা অকন্তি দাসের জমি পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন লোক জবরদখল করিয়া নেন। হিন্দু ভদ্রলোকটি নিরুপায় হইয়া তাহার আত্মীয়-স্বজনকে নিয়া বাবার কাছে আসিলে বাবা আমাকে সেই জমি রক্ষার ব্যবস্থা নিতে বলেন। আমি বাধ্য হইয়া পঞ্চাশ-ষাট জন লোক নিয়া সরজমিনে গিয়া সেই জমি রক্ষার ব্যবস্থা নেই এবং জমির মালিক নির্বিঘ্নে সেই জমির অধিকার ফিরিয়া পান।
বেশ কয়েক বৎসর আগে আমাদের ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদপার্থী জকিগঞ্জের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য শ্রী যুক্ত জগদানন্দ পুরকায়স্থের নির্বাচনী সভার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করিয়া তাহাকে স্থানীয় কালিগন্জ বাজারে আসিতে নিষেধ করে এবং হত্যার হুমকী দেয়। জগদানন্দ পুরকায়স্থ বিষয়টি বাবাকে জানাইলে বাবা আমাকে তাহার নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা নিতে বলিলেন। আমি বাজারে গিয়া গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে নিয়া চেয়ারম্যানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। উক্ত বাজার আমাদের বাড়ি হইতে প্রায় আড়াই মাইল দূরে।
১৯৭১ ইং সনে মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের এলাকার হিন্দু লোকেরা ভারতে চলিয়া যাইতে চাহিলে তিনি হিন্দু লোকদের বলিয়াছিলেন “তোমরা নিজ নিজ বাড়িতে নির্বিঘ্নে অবস্থান কর আমি বাড়িতে থাকিলে তোমরাও বাড়িতে থাকিবে”। জন্মভূমি ছাড়িয়া যাওয়া বড়ই বেদনাদায়ক।
বাবার প্রতি আমাদের এলাকার মানুষের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও মহব্বত ছিল। তাঁহার ইন্তেকালের পর সেই মহব্বতের প্রমাণ দেখা গিয়াছে। বাবার কফিন বাড়িতে পৌছার সাথে সাথে (ফজরের পূর্বে) এলাকার অনেককে “আমরার ছাব নাই রে” ( আমাদের ছাব নাই রে) বলিয়া চিৎকার করিয়া কাঁদিতে দেখা গিয়াছে। ফজরের আগ মুহ‚র্তে কফিন বাড়িতে পৌঁছিলে এলাকার শত শত মানুুষ বাড়িতে আসিয়া বাবার দাফনের ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়াইয়া দেন। কবর খনন করা, বাঁশ কাটা ইত্যাদি কাজে প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। আমাদের এলাকায় অপরিচিত কোন পুরুষ মানুষ অনুমতি ছাড়া কারো বাড়ির ভিতরে ঢুকেন না। কারণ ভিতর বাড়িতে সাধারণত মহিলারাই থাকেন। কিন্তু জানাযার দিন বাহির হইতে আসা মেহমানদের অনেকেই তাড়াহুড়ার মধ্যে পথ হারাইয়া বিভিন্ন বাড়ির পিছন দিকে ঢুকিয়া পড়িলে বাড়ির মালিক তাহাদিগকে বসত ঘরের দরজা খুলিয়া ঘরের ভিতর দিয়া জানাযাস্থলে যাওয়ার সুযোগ করিয়া দেন। আমাদের এলাকায় এমন অনেক লোক আছেন যাহারা অত্যন্ত গরীব। দু’বেলা একসাথে খাবার সংগ্রহ করিতে পারেন না। এই ধরনের অনেকের ঘরে জানাযার দিন দুপুরে বাচ্চাদের খাবারের জন্য সামান্য আলু এবং চাউল ছিল। এই সমস্ত পরিবার নিজের বাচ্চাকে অভুক্ত রাখিয়া সেই আলু এবং চাউলের খিচুড়ি করিয়া নিজের বাচ্চাকে দিয়া বাড়ির রাস্তায় পাঠাইয়া দেন। এবং বলিয়া দেন যে, ‘এরা ছাবর মেহমান পেঠর বুকে কষ্ট পাইরা তারারে বাটিয়া খাওয়াও। আল্লায় জেযা দিব।’ [তাহারা ছাহেবের মেহমান, তাহাদের পেঠে ক্ষিধা লাগিয়াছে। তাহারা ক্ষিধায় কষ্ট পাইতেছে তাহাদিগকে ভাগ করিয়া খাওয়াও। আল্লাহ জেযা দিবেন] কোন কোন বাড়ির শত শত গাছের চারা জানাযায় আগত মেহমানদের পায়ে পিষ্ঠ হইয়া নষ্ট হইয়া গিয়াছে কিন্তু বাড়ির মালিকরা কোন বাধা দেন নাই এবং অসন্তুষ্টও হন নাই। বাড়ির রাস্তার পার্শ্বে কোন বেড়া ইত্যাদি প্রতিবন্ধক থাকিলে তাহা উঠাইয়া উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন। মেহমানদের যাতায়াতের সুবিধার্থে অনেকে গোয়াল ঘর এবং ছোট খাট ঘরের বেড়া খুলিয়া দিয়াছেন। মেহমানদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মহিলারা কলসিতে পানি ভরিয়া গ্লাস সহ নিজের বাচ্চাদের দিয়া বাড়ির সামনে রাস্তায় মেহমানদের জন্য পাঠাইয়া দেন। ঐদিন ফুলতলীতে জানাযার উদ্দেশ্যে আসা কয়েক লক্ষ মানুষের বিভিন্ন ধরনের শত শত যানবাহন বিশেষ করে মটর সাইকেল ইত্যাদি ছোট ছোট বাহন আমাদের আশেপাশের গ্রামের রাস্তায়, বসত বাড়িতে, মাঠে-ঘাটে, বিভিন্ন ক্ষেত খামারে, যে যেখানে সম্ভব রাখিয়া জানাযায় শরীক হন। ফেরার সময় রাত্রি হইয়া গেলেও যে যেখানে যাহা রাখিয়া ছিলেন সেই অবস্থায়ই ছিল। এ সমস্ত যানবাহন ছোট ছোট বাচ্চাদের নজরদারীতে ছিল।
জানাযায় আগত মেহমানদের জন্য আমাদের বাড়ি হইতে তিন-চার মাইল দূর পর্যন্ত (উত্তর দিকে আটগ্রাম এবং দক্ষিণ দিকে লামারগ্রাম) অনেকে বাড়ি হইতে খাবার ও পানি দিয়া মেহমানদের সাহায্য করিয়াছেন। বিশেষত আটগ্রামের বাসিন্দারা সারা দিন ও রাত মেহমানদের যানবাহনের শৃঙ্খলায় ব্যস্ত ছিলেন। ঐ দিন আশে পাশে সর্বত্র গাড়ি রাখার পর মূল রাস্তার প্রায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত সারিবদ্ধ ভাবে গাড়ি ছিল। বাবার ভক্ত বৃন্দদের মধ্যে অনেকে গাড়ি নিয়া আসিতে না পারিয়া ১৫-২০ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়াইয়া জানাযায় শরিক হইয়াছেন।
সাধারণত কাহারো ইন্তেকাল হইলে জানাযার নামাজের পূর্বে মইয়্যিতের ওলী ওয়ারিশ মইয়্যিত সম্পর্কে দু‘আ চাহিয়া আবেদন রাখেন। কিন্তু আমার বাবার ইন্তেকালের আগের বৎসর বাড়ি সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে ঈদের জামাতের পূর্বে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বলেন, হায়াত-মউত সম্পর্কে বলা যায় না। আমি আপনাদের কোন দুঃখ দিয়া থাকিলে ক্ষমা করিয়া দিবেন। কে কত দিন বাঁচিবেন তাহা বলা যায় না।
বাবা শুধু আল্লাহ’র ওলী ছিলেন না, সমাজ এবং সংসার জীবনের সকল বিষয়ে অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও দক্ষ ছিলেন। প্রতিবেশী কোন কৃষক চাষাবাদ সম্পর্কে পরামর্শ নিতে আসিলে তাহাকে কোন মাঠে এবং কোন ভুমিতে কি জাতের ধান চাষ করিলে ভালো হইবে তাহা বলিয়া দিতেন। এমনকি চাষাবাদ করিতে কোন ধরনের মাটিতে কতটি চাষ দিতে হইবে এবং কয়দিন পানি রাখিতে হইবে তাহাও বলিয়া দিতেন।
নতুন বাড়ি করার ব্যাপারে কেহ পরামর্শ চাইলে তাহাকে কোন জায়গায় এবং কতটুকু দুরত্বে পুকুর, থাকার ঘর, বাংলা ঘর, রাস্তা, লেট্রিন, প্রস্রাবখানা ইত্যাদি স্থাপন করিতে হইবে তাহা বলিয়া দিতেন। উদাহরণস্বরূপ আমাদের বর্তমান বাড়ির অবস্থান তুলিয়া ধরা যায়। কোন জিনিস অযথা নষ্ট করিতে দেখিলে খুব রাগ করিতেন। কেহ গরু বাছুরকে ধান্য খাওয়াইলে বলিতেন ইহা মানুষের রিযেক। গরুর জন্য ঘাস আছে। গরুকে ধান্য খাওয়াইলে তোমাকে একদিন ঘাস খাইতে হইবে। বাবা সফরে যাওয়ার সময় কাপড় পরিতে গিয়া সবসময় ডান দিক হইতে আরম্ভ করিতেন। যেমন প্রথমে ডান পায়ের মোজা পরে বাম পায়ের মোজা পরিতেন। কোন কোন সময় আমরা মোজা পরাইতে গিয়া প্রথমে বাম পায়ে পরাইলে ধমক দিতেন এবং পা সরাইয়া নিতেন।
তিনি সবসময় অত্যন্ত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও ঝাঁকঝমকপূর্ণ কাপড় পরিধান করিতেন। আমি একদিন বাবার দিকে তাকাইয়া মনে মনে ভাবিতে ছিলাম বাবা কেন এত ঝাঁকঝমকপূর্ণ কাপড় পরেন। কিছুক্ষণ পর কি একটা কথা প্রসঙ্গে (মনে নাই) বাবা বলিয়াছিলেন যে, সমাজে যাহারা মুসলমানদের কায়িদ তাহাদেরকে ইসলামের দুশমনরা যাহাতে হেয় মনে করিতে না পারে এই জন্য মুসলিম কায়িদদের মধ্যে রুব থাকা উচিৎ।
বোধশক্তি হওয়ার পর হইতেই দেখিয়া আসিতেছি আমার বাবা তাহার কোন ছেলের থাকার ঘরে ঢুকিতে হইলে ঘরের সামনে দাঁড়াইয়া গলা হাকি দিতেন অথবা আমাদিগকে নাম ধরিয়া ডাকিতেন। যতক্ষণ ঘর হইতে কেহ বাহিরে আসিয়া তাহাকে ঘরের ভিতর নিয়া না যাইতেন অথবা ঘর হইতে জবাব না আসিত ততক্ষণ তিনি ঘরে ডুকিতেন না। ঘরের সামনে পায়চারি করিতেন। অবশ্য মারাত্মক জরুরী কোন ব্যাপার হইলে সেটা ভিন্ন।
আমি কামিল পাশ করার পর ইছামতি কামিল মাদরাসায় অনারারী শিক্ষক হিসাবে পড়াইতাম। তখন একদিন বাবা আমাকে ডাকিয়া নিয়া বলিলেন, মানুষ দুক ফাইয়া আমার গেছে আয়, আমি সময় দিতাম ফারিনা, মানুষের বদ দু‘আ লাগতে ফারে, তুমি একটু দেকিও, এওটাও এখটা ইবাদত। (মানুষ দুঃখ পাইয়া আমার কাছে আসে, আমি সময় দিতে পারিনা। মানুষের বদ দু‘আ লাগিতে পারে, তুমি ইহা একটু দেখিও। ইহাও একটি ইবাদত।) আমি তখন পড়া-শোনায় ব্যস্ত ছিলাম। তখন বাবার এই তাত্তি¡ক কথার কোন অর্থ আমি বুঝি নাই। কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন দিক থেকে জটিল বিরোধ বিসম্বাদের নিস্পত্তিকল্পে লোকজন আমার কাছে আসিতে লাগিল, আমি বাধ্য হইয়া শিক্ষকতা ছাড়িয়া সালিস বিচার বিষয়ে ব্যস্ত হইলাম, এবং এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে আমাকে প্রচুর সময় দিতে হয়। হাদীসে কুদসী মোতাবেক আল্লাহর ওলীরা জবান দিয়া যাহা বলেন, তাহা আল্লাহর দরবারে কবুল হইয়া যায়।
প্রত্যেক মানুষেরই সন্তান সন্ততির প্রতি সবচেয়ে বেশি স্নেহ থাকে। কিন্তু আমাদের প্রতি বাবার কি স্নেহ ছিল উদাহরণ হিসাবে একটি ঘটনা উল্লেখ করিতেছি।
ছোট বেলায় আমি ছিলাম একদিন জকিগন্জের কেছরী গ্রামের ছাদই মিয়া সাহেবের বাড়িতে (বড় বাড়ি) বাবার সাথে দাওয়াত খাইতে গিয়াছিলাম। রাত্রি বেলা বাবার সাথে পায়ে হাঠিয়া বাড়িতে ফিরিতেছিলাম। ফেরার পথে বাড়ি হইতে কিছু দূরে হাওরে থাকাবস্থায় ঝড় ও শিলা বৃষ্টি আরম্ভ হয়। তখন চৈত্র অথবা বৈশাখ মাস ছিল। রাত্রি আনুমানিক ৮টা হইবে। শিলাগুলো আকারে খুবই বড় ছিল। বাবা আমাকে তাঁহার হাত দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া বুকের নিচে রাখিয়া সামনের দিকে হাটিতেছিলেন। ৪/৫ মিনিটের মধ্যে শিলা বৃষ্টি থামিয়া গেল। আমার উপর একটি শিলাও পতিত হয় নাই। সকল শিলা বাবার উপর পতিত হইয়াছিল। সেই দিনের স্মৃতি যখন আমার স্মরণ হয়, তখন মনে মনে বলি আমার বাবার মত আর কাহারো বাবা নাই।
[লেখক : হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর ছাহেবজাদা]