বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার সম্মানিত উস্তায হযরত মাওলানা আব্দুল জলিল বিয়াবালী হুজুর আর নেই। আজ ১২ জুন শুক্রবার দুপুরে নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তিকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। আজ বিকাল ৫ টা ৩০ মিনিটে জকিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম কসকনকপুরে নিজ বাড়ি সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হবে।
সংক্ষিপ্ত জীবনাল্লেখ্যঃ মাওলানা আব্দুল জলিল বিয়াবালী ১৯৫৬ সালের ০১ জানুয়ারি জকিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম কসকনকপুর (বিয়াবাইল) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম কারী আমীর আলী একজন কারী ও আলিম ছিলেন। তাঁর মাতা মরহুমা ফাতিমা বেগমও ছিলেন একজন পরহেযগার মহিলা। তিনি ছিলেন ৫ বোনের একমাত্র ভাই। বাল্যকালেই তাঁর পিতা অসুস্থ হয়ে পড়লে লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের জন্য জীবিকা উপার্জনেও তিনি সহায়তা করেন। শৈশবে তিনি তাঁর মাতার কাছে কুরআন শরীফ, উর্দু ও ফার্সী কিতাব পড়েন। ১৯৭০ ইং সালে তিনি ইছামতি কামিল মাদরাসা থেকে আলিম এবং ১৯৭২ সালে ফাযিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৭৫ সালে কুমিল্লার দৌলতগঞ্জ গাজীমুড়া কামিল মাদরাসা থেকে কামিল সম্পন্ন করেন।
কামিল পাশের পর ১৯৭৫ সালে তিনি ঐতিহ্যবাহী বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসায় যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ২০১৫ সালে অবসরগ্রহণ করেন। মাদরাসায় শিক্ষাদানের পাশাপাশি তিনি এওলাসার জামে মসজিদে সুদীর্ঘ পঁচিশ পঁছর ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শেষজীবনে কিছুদিন রতনগঞ্জ বাজার জামে মসজিদেও ইমাম হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
হযরত মাওলানা আবদুল জলিল বিয়াবালী (রহ.) শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর নিকট ইলমে তরীকতের বায়আত গ্রহণ করেন। ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর অত্যন্ত স্নেহভাজন মুরীদ ছিলেন তিনি। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) থেকে তিনি ইলমে কিরাত ও ইলমে হাদীসের সনদও লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকমণ্ডলির মধ্যে আরো রয়েছেন, হযরত আল্লামা শামসুল হুদা বলরামেরচকী (র.), শায়খুল হাদীস আল্লামা হবিবুর রহমান, আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী (র.) ও স্বীয় ভগ্নিপতি হযরত মাওলানা কাজী মাহবুবুর রহমান (রহ.) প্রমুখ।
তিনি ৬ ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। তাঁর ছেলেগণ হলেন, মাওলানা মো. ওয়াজীহ উদ্দিন, মাওলানা মো. মঈন উদ্দিন, মাওলানা মো. বাহা উদ্দিন, মাওলানা মো. সালাহ উদ্দিন, মো. ইমাদ উদ্দিন ও মো. নিজাম উদ্দিন। আর মেয়েগণ হলেন, মরিয়ম বেগম, সাজেদা আক্তার ও বুশরা আক্তার।
বিনয় ও তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত অনুসরণীয় এক মণীষীঃ
হযরত মাওলানা আব্দুল জলিল বিয়াবালী (রহ.) একজন আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ ছিলেন। নামায, রোযা, ইবাদত-বন্দেগী ও শরীয়তসম্মত জীবন যাপন ছিলো তাঁর জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। তিনি কোনোভাবে কারো মনে আঘাত দিতেন না। তিনি কাউকে গালি দিয়েছেন বা কষ্ট দিয়েছেন এমন কথা জীবনেও শুনিনি। তিনি সারাজীবন ফুলতলী কামিল মাদরাসায় দারস দিয়েছেন। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ, সহকর্মী ও শিক্ষার্থী সকলের নিকট তিনি অত্যন্ত সমাদৃত। এওলাসার জামে সমজিদে একাধারে দীর্ঘ পঁচিশ বছর ইমামতি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মহল্লাবাসী মুসল্লীদের কোনো অভিযোগ ছিল না। সে গ্রামের মানুষের ভাষ্য, তিনি একজন ফেরেশতা। আসলেই বিয়াবালী হুযূর একজন মানবরূপী ফেরেশতা। তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। সকলের জন্য আন্তরিক কল্যাণ কামনা করতেন। কোনো মানুষকে নিয়ে কোনো বিরূপ সমালোচনা তাঁর মুখে কেউ শুনেনি। একদা তিনি বাজারে কেনাকাটা করতে গেছেন। এক দোকান থেকে কিছু সামগ্রী কেনার পর টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে দেখেন তাঁর পকেট খালি। তখন দোকানদারকে বললেন, ভাই, আমার থেকে অন্য একজনের প্রয়োজন হয়তো বেশি। তাই তিনি টাকা নিয়ে গেছেন। ব্যাগটা রেখে দেন। আমি অন্য সময় নেব। দোকানদার তো হতভম্ভ। তিনি চোর বা পকেটমারকে গালিগালাজ তো করছেনই না, বরং সম্মানসূচক ‘তিনি’ শব্দ ব্যবহার করছেন!
বিয়াবালী হুযূর বারো মাস ছাতা ব্যবহার করতেন। এর একটি কারণ রোদ কিংবা বৃষ্টি থেকে বাঁচা। অন্য আরো একটি কারণ ছিল চোখকে হেফাযত করা। আগে গ্রামের রাস্তা ছোট ছিল। রাস্তায় কোনো মহিলার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তিনি ছাতা দিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিতেন। অনেক সময় নিজে রাস্তা থেকে নেমে মহিলাদের স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যাওয়ার পথ করে দিতেন। হুযূরের সাথে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক। তিনি সম্পর্কে আমার নানা হন। আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন। আমাদের ঘরে এমনকি এওলাসার ও সিরাজপুর গ্রামের প্রত্যেক ঘরে বিয়াবালী হুযূর ছাড়া কোনো শিরনী বা দুআ মাহফিল অকল্পনীয় ছিল।
তাকওয়ার গুণে ভূষিত সর্বজনশ্রদ্ধেয় এ মনীষী অসুস্থ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সারাজীবন বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসায় দারস-তাদরীসে অতিবাহিত করেছেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে ১৯৭৫ সালে তিনি এ মাদরাসায় শিক্ষকতায় যোগদান করেন। আজীবন এ মাদরাসায়ই খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ের আগে তিনি মাদরাসায় উপস্থিত হতেন। ক্লাস থাকুক বা না থাকুক একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মাদরাসা ছুটি হওয়ার আগে বেরিয়ে যেতেন না। মাদরাসার উস্তাদদের কাছে তিনি ছিলেন ‘জীবন্ত অভিধান’। কোন বিষয়ে বিশেষ করে আরবী শব্দ নিয়ে কোন উস্তাদ সন্দেহে পড়লে বিয়াবালী হুযুরের দ্বারস্থ হতেন। তাঁর মতো মুত্তাকী, পরহেজগার, বিনয়ী, স্বল্পভাষী, স্নেহশীল মানুষ সত্যিই বিরল। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।