
প্রথিতযশা ইসলামী চিন্তাবিদ, ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ, আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেবের ইন্তেকাল ব্রিটেনবাসী আলেম সমাজ এবং সাধারণ মানুষের কাছে এক দ্বীনী অভিভাবক হারানোর মতো। ৯১ বছরের এই বিশেষজ্ঞ আলেম আমাদের বাঙ্গালী বা বাংলাদেশীদের জন্য ছিলেন গর্বের ধন। একজন প্রবীণ আলেমে দ্বীন ছিলেন তিনি। ইলম ও আ’মালের চর্চায় ছিলেন অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ। ব্রিটেনে বসবাসকারী উলামা সমাজে যাঁর অবস্থান ছিল শীর্ষে। উস্তাদতুল্য এবং অনেকের সরাসরি উস্তাদও ছিলেন তিনি।
২০০১ সনে ইংল্যান্ডে মাত্র পাড়ি জমিয়েছি, অবস্থানস্থল লুটন শহর। আমার শশুর মহুদয়ের কাছে জানতে চাইলাম ‘লেস্টারের ছাহেব’ সম্পর্কে। তখনও আমি জানতাম না তিনি যে তাঁর উস্তাদ। আমার শশুর মাওলানা ক্বারী আব্দুল কাদির ছাহেব দারুল হাদীস সৎপুরে লেস্টারের ছাহেবকে উস্তাদ হিসাবে পেয়েছিলেন। তিনি তাঁকে ফোন করলেন। আমি এই প্রথম লেস্টারের ছাহেবের সাথে কথা বলি। এর পর থেকে লেস্টারের ছাহেব ফোন করিয়ে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আমি তাঁকে এক সাদা মনের উদার প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন মুরব্বী হিসাবে পেয়েছি।
বাংলাদেশে আমার কর্মস্থল ঢাকায় মাসিক পরওয়ানা পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে থাকা কালীন সময়ে ইংল্যান্ডের যে সম্মানিত আলেম ছাহেবের নাম আমি খুব বেশী করে জানতাম এবং যাঁদের মাধ্যমে ইংল্যান্ডের বিষয়-আশয়ের সাথে আমার যোগসূত্র বা যোগাযোগ গড়ে উঠে, উনাদের মুখে যে নামটি বেশী করে উচ্চারিত হতো তিনি হলেন, ‘লেস্টারের ছাহেব’। মানুষ তাঁকে ‘লেস্টারের ছাহেব’ নামেই জানতো। ইংল্যান্ডের লেস্টার শহর, বিলেতে তাঁর প্রাথমিক কর্মস্থল ছিল। লেস্টারের দারুস সালাম মসজিদের খতীব ছিলেন তিনি। এ মসজিদটি বৃহত্তর পরিসরে গড়ে তুলার ক্ষেত্রে বলতে গেলে তিনি প্রতিষ্ঠাতার ভুমিকা পালন করেছেন। যোগবরেণ্য ওলীয়ে কামেল হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর শায়খ এবং উস্তাদ ছিলেন। তিনি ‘খলীফায়ে ফুলতলী’ হিসাবে ইংল্যান্ডে তাঁর সম্মানিত শায়খের প্রতিনিধিত্ব করতেন। এই সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব তাঁকে এক বিশিষ্ট অবস্থানে উন্নীত করেছিল। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা তাঁকে ইংল্যান্ডের সকল মাক্তাব-তানযীম বা মাসলাকের উলামা ও বিশিষ্টজনদের মাঝে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছিল। নিজের মাসলাক বা তানযীম ভুক্ত মানুষের কাছে তিনি তখন পরিচিত ছিলেন ‘লেস্টারের ছাহেব’ আর সর্বমহলের উলামা-জনতা তাঁকে ‘আল্লামা ছাহেব’ নামে জানতো।

‘আল্লামা মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব ইন্তেকাল করেছেন’, এই সংবাদ নিজে শুনি এবং ভাবতে থাকি, আল্লাহ পাক যমীন থেকে তাঁর প্রিয় বান্দাহ আলেমে দ্বীনকে উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে যে যমীনকে ইলমশূন্য করে দিবেন, এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ তো আমার চোখের সামনে। আমার সম্পর্কিত বয়স্ক সম্মানিত কেউ কেউকে সংবাদটি জানাবার তাগিদ অনুভব করলাম। শুনে আল্লাহর বান্দাগণ ব্যথাভরা কন্ঠে বললেন, আহ! আমরা একজন অভিভাবকে হারিয়েছি, একজন নির্ভরশীল দ্বীনী অভিভাবকে হারিয়েছি। অনেকে তো এমনও বললেন, ইংল্যান্ডে বসবাসকারী আলেমদের মাঝে তিনিই বেশী কাজ করেছেন। তাঁকে দীর্ঘ দিন ধরে দেখেছেন এবং তাঁর কর্মতৎপরতার সাক্ষী যাঁরা তাঁদের মূল্যায়নে, তিনি ছিলেন সুন্নীয়তের এক শক্তিশালী স্তম্ভ। কয়েক দশক ধরে ইংল্যান্ডের যমীনে তাঁর তা’লিম-তরবিয়তে ধন্য মানুষের সংখ্যা একেবারে কম হবেনা।
একজন বিশেষজ্ঞ আলেম যাঁর আ’মাল বা ব্যক্তি জীবন মানুষের কাছে সত্যিকার অর্থেই দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিল—তিনি তা ছিলেন। তা কর্মস্থল হোক বা নিজের বাড়ি হোক অথবা সফরকালীন সময়ই হোক, তাঁর জীবনাচার এবং খুলুসপূর্ণ নেক আমলের উদাহরণ সংগতিপূর্ণ গাম্ভীর্যে অত্যুজ্জ্বল ছিল। দরবেশী জীবনবোধ যা তিনি লালন করতেন পালন করতেন, তা নিজের পরিবার-পরিজনেরও প্রাত্যহিক আচরণ সৌন্দর্যে পরিণত করেছিলেন। খুবই কাছ থেকে দেখেছেন, এমন মানুষের অকৃত্রিম-বিশুদ্ধ স্বীকারোক্তি আমাকে বলতে বাধ্য করছে যে, আ’ম মানুষজনই শুধু নয়, অনেক আলেম ও দায়ী’ হযরাতকেও উপাদান গ্রহণ করার মতো পরহেজগারীর নমুনা তিনি অন্দর ও বাহিরে ধারণ করতেন।
অনেক সময় মানুষের জটিল বা প্যাচানো গুণ-বৈশিষ্ট্য বহু সুন্দরতাকে দুর্বোধ্যতায় আচ্ছন্ন করে দেয়। মানুষের অকৃত্রিম-আন্তরিক সারল্য হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম গুণ—আল্লামা দুবাগী ছিলেন এমনই এক গুণসম্পন্ন মানুষ, যিনি ছিলেন জটিলতামুক্ত এক নিজস্বতায় ভরপুর। তাঁর সম্পর্কে সম্মন্ধিত উক্তিগুলো যা তাঁর গুণগ্রাহীগণ ইতোমধ্যে চর্চা করতে শুরু করেছেন—সরল আল্লাহওয়ালা প্রাজ্ঞ একজন ছিলেন তিনি; মেহমান নেওয়াজ, উদার , স্নেহপরায়ণ এক মুরব্বীকে আমরা হারিয়েছি; অধ্যাবশায়ী এক জ্ঞানপিপাষু গুণী মানুষ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন; নির্ভরযোগ্য আলেমে দ্বীন হিসাবে মানুষের কাছে তাঁর অসামান্য গ্রহণযোগ্যতা ছিল; সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর কাছে মকবুলিয়ত বা গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ হিসাবে বিশ্বাসীদের এই চর্চা একজন মানুষের জীবনে পরম প্রাপ্তি নয়কি!
আমি বা আমরা যে তাঁর পরিপূর্ণ-নিবিড় সান্নিধ্য নিতে পারিনি, আক্ষরিক অর্থেই এটা সত্য। তিনি সকল বয়সের এবং সকল স্তরের আলেমগণকে সঙ্গ দিতে পছন্দ করতেন। বার্ধক্যের ভার আর শারীরিক সুস্থতার অল্পতা তিনি ভুলে যেতেন যখন আমাদের মতো বয়স এবং ইলমে অতিশয় তারতম্যপূর্ণ নবীনদের সাথেও আলোচনায় বসতেন। ব্যথা আর বেদনার ভারে অনেকের মতো আমিও কাতর হয়েছি, বিদ্ধ হয়েছি শোকাবহ খবরটির নিদারুণ আঘাতে। অনেকেই হয়তো বলবেন, তাঁর ইন্তেকাল পরিণত বয়সেই হয়েছে, কিন্তু আফসোস! আমরা একজন উঁচু স্থরের আলিমে দ্বীনকে হারিয়েছি, এক মুত্তাকী আল্লাহওয়ালা বুজুর্গ-অভিভাবককে হারিয়েছি, হারিয়েছি আল্লামা মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেবকে; যিনি ইলম ও যুহদের মাকাম মর্তবায় এ কালের মানুষের জন্যে দৃষ্টান্ত-উপমা হয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিয়ানী বাজার থানার দুবাগ গ্রামে ১৯২৯ সনে তাঁর জন্ম। সে সময়ের বরেণ্য উলামা, মুহাদ্দিসীন ও ফকীহ মুহাক্কিক উস্তাদগণের কাছে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। কর্মজীবনে একজন মুহাদ্দিস এবং ফকীহ হিসাবে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে নিজের প্রজ্ঞা ও মেধার নজির রাখেন। তাঁর ছাত্রদের মাঝে অনেক মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ফকীহগণ বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরে শিক্ষা বিস্তারে এখনও খেদমত করে যাচ্ছেন। ১৯৭৮ সন থেকে লেস্টার শহরের দারুস সালাম মসজিদের খতীব হিসাবে ব্রিটেনে তাঁর কর্মজীবনের শুরু। তিনি তাঁর মুক্তাদি, মুসাল্লি ও মসজিদ কেন্দ্রিক জনসাধারণকে প্রাত্যহিক বিষয়ের তা’লিম ও তারবিয়ত দিয়ে এমনই প্রাজ্ঞ করে তুলেন যে, শুনা যায় ভিন্নভাষী উলামা কেরামগণও তাঁর সম্পর্কে এক সময় উচ্চ ধারণা পোষণ করতে শুরু করেন। তাঁর ইলম ও কিতাব অধ্যায়নে বিস্ময়কর দক্ষতা তাঁকে তাঁর সময়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে আলোচনার কেন্দ্র করে তুলেছিল। ব্রিটেনের কর্মজীবনে তাঁর অসামান্য কর্মশীলতার নযীর বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিভিন্ন ভাষায় রচিত অনেকগুলো মূল্যবান কিতাব। বাংলাভাষী এক বিশেষজ্ঞ আলেম যিনি তাঁর মূল্যবান লেখনী দ্বারা ব্রিটেনবাসী মুসলমানদের জন্য তো বটেই, সকল শ্রেণীর মানুষের জন্যেই অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। আমরা এ পর্যায়ে তাঁর লিখিত কিতাবাদী থেকে কয়েকটির উল্লেখ এখানে করতে পারি: মানাছুল মুফতী (উর্দু), আল মাসাইলুন্নাদিরাহ, ফাতওয়ায়ে মুজাহিদিয়া, এক নজরে হজ ও যিয়ারত, এতিম প্রসঙ্গে, পুণ্যের দিশারী, ফাতেহা ও কবর যিয়ারতের মাসাইল, সুন্নাত ও নফল নামাজের জরুরি মাসাইল, দোয়ার মাহাত্ম্য, মানাছুল মুফতীর বঙ্গানুবাদ, বিবিধ মাসাইল, কদম বুছির তথ্য, জানাজার নামাজের পর দোয়া করা মুস্তাহাব, শবে-কদরের তাৎপর্য, ফাদায়েলে শবে-বরাত, শিফায়ে রূহ, প্রশ্নউত্তর, মীলাদে বেনযীর প্রভৃতি।
আল্লামা মুহম্মদ ইকবাল কত সুন্দর ও গভীর দর্শনের চোখে একজন লেখক, কবি অথবা মুসান্নিফের কর্মবিশালতার পেছনে তাঁর একাগ্রচিত্তকে ফুটিয়ে তুলেছেন:
“আত্তার হো, রুমী হো,
রাযী হো, গাজালী হো;
কুছ হাত নেহী আতা
বে আহে সাহার গাহী।”
আমার এক সম্মানিত উস্তাদ মাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকার প্রধান মুহাদ্দিস শায়খুল হাদীস আল্লামা ওয়াজীহ উদ্দীন লক্ষিপুরী আমাদেরকে বুখারী শরীফের প্রথম দিনের ক্লাসে ইলম, উলামা এবং মাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকার বিশেষত্ব, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিষয়ে গভীর আলোচনার পেক্ষিতে এমন সব কথামালা বলছিলেন, যা সাতাশ বছর আগের তিন শ’য়ের অধিক ছাত্রদের মধ্যে বসে থেকে শুনা কথাগুলোর তীক্ষ্ণ, গভীর প্রভাব এখনও আমি অনুভব করি। তাঁর কথাগুলো একাধারে একজন শিক্ষক, অভিভাবক এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতো শুনাচ্ছিল। অর্থাৎ না শুনে না মেনে তোমাদের উপায় নেই—এমনই নিশ্চিত করে উপস্থাপন করা তাঁর কথাগুলো। প্রথমে বললেন আক্বিদা দুরুস্তের কথা। তাঁর ভাষায়, ‘হাদীস শরীফ পড়তে এসেছ, তো আক্বিদা দুরুস্ত না করে উপায় নেই।’ এর পর বললেন, ইলমের গুরুত্ব ও আলেমের দায়বদ্ধতার বিষয়-আসয় সম্পর্কে। সব শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে মাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যের দিকগুলো। এ পর্যায়ে আমাদের ক্লাসরুমের বেঞ্চ, টেবিল, শিক্ষকের চেয়ার এবং ডেস্ক দেখিয়ে বলতে থাকলেন, “এই বেঞ্চে আমিও বসে একদিন ক্লাস করেছি, আর শিক্ষকের আসনে বসা ছিলেন বরেণ্য মুহাদ্দিস মুফতিয়ে আজম হযরত আমীমুল ইহসান মুজাদ্দিদী বারাকাতী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। আমি ভাবিনি তাঁর আসনে বসে একদিন আমার মতই বসে থাকা ছাত্রদের পড়াব। তিনি তখনকার সময়ের বড় আলেম ছিলেন, অনেক বড় আলেম ছিলেন! এখন লোকে আমাদেরকেও বড় আলেম বলে; আর তোমাদেরকেও একদিন বড় আলেম বলবে! আর বেলম গাছের লাকড়িকেও লোকে উত্তম কাঠ হিসাবে ব্যবহার করবে !”
শায়খুল হাদীসের কথাগুলো নিয়ে আমি এখনও চিন্তা-ভাবনা করি আর মনের গহীনে বেদনার সুর অনুরণিত হতে শুনি—আমাদের মাথার তাজসকল হারিয়ে যাচ্ছেন, যুগ-যামানার দৃষ্টান্তের মতো ইলম ও আ’মালের খাজানাগুলো মাটির কুটুরিতে সমাহিত হবার পূর্বে আমরা কি কিছু হাসিল করতে পেরেছি!
উর্দু এই কবির কবিতার সাথে এক মত হতে আমার মন সায় দিচ্ছেনা বটে—তবে কী আর করা, কবির কবিতা বলে কথা—
“হামারে বা’দ যমানে মে
কেউঁ না খাক উড়ে;
কেহ কারওয়ান কে পিচ্ছে
গুবার রহতা হায়।”
[লন্ডন, ১৩ জুলাই ২০২০]