জীবনীমনীষা

অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম (রহ.) : ব্যক্তি ও জীবন

মাসুক আহমেদ

যশোরের দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফের পীর ছাহেব, বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক ও কলামিস্ট, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়্যুম (রহ.) মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর ২০২০ তারিখে ইন্তেকাল করেছেন।

অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূম ১৯৪৪ খৃষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল রোববার বৃহত্তর যশোরের মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার দ্বারিয়াপুর শরীফের ঐতিহাসিক পীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পীরে কামাল মাওলানা তোয়াজউদ্দিন ও মোসাম্মত জোহরা খাতুন এর জৈষ্ঠপুত্র।

হাসান আবদুল কাইয়ূমের শিক্ষা জীবনের হাতে খড়ি হয় মূলত মায়ের কাছে। তিনি পিতা ও গৃহ শিক্ষকের কাছে অতি শৈশবে কুরআন, দীনীয়াত, আরবী ও উর্দূভাষা শিক্ষা লাভ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় দ্বারিয়াপুর প্রাইমারী স্কুলে। পরবর্তীতে খুলনা বি. কে. ইনস্টিটিউট, মাগুরা হাই মাদ্‌রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৬২ খ্রীস্টাব্দে তিনি ঢাকা সরকারী ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের মাদ্‌রাসা শাখা থেকে মাদ্‌রাসা শিক্ষার চুড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ইংরেজী সাধারণ শিক্ষা লাভের জন্য কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৭ খ্রীস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস, সমাজ কল্যাণ, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, বাংলা ও ইংরেজী প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ভর্তি হন। অতঃপর ১৯৭০ খ্রীস্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঐ বিষয়ে কৃতিত্বের সাথে এম. এ. ডিগ্রী লাভ করেন।

ছাত্র জীবনে তিনি বয় স্কাউটিং এবং ইউনিভারসিটি অফিসার্স ট্রেনিং কোর (UOTC) এ যুক্ত ছিলেন এবং ১৯৬০-৬১ খ্রীস্টাব্দে লাহোরে অনুষ্ঠিত জাতীয় জাম্বুরীতে যোগদান করেন। তিনি হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে শরীক হন। আর এজন্য গ্রেফতারও হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান, প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন, এবং ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।

পেশাগত জীবন:
অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ূমের পেশাগতজীবন শুরু হয় কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। তিনি স্বাধীনতা উত্তর কালে শ্রীপুর ডিগ্রী কলেজ, মাগুরা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৮০ খ্রীস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং অচিরেই তিনি পরিচালক পদে উন্নীত হন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাপ্তাহিক অগ্রপথিক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা (গবেষণা পত্রিকা), শিশু পত্রিকা সপ্তডিংগা ও সাহিত্য সাময়িকী ঐতিহ্যের সম্পাদক ছিলেন তিনি। এ ছাড়াও তাঁর সম্পাদনায় ১৯৭২ খ্রীস্টাব্দে নবকাল নামে মাগুরা থেকে একটি পাক্ষিক পত্রিকা এবং ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দে জগন্নাথ কলেজ থেকে উল্কা নামে একটি সাহিত্য সাময়িকীও প্রকাশিত হয়। হাসান আব্দুল কাইয়ূম ২০০৩ সালে চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

আধ্যাত্মিক জীবনঃ
অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ুমের পিতা মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার দ্বারিয়াপুর শরীফের পীর সুফি মাওলানা তোয়াজউদ্দিন আহমদ রহ. ছিলেন ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামান হযরত আব্দুল্লাহ আবু বকর সিদ্দিকী আল কুরাইশী রহ. এর অন্যতম খলিফা। তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া, মুজাদ্দেদিয়া, মুহাম্মাদীয়া তরিকা সমূহে বায়াত, তালিম, তায়াজ্জুহ ও খেলাফত লাভ করেন এবং পরবর্তীতে দ্বারিয়াপুর শরীফের গদিনশীন পীর হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। যশোরের খড়কির পীর মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল মতিন রহ. তাঁর শ্বশুর।

তিনি আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া, খানকায়ে তোয়াজিয়া সহ এতিমখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করেন। লিবিয়া, ইরাক ইত্যাদি দেশ ভ্রমণ করে বিভিন্ন আন্তঃজার্তিক সুফি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

সুলেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। তিনি দেশের বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকার নিয়মিত লেখক। প্রতি শুক্রবারে প্রসঙ্গ ইসলাম নামে দৈনিক জনকণ্ঠে এবং The Daily Star, Sun- ও অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত সময় তাঁর প্রকাশনা ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যেমন : তফসীরে তাবারী, বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। ইসলামী বিশ্বকোষ প্রণয়নে তাঁর গুরত্বপূর্ণ অবদান সহ অনেকগুলো মৌলিক ও অনূদিত প্রবন্ধ নিবন্ধ রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, জার্ণালে তাঁর তিন হাজারেরও অধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

তাঁর রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ অনুপম আদর্শ, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, খোকা-খুকুর ছড়া, ফুরফুরার চাঁদ, কাদিরীয়া তরীকা, জিহাদ, সাবির কাব্যে ইসলামী ভাবধারা, ইসলাম ও জীবন, প্রসঙ্গ ইসলাম, তা’লীমে তাসাওউফ প্রভৃতি।

প্রবন্ধের মধ্যে – বাংলা সাহিত্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ঈদে মীলাদুন্নবীর মর্মকথা, ফুরফুরার পীর আবু বকর সিদ্দিকী, ইসলামে সভ্যতা ও সংস্কৃতি, খেদমতে খালক ও সুফি ইমাম শেখ বোরহানুদ্দীন (রহ.), রসূল প্রেমের কবিঃ শায়খ মানযূর আহমাদ, খড়কির পীর আব্দুল মতিন, ইসলামে মাতৃভাষার গুরত্ব, আমাদের চেতনার উচ্চারণে ফররুখ, সরল জীবনযাপনের গুরত্ব, বাংলা ভাষায় মুসলিম অবদান, তাসাওউফ অর্জন করা জরুরী, ফতোয়ায়ে আলমগীরি গ্রন্থের বৈশিষ্ট, নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

কর্মের স্বীকৃতি:
অধ্যাপক হাসান অবদুল কাইয়ূম ইতোমধ্যেও বেশ কয়েকটা পদক ও সম্মননা লাভ করেছেন, যেমনঃ জাতীয় লেখক পরিষদের নববর্ষ পুরষ্কার ১৩৯৭, জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিষদের নজরুল স্বর্ণপদক ১৯৯৬, জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিষদের মওলানা ভাসানী স্বর্ণপদক ১৯৯১, আধ্যাত্নিক কবিতা পরিষদের সাহিত্য সম্মাননা ২০০০, মুসলিম সাহিত্য সমাজের শান্তি পদক ২০০৯ এবং সর্বশেষ সুফিতাত্ত্বিক গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ” ইমাম বোরহানুদ্দীন এওয়ার্ড-২০১৯”।

তিনি ৬ অক্টোবর ২০২০ ইং ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

তথ্যসূত্রঃ
ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার
দৈনিক জনকন্ঠ সহ অন্যান্য পত্রিকা
স্বরচিত গ্রন্থসমূহ
ইন্টার্নেট৷

Related Articles