আক্বীদা

নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম (রহ)

আল্লাহ হচ্ছেন খালিক আর সব কিছু হচ্ছে মখলুক। যতো মখলুকাত আছে সে সবের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। একটি বহুল প্রচলিত হাদীস রয়েছে, যা হাদীসে কুদসীর অন্তর্গত। সেই হাদীসখানির মর্মকথা হচ্ছে : আল্লাহ জাল্লা শানহু ছিলেন গুপ্তধন। তিনি আপন মহিমা ও গরিমায় মহিমান্বিত অবস্থায় বর্তমান ছিলেন। তিনি আপন কুদরতের মহিমা বিকশিত করবার লক্ষ্যে, তাঁর খালিক সিফাতের বহি:প্রকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে তিনি এক স্বচ্ছ সমুজ্জ্বল নূরের উন্মেষ ঘটালেন। এই নূর অস্তিত্বপ্রাপ্ত হবার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি জগতের সূচনা হল। সেই নূর থেকে সৃষ্টি হলো পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি জগতের নতুন নতুন মখলুক। আল্লাহ জাল্লা শানুহু আপন নূরের ফয়েযের কুদরতি তাজাল্লী হতে যে নূরের উন্মেষ ঘটালেন সেই নূরকেই বলা হয় নূরে মুহাম্মদী (সা.)। একটি বিবরণে আছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ আমার নূরকে প্রথম সৃষ্টি করেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : হযরত আদম (আ.)-এর পয়দা হবার চৌদ্দ হাজার বছর পূর্বে আমি আমার রব-এর সান্নিধ্যে নূর হিসেবে ছিলাম।

হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বরাত দিয়ে আবদুর রায্যাক একটি হাদীস সনদসহ বিবৃত করেছেন। হাদীসখানির উদ্ধৃতি বহু নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে বিধৃত ও আলোচিত হয়েছে। হাদীসখানি বেশ দীর্ঘ, যা সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবার জন্য অতি প্রয়োজনীয় তথ্যসমৃদ্ধ। সেই বিখ্যাত হাদীসখানি হচ্ছে এরূপ : হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি একদিন আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার আব্বা-আম্মা আপনার জন্য কুরবান হোন। আমাকে এই তথ্যটি জানিয়ে দিন যে, আল্লাহ তা‘আলা কোন জিনিসটি প্রথম সৃষ্টি করেন? হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : আল্লাহ তা‘আলা সকল বস্তু সৃষ্টির পূর্বে তাঁর নূর থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেন। অত:পর সেই নূর আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী তাঁর কুদরতে সজোরে ঘূর্ণায়মান ছিল। সেই সময়টাতে লওহ ছিল না, কলম ছিল না, জান্নাত ছিল না, দোযখ ছিল না, ফিরিশতা ছিল না, আসমান ছিল না, যমীন ছিল না, সূর্য ছিল না, চন্দ্র ছিল না, জিন ছিল না, মানুষ ছিল নাÑ কিছুই ছিল না। অত:পর আল্লাহ সৃষ্টি করবার ইরাদা করলেন। সেই নূরকে চার ভাগে বিভক্ত করলেন। প্রথম ভাগ থেকে সৃষ্টি করলেন কলম, দ্বিতীয় ভাগ থেকে সৃষ্টি করলেন লওহ, তৃতীয় ভাগ থেকে সৃষ্টি করলেন ‘আরশ …।

পূর্বেই বলেছি, হাদীসখানি দীর্ঘ। এখানে তার অংশ বিশেষ পেশ করা হলো। সম্পূর্ণ হাদীসখানি পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সে নূর মুবারক অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদীÑই হচ্ছে সৃষ্টি জগতে প্রথম সৃষ্টি, আর সেই নূর মুবারক থেকেই সমস্ত সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। এই হাদীসখানি উদ্বৃত করে হযরত আশরাফ আলী থানবী (র.) রচিত ‘নশরুত্তীব্ ফী যিকরিন্নাবিয়্যিল হাবীব’ গ্রন্থে মন্তব্য করা হয়েছে যে, এই হাদীস দ্বারা এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, নূরে মুহাম্মদী হলো আল্লাহ তা‘আলার সর্বপ্রথম সৃষ্টি, কেননা যেসব জিনিসের ব্যাপারে প্রথম সৃষ্টি হওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়, সেসব সৃষ্টি যে নূরে মুহাম্মদীর পরে তা এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিভাত হয় (দ্র. মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম কর্তৃক উপরিউক্ত গ্রন্থের তরজমা ‘যে ফুলের খুশবুতে সারা জাহান মাতোয়ারা’, পৃষ্ঠা ১)।

হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত একখানি হাদীস থেকে জানা যায় যে, সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কোন্ সময় নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন? তিনি বললেন : যখন আদম (আ.) রূহ ও দেহের মধ্যখানে। এর দ্বারা এটাই বুঝা যায় যে, হযরত আদম (আ.)-এর পয়দা হবার বহু পূর্বেই প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়তপ্রাপ্ত হন (প্রাগুপ্ত পৃষ্ঠা ২)।

এ ছাড়াও বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, হযরত আদম (আ)-এর কপালে এই নূর মুবারক দীপ্যমান হয়। তাঁর থেকে হযরত আদম (আ.)-এর তৃতীয় সন্তান হযরত শীস (আ.)-এর কপালে এই নূর স্থিত হয়। এমনিভাবে পুরুষাণুক্রমে এই নূর মুবারক হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আব্বা হযরত আবদুল্লাহ হয়ে তাঁর আম্মাজন আমিনার মধ্যে স্থিত হয়। আর ৫৭০ খৃস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সুবহে সাদিকের এক মুবারক মুহূর্তে সেই নূর মুবারক মানবরূপে পার্থিব জগতে আবির্ভূত হন। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : ইমাম আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবূ বকর ইবন খতীব কাসতালানী, মওয়াহিবে লাদুন্নিয়া, প্রফেসর মাওলানা আবদুল খালেক, সায়্যিদুল মুরসালীন প্রভৃতি)।

কীলানী আয়নুল উজুদ ধারণা উপস্থাপন করে এবং ইবনুল আরাবী আয়নুস সাবিত ধারণা উপস্থাপন করে নূরে মুহাম্মদীর উপর বিস্তর ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। ইবনুল আরাবী ‘ফুসুসুল হিকাম’ গ্রন্থে নূরে মুহাম্মদীকে বাস্তব সত্তাসমূহের বাস্তব সত্তা বা সৃষ্ট সত্তাসমূহের আদি সত্তা বলে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে নূরে মুহাম্মদী সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে কারীমায় নূর প্রসঙ্গ এসেছে। কোন কোন আয়াতে কারীমায় নূরের উল্লেখ এমনভাবে এসেছে যে, অনেকেই তার ব্যাখ্যা পেশ করতে গিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, সেই নূরের উল্লেখ নূরে মুহাম্মদীর দিকেই ইংগিত করে।

কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহর নিকট হতে এক নূর এবং স্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে (সূরা মায়িদা : আয়াত ১৫)।

এই আয়াতে কারীমায় যে নূরের উল্লেখ রয়েছে, এই নূরের পরিচয় তুলে ধরে বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে ভাষ্য উপস্থাপিত হয়েছে। ইমাম কাতাদা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে, এই নূর হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নূর মুবারক অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী। তাফসীরে নূরুল কুরআনে এই আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যায় মাওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম লিখেছেন : নিঃসন্দেহে তোমাদের নিকট আল্লাহ পাকের তরফ থেকে এসেছে নূর এবং সুস্পষ্ট গ্রন্থ। এখানে ‘নূর’ অর্থ নূরে মুহাম্মদী তথা হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর কিতাব তথা পবিত্র কুরআন (দ্র. তাফসীরে নূরুল কুরআন, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ. ১৬৭)।

কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তারা তাদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর নূর নির্বাপিত করতে চায়। কাফিরগণ অপ্রীতিকর মনে করলেও আল্লাহ তাঁর নূরের পূর্ণ উদ্ভাসন ব্যতীত অন্য কিছু চান না (সূরা তওবা : আয়াত ৩২)। এই আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল্লামা ছানাউল্লাহ পানিপথী (র.) উল্লিখিত নূরের ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে : এই নূরের অর্থ হলো তওহীদের স্পষ্ট দলীল অথবা কুরআন মজীদ অথবা প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াত ও রিসালাত।

সূরা সাফ্ফ-এ ইরশাদ হয়েছে : ওরা আল্লাহর নূর ফুঁৎকারে নিভিয়ে দিতে চায় কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন যদিও কাফিররা তা পছন্দ করে না। তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ সকল দ্বীনের উপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দানের জন্য, যদিও মুশরিকগণ তা অপছন্দ করে। (সূরা সাফ্ফ : আয়াত ৮-৯)

সূরা নূরে ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহ আসমানসমূহ ও পৃথিবীর নূর, তাঁর নূরের মিছাল হচ্ছে যেন একটি মিশকাত (দীপাধার) যার মধ্যে আছে এক মিসবাহ (প্রদীপ), প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সাদৃশ, একে প্রজ্বলিত করা হয় মুবারক যয়তুন বৃক্ষের তেল দ্বারা যা প্রাচ্যেরও নয়, প্রতীচ্যেরও নয়, আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেনো তার তেল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে, নূরের উপর নূর (নূরুন ‘আলা নূর) আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর দিকে পথ নির্দেশ করেন। আল্লাহ মানুষের জন্য মিছাল দিয়ে থাকেন এবং আল্লাহ সর্ববিষয়ে মহাজ্ঞানী। (সূরা নূর : আয়াত ৩৫)
বেশ কয়েকজন তাফসীরকার এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এই আয়াতে কারীমায় নূরে মুহাম্মদীর মিছাল দেওয়া হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রা.)-এর জিজ্ঞাসার জবাবে হযরত কা’ব আহবার বলেছিলেন, এই আয়াতে আল্লাহ তাঁর নবীর অবস্থা সম্পর্কে মিছাল দিয়েছেন।

এক ভাষ্যে ব্যক্ত হয়েছে যে, মিশকাত শব্দ দ্বারা হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সিনা মুবারককে বোঝানো হয়েছে, আর কাঁচ দ্বারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কলব মুবারককে বোঝানো হয়েছে। ‘মিসবাহ’ শব্দ দ্বারা তাঁর নবুওয়াত বোঝানো হয়েছে (বিস্তারিত তথ্যের জন্য মওলানা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম রচিত তফসীরে নূরুল কুরআন, অষ্টাদশ খন্ড, পৃষ্ঠা ২৪৪-২৪৫ দেখা যেতে পারে)।

একটি বিবরণ হতে জানা যায় যে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমি ইবরাহীমের দু‘আ, ‘ঈসার খোশ খবর এবং আমার আম্মার গর্ভাবস্থার স্বপ্ন। তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, একটি নূর বের হয়ে সিরিয়ার প্রাসাদগুলো উদ্ভাসিত করলো।
হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নূর ছিলেন, সে সম্পর্কে বেশ কয়েকখানি হাদীস রয়েছে। হযরত আয়িশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বলেছেন : হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোতে যেমন দেখতে পেতেন, অন্ধকারেও তেমনি দেখতে পেতেন। সামনে-পেছনে সমানভাবে দেখতে পেতেন। (তিরমিযী শরীফ)

মাওলানা আযীযুল হক কর্তৃক অনূদিত বুখারী শরীফের সপ্তম খন্ড সীরাতুন্নবী সংকলনের তৃতীয় পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, সর্বপ্রথম সৃষ্টি হযরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। চতুর্থ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে যে, নিখিল সৃষ্টি হযরতের খাতিরে। সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলারই সৃষ্ট হকীকতে মুহাম্মদীয়ার প্রতি স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার এমন আকর্ষণ ও ভালবাসা যে, আল্লাহ ইচ্ছা করেন ঐ হাকীকতে মুহাম্মদীয়ার প্রদর্শনী করবেন এবং অন্যকে দেখাবেন তাঁর ভালবাসার প্রিয় মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। সেই প্রদর্শনী করতে গিয়েই আল্লাহ তা‘আলা এই বিশ্বভুবনসহ কুল-মখলুকাত তথা অসংখ্য অগণিত বস্তু সৃষ্টি করেন (দ্র. ঐ ৪)।

হযরত সালমান ফারসী রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণিত একটি হাদীস আছে যে, একদা হযরত জীবরাঈল আলাইহিস সালাম নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট হাযির হয়ে বললেন : আপনার রব সংবাদ পাঠিয়েছেন এটা সত্য যে, ইবরাহীম আমাকে খলীল বানিয়েছিলেন। আমি তা গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু আপনাকে স্বয়ং আমি হাবীব বানিয়েছি। আমার নিকট আপনার চেয়ে সম্মানী কোন কিছু সৃষ্টি করি নি। আর আমি শপথ করে বলছিÑ নিখিল বিশ্ব এবং তার সব কিছু আমি সৃষ্টি করেছি এই উদ্দেশ্যে যে, তাদের কাছে প্রকাশ করব আপনার গৌরব এবং আমার নিকট আপনার যে কত মর্যাদা। আপনি না হলে আমি নিখিল বিশ্ব সৃষ্টি করতাম না (দ্র. ঐ, পৃষ্ঠা ৫)।

প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ জাল্লা শানুহু প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আবির্ভাব ঘটানোর জন্য, তাঁর মর্যাদার বিরাটত্ব প্রকাশ করবার জন্যই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ হচ্ছেন রাব্বুল আলামীন আর তাঁর হাবীব হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতাবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হচ্ছেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। আল্লাহর ভালবাসা পাবার জন্য আগে প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীবকে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেছেন : আপনি বলুন, তোমরা যদি আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ্ মাফ করে দেবেন। (সূরা আলে-ইমরান : আয়াত ৩১)

কুরআন মজীদে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘সিরাজাম মুনীরা’ বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : হে নবী! আপনাকে তো প্রেরণ করা হয়েছে সাক্ষ্যদাতারূপে, সুসংবাদদাতারূপে, সতর্ককারীরূপে এবং আল্লাহর দিকে তাঁরই অনুমতিক্রমে আহ্বানকারীরূপে এবং সিরাজাম মুনীরারূপে। (সূরা আহযাব : আয়াত ৪৫)

নূরে মুহাম্মদী বিষয়ে বহু সাহিত্যকর্ম রয়েছে। বাংলা ভাষাতে এই বিষয়ে বেশ কয়েকখানি পুস্তক-পুস্তিকা রচিত হয়েছে। বাংলায় প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নূর নবী বলা হয় এই ধারণা থেকেই। নূরনামা নামে বাংলা ভাষায় একাধিক কাব্য রচিত হয়েছে ষষ্ঠদশ, সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে। নূর কন্দিল নামেও কাব্য রচিত হয়েছে সেকালে।

পৃথিবীর নানা ভাষায় প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর বহু কবিতা, সীরাত গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আবদুর রহমান জামী লিখেছেন :
ইয়া সাহিবাল জামালি, ওয়া ইয়া সায়্যিদাল বাশার
মিন ওয়াজহিকাল মুনীরি লাকাদ নাওয়ারাল কামার
এর বাংলা অনুবাদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ করেছেন এভাবে :
হে মোর সুন্দরতম! হে নর রতন।
চাঁদেরে দিয়েছে জ্যোতি তোমারই আনন।

হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে যতো বেশি চর্চা ও আলোচনা হবে ততই আমাদের নবীপ্রেম বৃদ্ধি পাবে। নবী প্রেম ছাড়া আল্লাহর মুহব্বত পাওয়া যায় না। ইলমে তাসাওউফে দায়রায়ে হকীকতে মুহাম্মদী নামে একটি অনুশীলন অধ্যায় রয়েছে। তা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে এর তাৎপর্য কিছুটা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হতে পারে। অধুনা বিজ্ঞান যে বিগ ব্যাগ থিওরীর উপর গবেষণার পর গবেষণা চালাচ্ছে তার প্রকৃত রহস্য উদঘাটিত হতে পারে নূরে মুহম্মদীর রহস্য উদঘাটনের মাধ্যমে।

[লেখক : বিশিষ্ট গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ, মরহুম পীর ছাহেব, দ্বারিয়াপুর, যশোর]

Related Articles