
মাযার অর্থ যিয়ারতগাহ। যিয়ারত করার স্থান। আমরা সবাই ইন্তিকাল করি। এরপর কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের পার্থিব ঠিকানা হলো কবর। বিশিষ্ট বুযুর্গানে দ্বীনের কবর বেশি যিয়ারত করা হয় বলে তাঁদের কবরকে মাযার বলা হয়। হাদীস শরীফে আমরা কবর যিয়ারতে উৎসাহমূলক বক্তব্য দেখতে পাই। কারণ এতে আমাদের পরকালীন জীবনের কথা মনে হয় এবং দুনিয়া বিমুখতা তৈরী হয়। এমনকি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বাকী গোরস্তানে সাহাবীদের কবরগুলো যিয়ারত করতেন, উহুদের ময়দানে শহীদানের কবর যিয়ারত করতেন। সাহাবীগণ পরবর্তীতে তাঁর রওজা শরীফ যিয়ারত করেছেন। তাই মাযার যিয়ারত সুন্নাত এবং শরীয়াতসম্মত আমল-এতে কোন সন্দেহ নেই। কেউ মাযার যিয়ারতকে এনকার করলে তার অর্থ সুন্নাতে নববীকে এনকার করা।
মাজারে শিরক-বিদাত হয়। এটা খুবই দু:খজনক বিষয়। এ বিষয়টা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
এজন্য অনেকেই দোষ দেন মাজারের। আসলে যে নিজের মনের বুতখানাকে ভাঙতে পারেনি, যে মানসিকভাবে শিরকের বেড়াজাল থেকে বের হতে পারেনি, সে তো সবসময় শিরকি ধ্যানধারনা নিয়েই ঘোরাফেরা করছে। যে মাজারে এসে সিজদা দেয়, সে তার জ্যান্ত পীরকে গিয়েও সেজদা দেয়। ছবি বা প্রতিকৃতির সামনেও মাথা নত করে। একই লোক আবার রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় জ্যোতিষিকে দেখলে হাত দেখায়। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় রত্নপাথর কেনে। কিন্তু ঘুরেফিরে দোষ হয় মাজারের। আসলে প্রয়োজন জ্যোতিষ, ভাগ্যগণনাসহ শিরক-বিদআতমূলক সমস্ত কাজের বিরুদ্ধেই সোচ্চার হওয়া।
এজন্য মানুষের ভেতর তাওহিদের আকীদা মজবুত করতে হবে। আলো আসলে যেমন অন্ধকারের অস্তিত্ব থাকে না, তেমিনি হৃদয় তাওহিদের আলোকে আলোকিত হলে শিরক নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
মাজার প্রাঙ্গন থেকে শিরক বিদাত দূর করতে হলে
প্রথমে আমাদের সমস্যাটির প্রকৃতি জানা প্রয়োজন।
যেমন এই শিরক-বিদাত কারা করে?
১। যারা মাযারের মুতাওয়াল্লি হিসেবে থাকে। তারা অনেক সময় নিজেরা না করলেও প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেন।
২। মাযারে থাকা ভাসমান মাদকসেবী ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিবর্গ।
৩। বাউল ধর্মমতে বিশ্বাসী, বেশরা ও যিনদিক লোকজন।
৪। মাযার যিয়ারতে আগত তাওহীদ ও রিসালাতের মৌলিক আকীদা সম্পর্কে অজ্ঞ নারী-পুরুষ।
৫। অ্মুসলিম নারী-পুরুষ। বিশেষত পৌত্তলিক জনগোষ্ঠীর সদস্যবৃন্দ।
সকল মাযারের বাস্তবতা সমান না। কোনও কোনও এলাকায় পৌত্তলিক জনগোষ্ঠীর আবাস নেই। যা শিরক-বিদাত হয় অন্যরাই করে। আবার কোনও কোনও মাজারে মুতাওয়াল্লি দূর্বল অবস্থায় আছে। আবার কোথাও মাযারটাই হলো বাউল কোন সঙ্গীতশিল্পীর। সেক্ষেত্রে গাঁজা সেবন তো নিয়মিত আচারের মধ্যেই পরে। ওখানে যিয়ারতের কোন বিষয় নেই। এজন্য ঐসব লালসালু ও বাউলদের কবরগুলোকে আ্মরা মাযার বলবো না। তাদের অনেক কবর তো বুতখানায় পরিণত হয়েছে।
যাই হোক, কি কি শিরক-বিদায়াত ও অন্যায় কর্মকাণ্ড মাজার এলাকায় হয়, দেখা যাক:
১। সিজদা দেয়া
২। মোমবাতি জ্বালানো। (এমনিতে মোমবাতি মানুষ জ্বালাতেই পারে। অন্ধকার রাত। লোকজনের সুবিধান জন্য জ্বালানোই যায়। কিন্তু ঝলমলে ইলেকট্রিসিটির বাতির নিচে মোমবাতি জ্বালিয়ে কবর আর মোমবাতির সামনে মাথা নিচু করে থাকা একটা খারাপ মতলবের নির্দেশ করে।)
৩। মাজারের চারপাশ ঘিরে তাওয়াফ করা।
৪। মাজারের মাথার কাছে কোন ঘণ্টা বা ঘুরানোর মতো একটা কিছু থাকে। সেটা ধরে একটা ঘুটা দেয়া হয়। মনে করা হয় এতে মনের আশা পূর্ণ হবে।
৫। মাজার প্রাঙ্গনে যদি একটা মোটাসোটা গাছ থাকে, তাহলে তো কথাই নাই। গাছ বেচারার সারা শরীরে লাল সুতা বেঁধে বারোটা বাজিয়ে দেয়া হবে। গাছটা যদি বটগাছ হয় বা আরেকটু বেশি বয়সের হয়, তাহলে পুরা কেল্লাফতে। এই গাছকে রীতিমত সেজদা করা হবে। গাছে পানির বদলে গোলাপজল ছেটানো হবে। মোমবাতি জ্বালানো হবে। আশেপাশে পৌত্তলিক সম্প্রদায় থাকলে মাঝেমধ্যে সিঁদুর ইত্যাদিও চলে আসবে।
৬। মাজারে শায়িত বুযুর্গকে ঘুষ দেয়ার অংশি হিসেবে মাজারের উপর টাকা ছিটানো। শিরকের পর এটাই সবচেয়ে জঘন্য কাজ বলে আমার মনে হয়। যে বুযুর্গ সারাজীবন দুনিয়াবিমুখ ছিলেন, তাঁকে এভাবে অসম্মানিত করা খুব গর্হিত কাজ। কেউ যদি মাজার স্টেট চালানোর জন্য খরচ করতে চায়, সেটা ভিন্নভাবে দিলে দিতে পারে।
৭। নানা রকমের কুফরি কালাম সম্বলিত তাবিজ-কবজ বিক্রি। যেমন প্রাণীর হাড়, পৈতা, পুরোনো গাছের শেকড়, ভাগ্য গণনা, জটাধারী ব্যক্তিবর্গ, দলবদ্ধ গাঁজাসেবন, নারী-পুরুষ অবাধ অবস্থান ইত্যাদি ইত্যাদি।
৮। মাজার ধুইয়ে পানি পান বিক্রি করা ও পান করানো ইত্যাদি ইত্যাদি। ভারতে সারমাদ শহীদের মাজারের নিচ দিয়ে পানি যাবার ব্যবস্থা করা আছে। সেই পানি রীতিমত বিক্রি করা হয়।
৯। মাজারের আশেপাশের কোনো পুরোনো পাথর, লৌহখণ্ড ইত্যাদি থাকা। আমি খান জাহান আলী র. এর মাজারের পাশে একটি নদীতীরে পাথরের একটি স্তম্ভ আছে। কথিত আছে, এটা সে সময়ে জাহাজ ভেড়ার একটি ঘাট ছিল। মসজিদের পাথরগুলো নদীপথে এখান দিয়ে আনা হতো। স্থানীয় হিন্দুরা এখানে দুধ ও সিঁদুর দিয়ে পূজা করে।
১০। কোনও কোনও মাজারে গায়রুল্লাহর নামে মুরগিসহ বিভিন্ন পশু-পাখি জবাই করা হয়। তবে মুসলিমপ্রধান অঞ্চলে এটা অনেক দূর্লভ।
প্রতিকারের উপায়:
১। ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
২। মাজারের নিয়ন্ত্রণ স্থানীয় সুফীবাদী পণ্ডিত ব্যক্তিদের হাতে ন্যাস্ত করা। মাজার প্রাঙ্গনে মুহতাসিব বা ন্যায়পাল স্টাইলে হকপন্থী সুফিদের নিয়োগ করা।
৩। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ডেকে মদখোর-গাঁজাখোর লোকদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা।
৪। নিয়মিত ওয়াজ নসিহতের ব্যবস্থা করা। সেখানে মাজার যিয়ারতের উদ্দেশ্য, পদ্ধতি, ফযিলত, করণীয়, বর্জনীয় ইত্যাদি বয়ান থাকবে। এছাড়া যিনি মাজারে আছেন, তাঁর দাওয়াতী জীবন কর্মধারা ইত্যাদির উপরও বয়ান থাকবে। প্রত্যেক সুফিই খাঁটি তাওহিদবাদী ও শিরকের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাই তাঁদের জীবনধারা আলোচনা করলে বিরাট ফলাফল পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।
৫। বেশিরভাগ ভণ্ডামীর মূল উৎস নগদ অর্থে। এজন্য টাকা পয়সা কোত্থেকে আসে আর কোথায় যাচ্ছে, খেয়াল রাখা প্রয়োজন। মাজারজীবীরা নিজেদের আর্থিক সুবিধার স্বার্থে নানা রকম বুজরুকি করে মানুষের অন্ধ বিশ্বাসকে পুঁজি করে। উদ্দেশ্য পয়সা কামানো। অনেক মাজারেই কয়েক হাত লম্বা ইয়া মোটা মোমবাতি দেখা যায়। এই বিজলিবাতির যুগে মোমবাতি বেচার কি ফায়দা? এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এরকম নানান জিনিস আছে। অনেক মাজারে এসব মোমবাতি-আগরবাতি মাজারের লোকজন বেচে। এরপর নির্বোধ ভক্তবৃন্দ সেগুলো উচ্চমূল্যে কিনে মাজারে দেয়। মাজারের লোকেরা আবার সেগুলো দোকানে দেয়। একই জিনিস একাধিকবার বিক্রি হতে থাকে।
৬। বিনামূল্যে লিফলেট, বইপত্র ইত্যাদি বিতরণ করা। মাজারপ্রাঙ্গনে কোন গাছপালা থাকলে এবং লোকজন শিরকের দিকে ধাবিত হয়ে সিজদা দেয়া শুরু করলে, গাছপূজা শুরু করলে গাছ কেটে ফেলা। প্রয়োজনে এই গাছ কেটে নিজের বাড়িতে একটা ফলবান বৃক্ষ লাগান। উমর রা, বাইয়াতে রিদওয়ানের বৃক্ষ কেটে ফেলেছিলেন মানুষের বিভ্রান্তির আশঙ্কায়। মানুষের ঈমান আকীদা রক্ষায় প্রয়োজনে আমাদেরও এটা করতে হবে।
৮। নারী যিয়ারতকারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা।
৯। মাজারের সাথে একটি মাদরাসা স্থাপন করা। প্রকৃত সুন্নাহপন্থী-তাসাউফপন্থী মাদরাসার হতে হবে।। মাদরাসার তালবে এলেমরাই তখন গাঁজাখোর ও বিদাতী মানুষদের রুখে দেবে।
সচেতনতা বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। কবর বা মাজার কখনই ক্লাসিকাল সুফি সংস্কৃতিতে প্রধানতম অনুষঙ্গ ছিল না। সুফিগণ বুযুর্গদের কবর যিয়ারত করতেন। কিন্তু তাদের জীবন কখনও মাযারমুখী ছিল না। শরীরীভাবে কোনও সুফি শায়খের মাজারে প্রয়োজন হলে গিয়েছেন। আবার আধ্যাত্মিকভাবে রুহানি তায়াল্লুক জারি রেখেছেন সবসময়। ঐটাই তাদের কাছে বেশি জরুরী ছিল।
সুফিদের ইতিহাস পড়লেও কখনও এমন একজন সুফি শায়খ পাওয়া যায় না, যিনি একটি মাযারকে কেন্দ্র করে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন বা মাযারই ছিল তার জীবনের পরম বিন্দু।
তাঁরা পীরের জীবদ্দশায় যথাসম্ভব খিদমত করেছেন। পীরের ইন্তিকালের পর রুহানি তায়াল্লুক জারি রেখেছেন। রুহানি ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ ঠিকমতো পেয়েছেন। পৃথিবীময় ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাওহিদ-রিসালাতের দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রান্তে প্রান্তে। মুঈনুদ্দীন চিশতী র. যদি তাঁর পীর উসমান হারুনি র. এর মাজারে থেকে যেতেন, মুজাদ্দিদে আলফে সানি র. যদি তাঁর পীর খাজা বাকি বিল্লাহ র. এর মাজারে থেকে যেতেন, শাহ জালাল র. যদি তাঁর পীর শায়খ আহমদ কবির সুহরাওয়ার্দি র. এর মাজারে থেকে যেতেন, তাহলে আমরা এই উপমহাদেশে ইসলাম কোথায় পেতাম?
তাসাউফের মূল বইগুলো পড়ে দেখুন- আর রিসালাতুল কুশায়রিয়্যাহ, কুতুল কুলুব, আওয়ারিফুল মাআরিফ, আল লুমা, আত তাআররুফ। সবগুলো বইয়ের পুরোটা জুড়ে তাওহিদ, রিসালাত আর আখলাকের আলোচনা। দুরবীন দিয়ে খুঁজলেও মাকাম, কবর, দারিহ-ইত্যাদি পাওয়া মুশকিল হবে। আর মাযার তো পাওয়া যাবেই না। অথচ এখন সুফি সংস্কৃতির সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মাজার এবং মাজারের সাজসজ্জা। যে যত বেশি বাতি মাজারে জ্বালাতে পারবেন, তিনি তত বড় সুফি।
কোথায় রুহানি তাওয়াজ্জুহ?
কোথায় আখলাকে সুফিয়াঁ?
কোথায় দাওয়াতে তাওহিদ ওয়া রিসালাত?
নিচের যেকোন একটা সিদ্ধান্তে আপনাকে আসতে হবে:
১। জুনায়েদ বাগদাদী, সাররি আস সাকতি, যুন-নুন মিসরি এরা সুফি ছিলেন না। এরা তাসাউফের কিছু জানতেন না। আমরা বঙ্গদেশে তাসাউফের নামে যা চালাচ্ছি এটাই তাসাউফ।
২। জুনায়েদ, সাররি, যুন-নূন র. প্রমুখ প্রকৃত সুফি ছিলেন। আর আমরা যা তাসাউফের নামে চালাচ্ছি-আগড়ম বাগড়ম।
- এখন সংস্কারের সময়। প্রকৃত তাসাউফের এসেন্স আজ বিপন্ন। তাই কিছু কথা কঠিন ও রুঢ় হওয়ায় পাঠকবৃন্দের মনে কষ্ট হলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। অতএব যারা সুফিপন্থী আছেন, মাজারে বিন্দুমাত্র বেশরা কিছু হলেই মুখ খুলুন। নয়তো পূর্বযুগের সুফিদের রুহানি বদদুআর ভাগীদার হবেন। তাসাউফ আজকে জুলমের শিকার। এই জুলম থেকে তাসাউফকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদেরই।