বিশ্বের ধর্মপ্রাণ অগণিত মুসলমান রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখকে রাসূলল্লাহ ﷺ এর বরকতময় শুভ জন্মের দিন বলে বিশ্বাস করেন। গুরুত্ব সহকারে গরীব মিসকিনদেরকে সাদকা করেন। বিবিধ সাওয়াবের কাজ করেন, মাহফিলে মিলাদ ও আলোচনা সভা করেন।
গোপন কৌশলে যারা মুসলমানের অন্তর থেকে ইশকে রাসূল ﷺ বিদূরিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত তারা রবিউল আউয়াল মাসের ঐ দিনের গুরুত্ব হ্রাস করার কাজে বড় ব্যতিব্যস্ত থাকেন। তাদের অপ্রয়োজনীয় কষ্ট দূর করার মতো কোনো ঔষধ আমাদের কাছে নেই। তবে তাদের আরও বিচলিত করার মতো কাজে আশিকানে মুস্তফা যে সাধ্যমতো চেষ্টা করেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
গোপন কৌশল অবলম্বনে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রচেষ্টার মধ্যে একটি হলো, শুভ জন্মের তারিখ সম্পর্কে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করে মুবারক দিনের গুরুত্ব হ্রাস করার চেষ্টা করা। তাই এ বিষয়ে কিছু তথ্য পেশ করা জরুরী মনে করছি। রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা ﷺ এর শুভ জন্মের তারিখ যে সোমবার এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এ বিষয়েও উলামায়ে কিরাম প্রায় একমত যে, যে মাসে রাসূল ﷺ জন্মগ্রহণ করেন, সে মাসের নাম রবিউল আউয়াল।
ইসলামের সঠিক ইতিহাস যে সকল নির্ভরযোগ্য মুসলিম ঐতিহাসিকগণের মাধ্যমে সংরক্ষিত আছে, তাদের মধ্য থেকে অন্যতম কয়েকজনের উক্তি নিম্নে উদ্ধৃ হলো,
১) ইবনে জারীর যিনি প্রথম শ্রেণির মুফাসসীর বলে নিরীক্ষকগণের নিকট স্বীকৃত, তিনি তারীখে তাবারী ২য় খণ্ডে এ বিষয়ে সুচিন্তিত নিম্নরূপ অভিমত পেশ করেছেন, রাসূল ﷺ (আমুল ফিলে, অর্থাৎ যে বছর আবরাহা কা’বা শরীফ ধ্বংস করার জন্য এসেছিল) রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন।
২) আল্লামা ইবনে খালদুন যিনি ইতিহাস ও দর্শন বিষয়ের ইমাম বলে সুপরিচিত। তিনি তারিখে ইবনে খালদুন ২য় খন্ডে এ বিষয়ে লিখেছেন, আমুল ফিলে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ রাসূল ﷺ জন্মগ্রহণ করেন। পারস্যের সম্রাট নওশেরওয়ার রাজত্বকালের চল্লিশতম বৎসর ছিল।
৩) ইমাম মুহাম্মদ বিন ইসহাকের এ বিষয়ে উক্তি নিম্নরূপঃ
রাসূল ﷺ ১২ রবিউল আউয়াল মাসে আমুল ফিলে সোমবার দিনে জন্মগ্রহণ করেন। কুরআন, সুন্নাহ এবং সীরাত বিষয়ে মুসলিম জাতির দিকদর্শক গুণি-জ্ঞানীগণের উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার হলো রাসূল (সা.) এর শুভ জন্ম তারিখ। তাই তারা অন্য কোনো অভিমতের উল্লেখও করেননি।
প্রখ্যাত মুফাসসীর আল্লামা ইবনে কাছীর তৎপ্রণীত সীরাত গ্রন্থে লিখেছেন, রাসূলল্লাহ ﷺ সোমবার দিন জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম মুসলিম (র.) সহীহ মুসলিম শরীফে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যে, এক বেদুঈন নিবেদন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! সোমবারের রোযা সম্পর্কে আপনি কি মন্তব্য করেন? হুযূর ﷺ উত্তরে বললেন, এই দিন ঐ দিন যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনে আমার উপর ওহী অবতীর্ণ হয়।
তারপর আল্লামা ইবনে কাছীর লিখেছেন, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, রাসূলল্লাহ ﷺ এর জন্ম হয় সোমবার দিন। মক্কা শরীফ থেকে সোমবার দিনে হিজরত করেন। মদীনা মুনাওয়ারায় সোমবার দিনে পৌঁছেন। ইন্তিকাল করেন সোমবার দিন। যে দিনটিতে হাজরে আসওয়াদ পবিত্র হাতে যথাস্থানে স্থাপন করেন সে দিনটিও ছিল সোমবার। তারপর ইবনে কাছীর বলেন, জমহুরের মত হলো রাসূল ﷺ ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।
ভারত উপমহাদেশের অন্যতম শায়খুল হাদীস হযরত শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) মাদারিজুন্নুবুওয়াত কিতাবে উল্লেখ করেন, “সঠিকভাবে অবগত হও জমহুর সীরাতবেত্তাগণ ও ঐতিহাসিকগণের মতে রাসূল ﷺ ‘আমুল ফিলের’ (আবরাহার ধ্বংসের) চল্লিশ দিন বা ৫৫ দিন পর জন্মগ্রহণ করেন।” উল্লেখিত মত সবচেয়ে বিশুদ্ধ। সুখ্যাত সুপরিচিত মত হলো মাস ছিল রবিউল আউয়াল এবং তারিখ ছিল ১২।
শায়খুল হাদীস আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) তারপর কয়েক ছত্র ফার্সি কবিতা লিখেছেন। নিম্নে তিন ছত্র কবিতার ভাবার্থ উদ্ধৃত হলো,
১) “রাসূল ﷺ এর জন্মের রাত কত রৌশন রাত ছিল। মক্কা শরীফের দরজা থেকে শামের এলাকা পর্যন্ত রৌশন হয়েছিল।
২) যে কোনো ধরনের লু-হাওয়া সে ঘাসকে শুস্ক করতে পারেনা, যে ঘাসকে সতেজ রেখেছে রাসূল ﷺ এর কৃপাদৃষ্টি।
৩) আল্লাহতাআলার শোকর দুনিয়া ও দ্বীনের সব নিআমত আমি (হক্কি) লাভ করেছি। ঐ বাদশাহ অর্থাৎ রাসূল ﷺ এর দৌলতখানা থেকে।”
শুনা যায় কেউ কেউ জনৈক মাহমুদ পাশা জ্যোতির্বিদের মত ব্যক্ত করেছেন যে, শুভ জন্মের তারিখ ছিল রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ। মুসলিম সমাজের দিকদর্শক গুণি-জ্ঞাণীগণের অভিমতের বিরুদ্ধে জনৈক ব্যক্তির জ্যোতির্বিদ্যা নির্ভর উক্তির মূল্য কতটুকু বিজ্ঞ পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারেন। জাস্টিজ পীর করমশাহ আল আযহারী (র.) দ্বিয়াউন্নবী কিতাবে মাহমুদ পাশার উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। তারা মাহমুদ পাশাকে এবং তার দেশ কোথায় এ সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
অনেকের মতে মাহমুদ পাশা ছিলেন মিশরের অধিবাসী, আবার অনেকের মতে মক্কাবাসী, আবার অনেকের মতে তুরস্কবাসী। যদি ধারণা করা হয় যে, মাহমুদ পাশা জ্যোতির্বিদ্যার আলোকে এ বিষয়ে কিছুটা নিরীক্ষণ করে একটি অভিমত পেশ করেছেন। তবে সাহাবায়ে কিরাম তাবেঈন ও সুখ্যাত মুসলিম মনীষীগণের মতামতের বিপরীত ঐ ব্যক্তির নিরীক্ষণকে সঠিক বলা যায় না।
অবশেষে বলা যায় জ্যোতির্বিদগণ রাসূল ﷺ এর শুভ জন্মের তারিখ সম্পর্কে নিরীক্ষণ করে যদিও বিবিধ মত প্রকাশ করেছেন, কিন্তু এতো বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ঠিক করার দায়িত্ব কেবলমাত্র জ্যোতির্বিদদের হাতে ন্যস্ত করা যায় না। মুসলমানগণ গুরুত্ব সহকারে পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখের দিন ঈদে মিলাদুন্নবী ﷺ হিসেবে পালন করে আসছেন এবং কিআমত পর্যন্ত এ আমল জারি থাকবে, ইনশাআল্লাহ।