যে ব্যক্তি উসূলি কায়দায় চলে না, ফুকাহাদের মানহাজ বুঝে না—সে শরঈ বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করে (নব্য বিষয়ে কোনো বিভাজন করে না)। তারা বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হয় এবং মনে করে প্রশ্নগুলো নিষিদ্ধতার কথা বলে। ফলে নব্য বিষয়ের বৈধতাকে অস্বীকার করে। যেমন, তারা বলে থাকে-
১) মাহফিলে মীলাদুন্নবি কি ইবাদাত? যদি ইবাদাত হয় তাহলে শরঈ দলীল কী? তারা দালালাতে আম বা ব্যাপকতায় অন্তর্ভূক্ত দলীল ও কাওয়ায়েদে কুল্লিয়া বা সার্বিক প্রায়োগিক নীতি না মেনে ‘খাস’ তথা প্রচলিত পদ্ধতিতে বর্ণিত দলীল চায়?
২) যদি মাহফিলে মীলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করা ইবাদত হত তাহলে কিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ইবাদত ছেড়ে দিলেন? আর কেনো উম্মাতের কাছে পৌঁছালেন না?
৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিরা কি মীলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাহফিল করেছেন? অথচ সাহাবিরাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন!
এই প্রশ্নগূলোর মূল কারণ হলো, মাহফিলে মীলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাস কোনো দলীল নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নিজে করেন নাই এবং উম্মাতের জন্যেও এমন কথা বলেন নাই। তাছাড়া সাহাবিদের থেকেও এই আমল প্রমাণিত নয়, অথচ নেক আমলের প্রতি উম্মাতের মধ্যে সর্বাধিক আগ্রহী এবং আল্লাহর দীনের মূল আবেদন অনুধাবনে তারাই সবচেয়ে উপযুক্ত শ্রেণী… সুতরাং এইসব কারণে মীলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাহফিল বিদয়াত!
প্রকৃতপক্ষে বিদয়াত সম্পর্কে তাদের উত্থাপিত এই পদ্ধতি ফিতনার দরজা উম্মুক্ত করে এবং ইলমি মানহাজ থেকে অনেক দূরে। নিম্মে তাদের অভিযোগের অসারতা তুলে ধরছি।—
প্রথমত: উলামা এবং ফকীহগণের অনুসৃত নীতি হল- নব্য বা আধুনিক বিষয়কে শরঈ মানদণ্ডে যাচাই করা। শরঈ মানদণ্ডের বিপরীত হলে তারা প্রত্যাখ্যান করতেন। আর যদি শরঈ মানদণ্ডের অনুকূলে হয়, শরীয়তের উদ্দেশ্য পূরণ করে এবং উসূলের আওতায় উদ্ভুত হয়ে থাকে, তখন এমন বিষয়টি গ্রহণ করতেন। সকল উলামা থেকে এ নীতিই প্রমাণিত হয়।
ইমাম শাফিয়ি রাহিমাহুল্লাহ (২০৪ হি.) বলেন, নব্য আবিষ্কৃত বিষয় দুই ধরনের। যথা,
1- ما أحدث يخالف كتابا أو سنة أو أثرا أو إجماعا فهذه بدعة الضلال.
2- وما أحدث من الخير لا يخالف شيئا من ذلك فهذه محدثة غير مذمومة
‘১) নতুন আবিষ্কৃত বিষয় যদি কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবিদের আমল অথবা ইজমার বিপরীত হয়, তাহলে তা বিদয়াতে দ্বালালাহ বা নব্য ভ্রষ্টতা।
২) যদি তা উত্তম উৎস থেকে উদ্ভুত হয় এবং কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবিদের আমল ও ইজমার বিপরীত না হয়, তাহলে এই নব্য আবিষ্কৃত বিষয় গাইরে মাজমুমা তথা নিন্দনীয় নয়।’(১)
শাইখুল ইসলাম আবু শামাহ আল মাকদিসি (৫৯৬-৬৬৫ হি.) ‘আল বায়িস আলা ইনকারিল বিদয়ি ওয়াল হাওয়াদিস’ গ্রন্থে বলেন-
فالبدع الحسنة متفق على جواز فعلها والاستحباب لها ورجاء الثواب لمن حسنت نيته فيها؛ وهي كل مُـبْـتَدَع موافق لقواعد الشريعة غير مخالف لشيء منها ولا يلزم من فعله محذور شرعي
‘বিদয়াতে হাসানার আমল সর্বসম্মতভাবে জায়েয ও মুস্তাহাব। ব্যক্তির নিয়ত বিশুদ্ধ হলে এতে সাওয়াবেরও আশা করা যায়। তবে তা সেসব নতুন বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে যা শরঈ ক্বায়েদা ও মানদণ্ডের মুখালেফ না হয়ে মুওয়াফেক তথা আওতাধীন হয়েছে এবং এতে শরীয়তে নিষিদ্ধ কোনো কাজ হয় না।’
ইমাম শাত্বিবি রাহিমাহুল্লাহ (৭৯০হি.) ‘আল ইতিসাম’ গ্রন্থে বিদয়াতে মারফুদ্বাহ বা পরিত্যাজ্য নতুন বিষয়ের পরিচয় তুলে ধরে বলেন, এগুলোর শরঈ কোনো ভিত্তি থাকবে না। যেমন,
১) কুরআনে নেই,
২) হাদীসে নেই,
৩) ইজমাতে নেই,
৪) কিয়াসে নেই এবং
৫) সার্বিকভাবে কিংবা পৃথকভাবেও কোনো নির্ভরযোগ্য আলিমের নিকট থেকে এর কোনো উৎস পাওয়া যায় না।
সুতরাং ইমাম শাত্বিবি রাহিমাহুল্লাহ এর বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, নতুন বিষয়ের প্রামাণিকতা যদি নির্ভরযোগ্য হয়, তাহলে এটি বিদয়াতে মারফুদাহ বা পরিত্যাজ্য হবে না।
উল্লেখিত মূলনীতির আলোকে নব্য বিষয়ে আমাদের হুকুম কাওয়ায়েদে শরীয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সুতরাং আমাদের এমন কথা গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে কোনো ফলাফল দিবে না, যদি আমরা সকল বিষয়কে বাহ্যতঃ সাহাবিদের সম্পাদন করা বা না করা দিয়ে বিবেচনা করি। কেননা, অনেক বিষয় আছে যা শরঈ নীতিমালার আলোকে উদ্ভুত এবং সাহাবিরা তা করেছেন, অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নাই। তাবেয়িরা অনেক কাজ করেছেন, যা সাহাবিদের থেকে প্রমাণিত নয়। এভাবে আতবাউত তাবেয়ীনের অনেক কাজ যা তাবেয়িদের থেকে সম্পাদনের দলীল পাওয়া যায় না। ঠিক এরকমই তাদের পরবর্তী যুগের উলামারা অনেক কাজ করেছেন, যা পূর্ববর্তী আলিমরা করেন নাই।
আমি আমার কিতাব ‘আল বিদয়াতুল ইদ্বাফিয়্যাহ’-তে এমন প্রচুর উদাহরণ এনেছি, যেখানে দেখা যায় কতেক সাহাবি থেকে এমন অনেক কাজ করার নজির মিলে, যা নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেন নাই, এমনকি খুলাফায়ে রাশেদাও করেন নাই। তাবিয়িদের মধ্যে এমন অনেক আমলের প্রচলন ছিল, যা সাহাবিদের যুগে ছিলো না। এরকম বৈচিত্র্যময় আমল সম্পর্কে কেউ বিস্তারিত জানতে চাইলে, কিতাবটি পড়ে দেখতে পারেন। সে কিতাবে উল্লেখিত কিছু আলোচনা এখানে উপস্থাপন করছি।—
আলি রাদ্বিইয়াল্লাহু তায়ালা আনহু লোকদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দরূদ পড়া শিখাতেন। তিনি বলতেন—
اللهم يا داحي المدحوات ويا باني المبنيات ويا مرسي المرسيات … اجعل شرائف صلواتك ونوامي بركاتك ورأفات تحننك، وعواطف زواكي رحمتك على محمد عبدك ورسولك…
হাদীসটি মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবা, মুজামুত তাবারানি আল আওসাত ও ইমাম আজুররি (৩৬০ হি.) এর আশশারিয়াহ-এ এসেছে। (২)
তাহলে এটা বলা কি সঠিক বা জায়েয যে, কেনো আলি রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু লোকদের দুরূদ পড়ার মতো ইবাদত এমন শব্দে শিক্ষা দিলেন, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পাওয়া যায় না? আবু বাকর রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু এই উত্তম দুরূদ সম্পর্কে জানলেনই না অথচ আলি রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু মানুষকে তা শিক্ষা দিলেন? এভাবেই অন্য সকল প্রশ্ন করা যায়, যেমনটি তারা করে।
উসমান রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু জুময়ায় দুই আযানের নিয়ম প্রবর্তন করেছেন এবং তৎকালীন সকল সাহাবি এই আমলের উপর ইজমা তথা একমত পোষণ করেছেন। আমাদের জন্য কি এটা বলা সঠিক বা জায়েয যে, যদি জুময়ায় দুই আযান দেওয়া ইবাদাত হতো, তাহলে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আমলের নির্দেশনা দিতেন। আর যদি এইরকম দুইবার আযান দেওয়া দীনের অন্তর্ভূক্ত ও উত্তম হতো, তাহলে কিভাবে আমলটি তাঁর থেকে যারা বড় সাহাবি, তাদের নিকট অজ্ঞাত রয়ে গেলো? কিভাবে আবু বকর ও উমার রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহুমা আমলটি করলেন না?
ইমাম এবং ফকীহগণ কি নব্য বিষয়ের ক্ষেত্রে এরকম বক্তব্য দিয়েছেন?
কিছু উদাহারণ:
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু, হাসান বাসরি রাহিমাহুল্লাহ এবং একদল সালাফ আরাফার দিন আরাফার ময়দান ছাড়া অন্যান্য জায়গায় আরাফার মত সমবেত (তারীফ)-এর কথা বলতেন। মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবাহতে নিজের সনদে হাসান বাসরি রাহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন—
أوَّلُ من عَـرَّفَ بالبصـرة ابن عباس
‘বাসরায় প্রথম যিনি আরাফার সাদৃশ্যকরণ (তারীফ) করেছেন তিনি ইবনু আব্বাস রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু।’
ইমাম আরসাম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলকে এই তারীফ বিষয়ে প্রশ্ন করলাম। তিনি বলেন, ‘এতে কোনো সমস্যা নেই। কারণ এই আমল একাধিক নির্ভরযোগ্য আলিম করেছেন । যেমন, হাসান বাসরি, বাকর আল মুযানি, সাবিত আল বানানি এবং মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াসি প্রত্যেকেই আরাফার দিন শহরের মসজিদে উপস্থিত হতেন।’
ইবনু তাইমিয়াহ বলেন: মুসলিম ব্যক্তি আরাফার দিন যিকর ও দুয়ার উদ্দেশ্যে তার এলাকার মসজিদে অবস্থান করবে। এটা হলো অন্যান্য শহরে করা তারীফ এবং এই ব্যাপারে উলামায়ে কিরাম মতানৈক্য করেছেন। এই আমল করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু…
আমি আমার কিতাব “আল বিদয়াতুল ইদ্বাফিয়্যাহ”-তে এই মাসয়ালা এবং এসম্পর্কে ফুকাহাদের বক্তব্য আলোচনা করেছি। কেউ চাইলে কিতাবটিতে বিস্তারিত দেখে নিতে পারেন। তবে আমি বলবো, আমাদের জন্যে এইসব মাসয়ালায় সাহাবি এবং সুন্নাহর ইমামদের উপর অভিযোগ করা কি ঠিক হবে? এইরকম যদি বলা হয়-
যদি তারীফ আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট ইবাদাত হতো অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিষয়ে নির্দেশনা দিতেন; আর যদি তারীফ উত্তমই হতো, তাহলে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমলটি করতেন। অন্যথায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি উম্মাতের কাছ থেকে এই উত্তম আমলটি গোপন করেছেন? খুলাফায়ে রাশিদীন আবু বাকর, উমার, উসমান এবং আলি রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহুম কি তারীফের হুকম সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন আর ইবনু আব্বাস রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহু তা জেনে ফেললেন? তাহলে কি, তাহলে কি, তাহলে কি… ইত্যাদি এইধরনের প্রশ্ন তুলা সঠিক হবে? না উত্তম মানহাজ হলো, নতুন মাসয়ালায় গভীর দৃষ্টি দেওয়া এবং তার হুকুম বের করার জন্য শরীয়তের মানদণ্ডে যাচাই করা?
ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ ফজরের পর সুর্যোদয় পর্যন্ত সুরা ফাতিহাহ পড়তেন। কিন্তু এই আমল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত নয়, প্রমাণিত নয়। এমনকি কোনো একজন সাহাবি থেকেও এমন পদ্ধতির প্রমাণ নেই। হাফিজ উমার ইবনু আলি বাযযার “আল আ‘লামুল উলয়াহ ফি মানাকিবি ইবনি তাইমিয়া” গ্রন্থে (৩৮ পৃষ্ঠায়) বলেন: ‘আমি দিমাশকে অবস্থানের সময় সারাদিন এবং রাতের বেশিরভাগ সময় ইবনু তাইমিয়ার সাহচর্যে থাকতাম। তিনি আমাকে তার নিকটে রাখতেন এমনকি পাশে বসাতেন৷ তখন আমি শুনতে পেতাম তিনি কী পড়ছেন ও যিকির করছেন। আমি খেয়াল করতাম তিনি সুরা ফাতিহাহ তিলাওয়াত করছেন বারবার। তার সুরা ফাতিহাহ তিলাওয়াত চলতো ফজর থেকে সুর্যোদয় পর্যন্ত।’
শায়খ তাকিয়ুদ্দীন ইবনু তাইমিয়াহ গুরুত্বের সাথে নির্দিষ্ট কিছু পড়তে কোনো সমস্যা মনে করেন নাই। তা হলো সুরা ফাতিহা। তিনি নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের সহিত সুরাটি পড়তেন। তাহলে কিভাবে আমরা পাশ কাটাবো যদি শায়খ ইবনু তাইমিয়ার এই আমলের দিকে লক্ষ্য করে প্রশ্নগুলো পাই। আমরা যদি বলি, ‘এই কাজ ইবাদত কি না?’ এর জবাব হবে, ‘অবশ্যই এই কাজ ইবাদাত, অভ্যাস বা খামাখা নয়।’ আবার বলি, ‘এই আমল তথা সুরা ফাতিহাহ ফজর থেকে সুর্যোদয় পর্যন্ত পড়তে থাকা কি শরীয়তে দলীল দ্বারা প্রমাণিত আছে?’ জবাব হবে, ‘না! এমন কোনো বক্তব্য নেই।’ তাহলে আমরা যদি আবার প্রশ্ন করি, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি এই উত্তম আমল উম্মাতের কাছে গোপন রেখেছেন? এই আমল কি সাহাবি-তাবেয়িগণের নিকট অজানা ছিলো ? অথচ তারা ছিলেন দীনি বিষয়ে সবচেয়ে জ্ঞানী এবং এসব ক্ষেত্রে সর্বাধিক আগ্রহী। তথাপি উনারা এই আমল সম্পর্কে অজ্ঞাত রয়ে গেলেন আর ইবনু তাইমিয়াকে আমলটি সম্পর্কে অবগত করা হলো?’
এই ভিন্নতার পরেও আমরা এমন অভিযোগ করবো না। শপথ আল্লাহর! আমরা ইবনু তাইমিয়ার উপর এমন অবান্তর প্রশ্ন তুলবো না৷ আমরা মনে করি আলোচিত মাসয়ালার বিষয় উনার কাছে প্রশংসনীয় হওয়ায় তিনি এই কাজ করেছেন।
ইবনু তাইমিয়াহ পরিত্যক্ত নির্জন জায়গায় যেতেন। সেখানে মাটিতে কপাল ঘষতেন আর আল্লাহর সীমাহীন ক্ষমতার কাছে নিজেকে খুব অসহায়ের মত পেশ করতেন। তিনি এটা করতেন ইবাদাত হিসেবে, যাতে আল্লাহ খুশি হয়ে তাঁর জন্য রহমতের দরজা খুলে দেন। অথচ এই আমলও এই বৈশিষ্ট্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নয়।
ইবনু আব্দিল হাদি তাঁর কিতাব ‘আল উক্বুদুদ দুররিয়্যাহ মিন মানাকিবি শাইখিল ইসলাম ইবনি তাইমিয়াহ’ গ্রন্থে (৪২ পৃষ্ঠা) বলেন, ইবনু তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলতেন, ‘মাঝেমধ্যে আমি কোনো একটি আয়াতের প্রায় একশত তাফসীর তালাশ করতাম (মর্ম বুঝতাম না), তখন আল্লাহর কাছে এর মর্ম জ্ঞান চাইতাম। তার নিকট চেয়ে বলতাম-
يا معلم آدم وإبراهيم علمني
হে আদম ও ইবরাহীমের শিক্ষক! আমাকে গভীর জ্ঞান দান করুন!
এভাবে আমি নির্জন মসজিদ ও পবিত্র স্থানে যেতাম। সেখানে নিজের মুখ মাটিতে লাগিয়ে আল্লাহর নিকট চাইতাম। বলতাম-
يا معلم إبراهيم فهمني
হে ইবরাহীমের শিক্ষক আমাকে মর্ম জ্ঞান দান করুন!’
উল্লেখিত বিষয়ে তার উপর আমাদের অভিযোগ তুলা কি সঠিক হবে? এবং এমন অভিযোগ দেওয়া যে, তিনি শরীয়তের ভিতরে নব্য আমল এনেছেন ও বিদয়াত করেছেন!!
আমরা বলি: তার এই কাজে যদিও খাছ দলীল নেই, তবে তা আল্লাহর নিকট নিজেকে অসহায় বানানো ও বিলীন করা এবং পূতপবিত্র মহীয়ানের কাছে চুড়ান্ত বিনয়ী হওয়ার আদেশসূচক দলীলে আমের অন্তর্ভূক্ত হবে।
তেমনিভাবে আমরা বলবো: যদিও শায়খ তাকিয়ুদ্দীন ইবনু তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ এর আমল শরীয়িতে নির্দিষ্ট ভাবে বর্ণিত নয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আদিষ্ট নয়, তাছাড়া সাহাবাহ-তাবেয়ীনরা দীন সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী, তাক্বওয়াবান, উত্তম কাজের জন্য অত্যাধিক আগ্রহী ও কল্যাণ কাজের পথ-পদ্ধতি সম্পর্কে বেশি জ্ঞাত হওয়া সত্বেও তাদের থেকে এই আমলের প্রকাশ না হওয়া ইত্যাদি সব ঠুনকো এশকালের জন্য আমলটি পরিত্যাজ্য বিদয়াতের নীতিতে পড়বে না।
সুতরাং নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মকে গুরুত্ব দেওয়া, সম্মান করা এবং মাহফিলে মীলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হারাম সাব্যস্তকারীগণ কি বিদয়াতের পার্থক্য করণে আমাদের মত সমান বক্তব্য দিবেন??!!
ইবনুল কায়্যিম তার ‘মাদারিজুস সালিকীন’ গ্রন্থে (১/৪৪৬ পৃষ্ঠা) ইবনু তাইমিয়া থেকে আমাদের জন্য এক আজীব বিষয় বর্ণনা করেছেন। ইবনু তাইমিয়া বলেন, ‘আধ্যাত্মিক পন্থা অনুসরণকারী ওলির বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বনের মাঝে রয়েছে যে, তারা নেশাকারী ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য লিখতেন-
يا حي يا قيوم لا إله إلا أنت أورثه ذلك حياة القلب والعقل
হে চিরঞ্জীব সত্ত্বা ও সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী! আপনি ছাড়া কোনো মালিক নেই! আপনি তাকে রোগের বদলে সুস্থ ক্বলব ও আকলের অধিকারী বানিয় দিন।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া ছিলেন ভাষাজ্ঞানের বড় পন্ডিত। একদিন আমাকে এই দুই নাম (আল হাইয়্যু, আল কায়্যুম)-এর ব্যাপারে বলেন, ‘ক্বলব তথা হৃদপিণ্ডে প্রাণ সঞ্চারে এগুলোর অনেক উপকারিতা রয়েছে।’ ইবনু তাইমিয়া এ দু নামকেই ইসমে আজম হিসেবে ইশারা করতেন। আমি তাকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ফরজ নামাজের সুন্নাত ও ফরজের মাঝখানে-
يا حَيُّ يا قَيُّوم، لا إله إلا أَنت، بِرَحمَتِكَ أَستَغِيثُ
এই বাক্যটি চল্লিশবার পড়বে, সে দুনিয়ায় ক্বলবে সালিম তথা প্রশান্ত হৃদয়ের জীবন লাভ করবে। তার অন্তর কখনও মারা যাবে না।’
এখানে দেখা যায়, শায়খ তাকিয়ুদ্দীন ইবনু তাইমিয়া এই যিকর নির্দিষ্ট সংখ্যার সাথে শর্ত করেছেন, শর্ত করেছেন নির্দিষ্ট সময়ের সাথে। এই নিয়মে পড়ার উপকারিতা প্রমাণ করেছেন এবং
من واظب عليه
‘যে সবসময় এই আমল করবে’
এই কথা দ্বারা মানুষকে এই আমলের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন।
ইবনুল কায়্যিমের কথা, ‘আর আল্লাহ ওয়ালাদের বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন’ এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, কোনো সালিক বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তি যদি যিকিরে শরীয়ত বর্ণিত নয় এমন কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করে উপকৃত হন, যেমন- ক্বলবের নিরাময়, আল্লাহর আনুগত্যে মনোনিবেশি হওয়া, পিছনের গুনাহের জন্যে অনুতাপ তৈরী হওয়া– তখন এই পদ্ধতির আমল ধারাবাহিক করায় কোনো নিষেধ নেই। এবং তিনি তার ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের এই নিয়মে আমলের উৎসাহ প্রদানে নিজের উপকার লাভকে দলীল হিসেবে পেশ করতে পারবেন।
আমরা এইসব নব্য বিষয়ে শায়খ ইবনু তাইমিয়ার ব্যাপারে তাদের (যারা মীলাদুন্নবিকে গুরুত্ব দেওয়া হারাম বলে) মত প্রশ্ন উত্থাপন করা কি ঠিক হবে? অভিযোগ তুলা, তিনি বিদয়াত করেছেন এবং দীনের মাঝে নতুন বিধান ঢুকিয়েছেন? তিনি কিভাবে এমন আমলকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, যা খোদ সাহাবি ও তাবেয়ীনদের নিকট অজানা ছিল? অথচ সাহাবি ও তাবেয়িরা দীনের ক্ষেত্রে বেশি জ্ঞানী, বেশি তাক্বওয়াবান এবং উত্তম কাজের প্রতি অত্যাধিক আগ্রহী… এভাবেই তার উপর প্রশ্ন করতে থাকা…
ইবনু তাইমিয়া মুসলিম ব্যক্তি নামাজে একই সুরা একাধিকবার পড়ার সময় গণনার সুবিধার্থে তাসবীহ ব্যবহার জায়েয বলেছেন। তার ‘আল ফাতাওয়া আল কুবরা’ (২/২৩৩ পৃষ্ঠা)-এ ‘নামাজে কুরআন তিলাওয়াতে দানা বা এজাতীয় কিছু দিয়ে গণনা করলে নামাজ বাতিল হবে কি না?’ এ প্রশ্নের জবাবে ইবনু তাইমিয়া বলেন, ‘যদি এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য হয় আয়াত গণনা, একই সুরা একাধিকবার পড়ার হিসাব করা, যেমন-
قل هو الله أحد
যদি এরকম একটি আয়াত দানা দিয়ে গণনা করা হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। আর যদি এই অর্থ ছাড়া ভিন্ন কোনো অর্থে প্রশ্ন করা হয়, তবে বিস্তারিত উল্লেখপূর্বক প্রশ্ন করা উচিত। আল্লাহ সর্বজ্ঞ!’
ইবনু তাইমিয়া নামাজের ভিতর তাসবীহ ব্যবহার করা, নামাজে নির্দিষ্ট সুরা নির্দিষ্ট সংখ্যায় পড়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা মনে করেন না। অথচ নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সালফে সালেহ থেকে এধরণের কোনো প্রমাণ নাই।
হে জ্ঞানবান বন্ধু! বিদয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে উপরের মাসয়ালাগুলোয় ভালোভাবে নজর দিন…
উলামাদের সরদার ইমাম মালেক ইবনু আনাস রাহিমাহুল্লাহ মদীনায় কোনো বাহনে চড়তেন না। তিনি বলতেন, ‘আমি সে মাটির উপর বাহনে চড়তে লজ্জাবোধ করি, যে মাটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুয়ে আছেন।’
আমরা কি ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ এর এমন অনুভুতির সম্মান প্রদর্শণকে তিরস্কার করবো? আমাদের নিকট খুব পরিচিত বিদয়াতের প্রশ্ন দিয়ে কি তাকে অভিযোক্ত করবো? আমরা কি ইমাম মালেককে বলবো যে, আপনি কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবিদের চেয়েও বেশি মহব্বতকারী হয়ে গেলেন? কারণ সাহাবিরা মদীনায় বাহনে চড়তেন। উনারা মদীনায় এই এই করেছেন…
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরে আবিষ্কৃত বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বতসিদ্ধ মূলনীতি, যা নীতিশাস্ত্রের অনেক বড় ইমাম সুলতানুল উলামা ইজ্জুদ্দীন ইবনে আব্দুস সালাম তার বক্তব্যে ইঙ্গিত করেছেন। সুলতানুল উলামা ইমাম আল ইজ্জ ইবনে আব্দুস সালাম (৬৬০ হি.) তার ‘কাওয়ায়িদুল আহকাম ফি মাসালিহিল আনাম’ গ্রন্থে (২/২০৪ পৃষ্ঠা) বলেন, ‘বিদয়াত বুঝার পদ্ধতি হল উদ্ভুত বিষয়কে কাওয়ায়িদে শারয়্যিয়ার আলোকে যাচাই করা। যেমন, নতুন বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক হলে তা ওয়াজিব বিদয়াত, কায়দার আলোকে নিষিদ্ধ হলে হারাম, পছন্দনীয় হলে মানদুব তথা সাওয়াবের কাজ, অপছন্দনীয় হলে মাকরূহ তথা নিন্দিত আর তা যদি কায়দায় পক্ষ-বিপক্ষ কোনো নির্দেশনা না আসে, তাহলে নব্য বিষয়টি জায়েয বা বৈধতার হুকুমে আসবে।
লেখক: বিশিষ্ট মুতাকাল্লিম ও ফকীহ
সুত্র: শায়খের অফিসিয়াল ফেইসবুক পোস্ট। লিংক https://m.facebook.com/saifalasri/photos/a.122435591262152/512131298959244/?type=3
………………………
ফুটনোট:
(১) আহমাদ ইবনুল হুসাইন আল বাইহাকি (৪৫৮ হি.), মানাকিবুশ শাফিয়ি, তাহকীক সায়্যিদ আহমাদ সাক্বার ১/৪৬৯ -অনুবাদক,
(২) আলি রাদ্বিইয়াল্লাহু আনহুর দুরূদ শিখানোর হাদীসটি অনেক লম্বা। দুরূদের সম্পূর্ণ হাদীস হলো-
اللَّهم يَا دَاحِيَ الْمَدْحُوَّاتِ ، وَيَا بَانِيَ الْمَبْنِيَّاتِ ، وَيَا مُرْسِيَ الْمُرَسِّيَاتِ ، وَيَا جَبَّارَ الْقُلُوبِ عَلَى فِطْرَتِهَا ، شَقِيِّهَا وَسَعِيدِهَا ، وَيَا بَاسِطَ الرَّحْمَةِ لِلْمُتَّقِينَ ، اجْعَلْ شَرَائِفَ صَلَوَاتِكَ ، وَنَوَامِي بَرَكَاتِكَ ، وَرَأْفَاتِ تَحِيَّتِكَ ، وَعَوَاطِفَ زَوَاكِي رَحْمَتِكَ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَرَسُولِكَ ، الْفَاتِحِ لِمَا أُغْلِقَ ، وَالْخَاتَمِ لِمَا سَبَقَ ، وَفَاتِحِ الْحَقِّ بِالْحَقِّ ، وَدَامِغِ جِيشَاتِ الْأَبَاطِيلِ كَمَا حَمَّلْتَهُ ، فَاضْطَلَعَ بِأَمْرِكَ مُسْتَنْصِرًا فِي رِضْوَانِكَ ، غَيْرَ نَاكِلٍ عَنْ قَدَمٍ ، وَلَا مُئِنٍّ عَنْ عَزْمٍ ، حَافِظٍ لِعَهْدِكَ ، مَاضٍ لِنَفَاذِ أَمْرِكَ ، حَتَّى أَرَى أَنْ أَرَى فِيمَنْ أُفْضِي إِلَيْكَ تَنْصُرُ بِأَمْرِكَ ، وَأَسْبَابِ هُدَاةِ الْقُلُوبِ ، بَعْدَ وَاضِحَاتِ الْأَعْلَامِ إِلَى خَوْضَاتِ الْفِتَنِ ، إِلَى نَائِرَاتِ الْأَحْكَامِ ، فَهُوَ أَمِينُكَ الْمَأْمُونُ ، وَشَاهِدُكَ يَوْمَ الدِّينِ ، وَبَعِيثُكَ رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ ، اللَّهُمَّ فَسِّحْ لَهُ مُفْسَحًا عِنْدَكَ ، وَأَعْطِهِ بَعْدَ رِضَاهُ الرِّضَى مِنْ فَوْزِ ثَوَابِكَ الْمَحْلُولِ ، وَعَظِيمِ جَزَائِكَ الْمَعْلُولِ ، اللَّهُمَّ أَتْمِمْ لَهُ مَوْعِدَكَ بِابْتِعَاثِكَ إِيَّاهُ مَقْبُولَ الشَّفَاعَةِ ، عَدْلَ الشَّهَادَةِ ، مَرَضِيَّ الْمَقَالَةِ ، ذَا مَنْطِقٍ عَدْلٍ ، وَخَطِيبٍ فَصْلٍ ، وَحُجَّةٍ وَبُرْهَانٍ عَظِيمٍ ، اللَّهُمَّ اجْعَلْنَا سَامِعِينَ مُطِيعِينَ ، وَأَوْلِيَاءَ مُخْلِصِينَ ، وَرُفَقَاءَ مُصَاحِبِينَ ، اللَّهُمَّ بَلِّغْهُ مِنَّا السَّلَامَ ، وَارْدُدْ عَلَيْنَا مِنْهُ السَّلَام
(মুসান্নাফ ইবনু আবি শাইবাহ, শায়খ আওয়ামাহ তাহকীককৃত হাদীস নং ৩০১৩৪; আল মুজামুল আওসাত লিত তাবারানি, দারুল হারামাইন প্রকাশনী, হাদীস নং ৯০৮৯) – অনুবাদক।