
চলমান প্রেক্ষাপটে কতিপয় ‘মুফতি’ ভাস্কর্য নির্মাণ করাকে জায়েয বলে ফতোয়া দিয়েছেন। তাঁদের দাবী হচ্ছে, মূর্তি নির্মাণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও পূজার উদ্দেশ্য ব্যতীত প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য নির্মাণ করা হারাম নয়। গত পর্বে আমরা কুরআন এবং হাদীসের সাথে সাহাবায়ে কেরাম ও মান্যবর আলিমদের ব্যাখ্যার আলোকে এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি যে, মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী, অর্থাৎ যাদের মধ্যে রূহ রয়েছে, সবার চিত্র এবং প্রতিকৃতি নির্মাণ করা স্পষ্টত হারাম। চাই সেটি পূজার উদ্দেশ্যে হোক, চাই সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে, চাই নিছক সৌন্দর্যচর্চার উদ্দেশ্যে। তবে রূহবিশিষ্ট প্রাণীর অবয়ব ছাড়া অন্য কিছুর চিত্র, ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। পরবর্তীতে প্রত্যক্ষ করলাম যে, ভাস্কর্য নির্মাণের পক্ষে ফতোয়া প্রদানকারীরা তাঁদের সপক্ষে তিনটি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তাই আমরা তাঁদের যুক্তিগুলোকে পর্যালোচনা করার ইচ্ছা পোষণ করছি।
তাঁদের প্রথম যুক্তি ছিল, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. পুতুল দিয়ে খেলেছেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে এমনটি করতে বারণ করেননি। এর মাধ্যমে বুঝা যায় যে, পুতুল বা প্রতিকৃতি ব্যবহার করা জায়েয। দ্বিতীয় যুক্তি ছিল, নবী সুলাইমান আলাইহিস সালামের জন্য জিনরা প্রতিকৃতি তৈরি করেছিল। সুতরাং প্রতিকৃতি নির্মাণ করা জায়েয। তৃতীয় যুক্তি ছিল, বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি নির্মিত আছে। সুতরাং ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি নির্মাণ করা জায়েয।
প্রথমত, এ কথা ঠিক যে, আয়েশা সিদ্দীকা রা. বাল্যবয়সে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ঘরে বিবাহ করে আসার পর পুতুল দিয়ে খেলেছেন। আয়েশা রা. নিজে বর্ণনা করেছেনঃ
كُنْتُ أَلْعَبُ بِالْبَنَاتِ عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَكَانَ لِي صَوَاحِبُ يَلْعَبْنَ مَعِي
“আমি নবী ﷺ এর ঘরে পুতুল দিয়ে খেলতাম। আমার বান্ধবীরাও আমার সাথে খেলত।” [সংক্ষেপিত, সহীহ বুখারী; কিতাবুল আদাব]
অপর একটি বর্ণনায় তিনি বলেছেনঃ
قَالَ مَا هَذَا يَا عَائِشَةُ قَالَتْ بَنَاتِي وَرَأَى بَيْنَهُنَّ فَرَسًا لَهُ جَنَاحَانِ مِنْ رِقَاعٍ فَقَالَ مَا هَذَا الَّذِي أَرَى وَسْطَهُنَّ قَالَتْ فَرَسٌ قَالَ وَمَا هَذَا الَّذِي عَلَيْهِ قَالَتْ جَنَاحَانِ قَالَ فَرَسٌ لَهُ جَنَاحَانِ قَالَتْ أَمَا سَمِعْتَ أَنَّ لِسُلَيْمَانَ خَيْلاً لَهَا أَجْنِحَةٌ قَالَتْ فَضَحِكَ حَتَّى رَأَيْتُ نَوَاجِذَهُ
“রাসূল ﷺ বললেন, আয়েশা এটি কী? আমি বললাম, আমার পুতুল। তিনি এগুলোর মধ্যে একটি ঘোড়া দেখতে পেলেন, যার ডানা ছিল কাপড়ের তৈরি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এগুলোর মধ্যখানে এটি কী? আমি বললাম, ঘোড়া। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ঘোড়ার ওপর এগুলো কী? আমি বললাম, দুটি ডানা। তিনি বললেন, ডানাওয়ালা ঘোড়া! আমি বললাম, কেন, আপনি কি শুনেননি সুলাইমান আ. এর ডানাওয়ালা ঘোড়া ছিল? তখন তিনি এত জোরে হাসলেন যে, আমি তাঁর দাঁতের মাড়ি দেখতে পেলাম।” [সংক্ষেপিত, সুনান আবি দাউদ; কিতাবুল আদাব]
তবে আয়েশা রা.’র পুতুল খেলার ওপর কিয়াস করে সাহাবা-তাবেয়ীন বা পরবর্তী কোনো ইমাম-আইম্মা প্রাণীর চিত্র অংকন এবং প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য নির্মাণকে বৈধতা দেননি। কারণ ওগুলো হারাম হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল বিদ্যমান। সিরিয়ার দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়াহ অনুষদের অধ্যাপক ড. হিন্দ আল-খাওলী صنع التماثيل والاتجار فيها واقتناؤها في الفقه الإسلامي নামক রিসালাহ’র মধ্যে ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি নির্মাণ সংক্রান্ত যাবতীয় মতামত দলিলসহ তূলনামূলক পর্যালোচনা করেছেন। এরপর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন-
الراجح الذي تؤيده الأدلة الصريحة هو القول بتحريم صنع التماثيل ذات الروح مجسمة أو غير مجسمة وإن كانت المجسمة مصنوعة من حجر أو خشب أو طين أو غير ذلك
“প্রণিধানযোগ্য মত হচ্ছে সেটি, যার সমর্থনে স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান। তা হলো, রূহবিশিষ্ট প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ করা, চাই তা দৈহিক অবয়ববিশিষ্ট হোক (ভাস্কর্য) অথবা দৈহিক অবয়বহীন (চিত্র), চাই সেটি পাথরের তৈরি হোক, কাঠের তৈরি হোক, মাটির তৈরি হোক কিংবা অন্য কিছু দিয়ে তৈরি হোক, সর্বাবস্থায় এটি হারাম।”
ইমাম আসকালানী, ইমাম নববী, ইমাম কুরতুবী, ইমাম খাত্তাবী ও ইমাম ইবনুল আবেদীন প্রমুখের মতে, হানাফি, মালিকি, শাফেয়ী ও হাম্বলী চার মাযহাবে ঐক্যমতের ভিত্তিতে এটিকে হারাম করা হয়েছে। কারণ এটি হারাম হওয়ার পক্ষে রাসূলুল্লাহ ﷺ স্পষ্ট হাদীস বিদ্যমান।
আয়েশা সিদ্দীকা রা.’র পুতুল খেলার ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরামের দুটি মতামত বিদ্যমান। উপরোল্লিখিত হাদীসদ্বয়ের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী ‘ফাতহুল বারী’ কিতাবে এবং শামসুল হক আযিমাবাদী ‘আউন আল-মা’বুদ’ কিতাবে মতগুলো উল্লেখ করেছেন।
প্রথম মতটি হলো-
استدل بهذا الحديث على جواز اتخاذ صور البنات واللعب من أجل لعب البنات بهن وخص ذلك من عموم النهي عن اتخاذ الصور
“এই হাদীস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, শিশুকন্যাদের খেলার জন্য পুতুল রাখা জায়েয। এটি চিত্র/ভাস্কর্য হারাম হওয়ার সাধারণ হুকুমের মধ্য থেকে বিশেষভাবে আলাদা করা হয়েছে।”
অর্থাৎ, প্রাণীর চিত্র, প্রতিকৃতি ইত্যাদি তৈরি ও সংরক্ষণ করা সাধারণভাবে হারাম। তবে শিশুদের খেলার জন্য তা ব্যবহার করা জায়েয। এটি মূল নিয়ম নয়; বরং নিয়মের ব্যতিক্রম একটি বিশেষ হুকুম।
দ্বিতীয় মতটি হলো-
أن الرخصة لعائشة في ذلك كان قبل التحريم
“আয়েশা রা.’র জন্য পুতুল খেলার সুযোগ ছিল হারাম হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।”
অর্থাৎ, আয়েশা রা. যখন পুতুল খেলেছিলেন, তখন পর্যন্ত এটি হারাম ছিল না।
বেশিরভাগ উলামায়ে কেরাম প্রথমোক্ত মতটি সমর্থন করেছেন। অর্থাৎ, শিশুদের জন্য পুতুল খেলা জায়েয, তবে সাধারণভাবে প্রাণীর অবয়ববিশিষ্ট চিত্র বা প্রতিকৃতি তৈরি ও ব্যবহার করা হারাম। আমাদের কাছেও এ মতটি অধিক যৌক্তিক মনে হয়। কারণ প্রাণীর চিত্র, প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য তৈরি করা এজন্য হারাম করা হয়েছে যে, মানুষ ভালোবাসা প্রকাশের জন্য এগুলো তৈরি করে। পরে এক সময় এগুলোকে ভক্তি করা শুরু করে, কুর্নিশ করে, পুষ্পমাল্য চড়ায়। ধীরে ধীরে তা উপাসনায় রূপ নেয়। তাই سد الذرائع তথা খারাপ কাজের সুযোগ বন্ধ করে দেয়ার জন্য চিত্র, প্রতিকৃতি ইত্যাদি নির্মাণ করাই নিষিদ্ধ। কিন্তু শিশুরা যেহেতু এসব ভাবনা থেকে মুক্ত, তাই তাদের জন্য পুতুল ব্যবহার করা জায়েয। যদিও ইমাম মালিক এটিকেও অপছন্দ করেছেন। তাই যারা বাল্যবয়সে আয়েশা রা.’র পুতুল খেলাকে আজ সম্মান প্রদর্শনের জন্য তৈরি করা চিত্র, ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি জায়েয হওয়ার দলিল মনে করছেন, তাঁরা উম্মতের মান্যবর সব ইমাম-আইম্মার ঐক্যমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, এ কথা ঠিক যে, জিনরা সুলাইমান আ. এর জন্য ভাস্কর্য তৈরি করত। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ
يَعْمَلُونَ لَهُ مَا يَشَاء مِن مَّحَارِيبَ وَتَمَاثِيلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُورٍ رَّاسِيَات
“তারা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত।” [সুরা সাবা : ১৩]
যদি ধরেও নেই যে, ভাস্কর্যগুলো প্রাণীর অবয়ববিশিষ্ট ছিল, তবুও তাতে আমাদের জন্য প্রাণীর চিত্র বা ভাস্কর্য নির্মাণ করা বৈধ হয় না। কারণ এটি সুলাইমান আ. এর শরীয়তে বৈধ ছিল, কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর শরীয়তে বৈধ নয়। রাসূল ﷺ নিজে এ কাজ করতে নিষেধ করেছেন। এমন অনেক কাজ রয়েছে, যা এক নবীর যুগে বৈধ ছিল, অন্য নবীর শরীয়তে এসে নিষিদ্ধ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তাফসীর ইবনে কাসিরে উল্লেখিত আছে যে, নবী ইয়াকুব আ. একসাথে দুজন নারীকে বিয়ে করেছিলেন, যারা পরস্পর সহোদরা ছিল। তাওরাতেও এটি বর্ণিত আছে। কিন্তু মুহাম্মদ ﷺ এর শরীয়তে এটি নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেনঃ
وَأَن تَجْمَعُوا بَيْنَ الْأُخْتَيْنِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ
“(এবং তোমাদের জন্য হারাম হচ্ছে) দুই সহোদরা বোনকে একত্রে বিবাহ করা। তবে প্রথমে যা হয়েছে, তা গত হয়েছে।” [সুরা নিসা : ২৩]
নবী ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা তাঁকে সেজদা করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে এসেছেঃ
وَرَفَعَ أَبَوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ وَخَرُّواْ لَهُ سُجَّدًا
“তিনি তার পিতা-মাতাকে উঁচু স্থানে উপবিষ্ট করলেন এবং তারা তার জন্য সেজদায় পতিত হলো।” [সুরা ইউসুফ : ১০০]
কিন্তু আমাদের নবীর শরীয়তে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সেজদা করা, চাই ইবাদতের জন্য হোক কিংবা সম্মান প্রদর্শনের জন্য, স্পষ্টত শিরক এবং হারাম। আবদুল্লাহ ইবনে আবি আউফা রা. বর্ণনা করেছেনঃ
لَمَّا قَدِمَ مُعَاذٌ مِنَ الشَّامِ سَجَدَ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا هَذَا يَا مُعَاذُ قَالَ أَتَيْتُ الشَّامَ فَوَافَقْتُهُمْ يَسْجُدُونَ لأَسَاقِفَتِهِمْ وَبَطَارِقَتِهِمْ فَوَدِدْتُ فِي نَفْسِي أَنْ نَفْعَلَ ذَلِكَ بِكَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَلاَ تَفْعَلُوا
“মু’আয রা. শাম থেকে ফিরে এসে নবী ﷺ-কে সেজদা করে ফেললেন। রাসূল ﷺ বললেন, এটি কী করছ মু’আয? তিনি জবাব দিলেন, আমি শাম দেশে দেখেছি মানুষ পণ্ডিত ও পাদ্রীদেরকে সেজদা করে। আমার মনে হলো, আমরা আপনাকে সেজদা করব। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, না এমনটি করো না।” [সংক্ষেপিত, সুনান ইবনু মাজাহ; কিতাবুন নিকাহ]
এমন অনেক বিষয় পাওয়া যাবে, যা আগের শরীয়তে এক রকম ছিল, আমাদের শরীয়তে ভিন্ন। তাই সুলাইমান আ. এর সময়কার ভাস্কর্য নির্মাণ করাকে আজকের যুগে ভাস্কর্য নির্মাণ করার দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না, যেহেতু রাসূলুল্লাহ ﷺ স্পষ্টভাবে এটিকে নিষেধ করেছেন।
তৃতীয়ত, এটি ঠিক যে, বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মিত আছে। আমি নিজের চোখেই দেখেছি। কিন্তু ‘বিভিন্ন মুসলিম দেশ’ ইসলামি শরীয়তের দলিল নয়। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া-তা’আলা বলেছেনঃ
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا
“রাসূল তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করো। আর তিনি তোমাদেরকে যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো।” [সুরা হাশর : ৭]
তাই কেবল ‘বিভিন্ন মুসলিম দেশ’ নয়; কাল যদি কা’বা শরীফের পাশেও এমন কিছু তৈরি করা হয় যা কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার বিরোধী, তবে আমরা সেটিকেও ভ্রান্ত বলে বর্জন করব।
নির্দ্বিধায় মানুষের কাছে কুরআন-সুন্নাহ’র দাওয়াত পৌঁছে দেয়া এবং নিঃসংকোচে বাতিলের বিরুদ্ধে হকের আওয়াজ উঁচু করা আমাদের দায়িত্ব। এরপর মানা, না মানা মানুষের নিজস্ব ব্যাপার।।