জীবনীমনীষাসংবাদ

শায়েখ সায়্যিদ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-আয়দারুস : বিনয়ের এক মূর্ত প্রতীক

খায়রুল হুদা খান

হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে ফোন দিলেন হাইডের আলহাজ্ব আবদুল মুছাব্বির সাহেব। “চাচা, শুনেছেন আইদারুস ছাহেব আর নেই?” আমি বললাম জী না আমিতো শুনেছি উনার বাবা ইন্তেকাল করেছেন। তিনি বললেন জী না তিনিই ইন্তেকাল করেছেন বলেই আবার কান্না। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দেখলাম অনেকেই এটাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। পারবেনই বা কিভাবে; এত বড় মাপের একজন মানুষ হয়েও অতি স্বাভাবিকভাবে যে কাউকেই তিনি আপন করে নিতেন। পীর ও মুর্শিদ হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর খাতিরে আমাদের মত অতি সাধারণ মানুষকেও তিনি ভালবাসতেন হৃদয় উজাড় করে।

মুহাদ্দিসে হিজায শায়েখ সাইয়্যিদ মুহাম্মদ বিন আলাবী আল মালিকী (রহ.) এর খলীফা ও মক্কা শরীফের মসজিদে খাইর এর ইমাম শায়েখ সায়্যিদ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-আয়দুরুস ছাহেবের সাথে প্রথম সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয় ২০১৭ সালের ২৫শে এপ্রিল ওল্ডহ্যাম সেন্ট্রাল মসজিদে পবিত্র শবে বরাত এবং শবে মিরাজ শীর্ষক আলোচনা মাহফিলে। উনার হৃদয়গ্রাহী এবং দলীল ও যুক্তিভিত্তিক আলোচনা আমাদেরকে মুগ্ধ করে। সেখান থেকে যাওয়া হলো হাইডের জনাব আলহাজ্ব আবদুল মুছাব্বির সাহেবের ঘরে। বৈঠক খানার মধ্যখানে একটি সোফাতে তাঁকে বসানো হল। আবদুল মুছাব্বির সাহেব বললেন আমার সৌভাগ্য আপনাকে এমন সোফাতে বসিয়েছি যে সোফাতে আমার ছাব কিবলাহ বসতেন। সাথে সাথে সাইয়্যিদ ছাহেব মেঝেতে নেমে পড়লেন, বললেন, যেখানে ‘শায়েখ ফুলতলী‘ বসেছেন সেখানে আমি বসতে পারি না। খেতে বসে বিভিন্ন রকম খাবার শেষে ছাহেব কিবলাহর পছন্দের খাবার আম, গুড়, দই এবং মধু তাঁর সামনে দেওয়া হল, তিনি বললেন আমি জীবনে এ রকম খাই নি, কিন্তু ছাহেব কিবলাহর পছন্দের কথা শুনে খাবারটি আমারও প্রিয় হয়ে গেছে। সাথে সাথে হাদীস বললেন, হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমরা অনেকেই লাউ পছন্দ করতাম না, কিন্তু যখন দেখলাম রাসূলুল্লাহ (সা.) লাউ পছন্দ করেন তখন থেকেই লাউ আমাদের প্রিয় হয়ে গেল।” সেই রাতের কয়েক মুহুর্ত সাইয়্যিদ ছাহেবের সাথে কাটানোতেই তাঁর সাথে এক অকৃত্রিম ভালোবাসায় আবদ্ধ করে ফেললেন তিনি। ফোন নাম্বার দিলেন এবং বললেন উমরায় গেলে দেখা না করে যেন না আসি।

২০১৯ সালে উমরাহতে গেলে ইচ্ছা ছিল দেখা করব, ম্যাসেজ দিয়ে সে কথা জানালে সাথে সাথে ‘আহলান সাহলান মারহাবান’ বলেই এড্রেস পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু ব্যস্ততার কারনে যাওয়ার সুযোগ হয় নি এবং তাঁকে কোন কথাও দেই নি। দুই দিন পর ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি যাচ্ছি তাঁর বাসায়, তিনি আমাকে একটি হাদিয়া দিতে চান। কিন্তু ততক্ষণে আমরা মদীনা শরীফে চলে গেছি। আমি চিন্তাও করতে পারি নি তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আল্লাহর দয়ায় উমরাহতে যাওয়ার সুযোগ হলে তাঁকে সালাম জানালে সাথে সাথে তাঁর বাসায় দাওয়াত দিলেন। বন্ধুবর মাওলানা জুবায়ের আহমদ রাজু ভাইকে সাথে করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি হাযির হলাম তাঁর বাসায়। অত্যন্ত সমাদর করলেন। ছাহেব কিবলাহর খিদমত, ছাহেবজাদাদের সকল খবর জানতে চাইলেন। ছাহেব কিবলাহর নাতিগণ কে কোথায় আছেন কী করছেন জানতে চাইলেন। ছাহেব কিবলাহর বিভিন্ন খিদমতের ভূয়ষী প্র্রশংসা করলেন। আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ হিসেবে দুইটি জিনিস দান করলেন। একটি হলো রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত তাঁর ‘মুসালসাল বিল মুসাফাহা‘ এর সনদ। ‘সাফিহনী বিকাফফিকাল লাতী সাফাহতা বিহা শাইখাক’ বলার সাথে সাথে তিনি পরম মমতায় মুসাফাহা করলেন, সেই মুহুর্তে একটি শিহরণ অনুভব করলাম, এমন একটি হাতে হাত রেখে আমি মুসাফাহা করছি যেই হাত দিয়ে তিনি তাঁর শায়েখের সাথে মুসাফাহ করেছেন, যিনি তাঁর শায়েখের সাথে মুসাফাহা করেছেন, যিনি তাঁর শায়েখের সাথে মুসাফাহা করেছেন- এই ভাবে অবিচ্ছেদ্যভাবে এই সিলসিলাহ রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। আরেকটি মহামূল্যবান উপহার দান করলেন; ফ্রেইমে বাঁধানো কা‘বা শরীফের এক টুকরো গিলাফ। নিজেকে সেদিন বড়ই সৌভাগ্যবান মনে করলাম এবং হযরত ছাহেব কিবলাহর শুকরিয়া আদায় করলাম, আল্লাহর ওলীর খাতিরে আল্লাহ পাক এই সৌভাগ্য দান করেছেন।

এ বছরের জানুয়ারি মাসে সুনামগঞ্জের একটি মাহফিলে তাঁকে দাওয়াত করে ১৬ই জানুয়ারি তাঁর ফ্লাইট কনফার্ম করা হয়। ১৫ জানুয়ারি ফুলতলীতে ঈসালে সওয়াব মাহফিলের কথা তাঁকে জানানো হয় নি। যখন তিনি জানতে পেরেছেন অনেক আফসোস করেছেন মাহফিলে শরীক হতে না পারার জন্য। ২/৩ দিন পরেই হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর যিয়ারতের জন্য তিনি ফুলতলীতে গেলে আমার ভাই মাওলানা নজমুল হুদা খানকে দেখে আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন, আমার সাথে কথা বলতে চাইলেন। ছাহেব বাড়িতে তোলা কয়েকটি ফটোও পাঠালেন। ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর বাসাতে যাওয়ার পরে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত এবং আমার ভাইয়ের সাক্ষাতের দুটি পৃথক ফটো পাশাপাশি বসিয়ে “লিক্বা‘ মা‘আ নাজমুল হুদা” লিক্বা‘ মা‘আ খাইরুল হুদা” লিখে আমাদের দুইজনের কাছে পাঠালেন। এত বড় মাপের একজন মানুষের এমন আন্তরিকতাসুলভ আচরণ তাঁর বিনয়ের চুড়ান্ত প্রকাশ।

Khairul Huda Khan & Najmul Huda Khan with Shaykh Muhammad Abdullah al-Aydaroos

গত ২৮শে অক্টোবর ফেইসবুকে আনজুমানে আল ইসলাহ ইউকের লাইভ ঈদে মীলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল দেখে আমাকে মেসেজ দিয়ে তিনি লাইভ মাহফিলে জয়েন করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। হয়ত আল ইসলাহর এই প্লাটফর্ম থেকে আল্লামা ছাহেব কিবলাহর ভক্ত-মুরিদদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রকাশ এবং শেষ বিদায়ের একটি স্মৃতিচিহ্ন রেখে যেতে চেয়ছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্যবশত পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া এবং টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে আমরা সেই সুযোগ লাভ করতে পারি নি।

গত সোমবারে হঠাৎ করেই সূফী কারী আবদুল মুন্তাকিম ছাহেব পরিচালিত অনলাইন দুআ মাহফিলে নিজ থেকেই তিনি হাজির হয়ে গেলেন। আমাকে দেখেই “কাইফা হালুক শাইখ খাইরুল হুদা” বলে সে কী আন্তুরিকতার ডাক। জুমে উপস্থিত সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন, সবাইকে তাঁর বাসায় যাওয়ার জন্য দাওয়াত দিলেন, সকলের কাছে দুআ চাইলেন, সকলকে সাথে নিয়ে দুআ করলেন। কে জানত এই কথা বলাই তাঁর সাথে শেষ কথা।! কে জানত এত তাড়াতাড়ি তিনি এভাবে চলে যাবেন!

ইয়া আল্লাহ্ তোমার হাবীবের এই ফরযন্দকে তোমার হাবীবের জাওয়ারে রাহমাতে রেখো, জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করে দরজা বুলন্দ করে দিও। আমীন।

Related Articles