জীবনীমনীষা

দোজাহানের বাদশাহজাদী

মুহম্মদ মুজিবুর রহমান

হযরত আলী (রা.) একদা জনৈক শিষ্যকে বললেন, আমি তোমাদেরকে রাসূলে পাক (স.) এর স্নেহের কন্যা হযরত ফাতেমার (রা.) কথা শুনাব কি? শিষ্য বললেন, নিশ্চয়ই শুনাবেন। তিনি বলতে লাগলেন, ফাতেমা (রা.) নিজ হাতে আটা পিষতেন, যদ্বারা তাঁর হাতে দাগ পড়ে গিয়েছিল এবং স্বয়ং মশক ভরে পানি আনতেন, যার দরুণ তাঁর বুকের ওপর মশকের রশির দাগ পড়ে গিয়েছিল। আবার নিজ হাতেই ঘর ঝাড়ু দিতেন, যে কারণে প্রায়ই কাপড়-চোপড় ময়লা যুক্ত থাকত।

একদিন আমি ফাতেমাকে বললাম, তুমি গিয়ে রাসূলে পাক (স.) এর নিকট হতে একজন খেদমতগার চেয়ে আন, তাহলে তোমার কাজকর্মে কিছুটা সাহায্য হবে। তিনি রাসূল (স.) এর দরবারে গেলেন, তখন দরবারে যথেষ্ট লোকজন ছিল। তিনি অতিমাত্রায় লাজুক ছিলেন, তাই লোক সম্মুখে কিছু না বলেই ফিরে আসলেন। পরদিন স্বয়ং রাসূলে পাক (স.) আমাদের ঘরে তশরীফ এনে জিজ্ঞাসা করলেন, মা! গতকাল তুমি কি জন্যে গিয়েছিলে? তিনি লজ্জায় চুপ করে রইলেন।

আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (স.)! তার এ অবস্থা যে, নিজ হাতে চাক্কী চালনার দরুণ হাতে দাগ পড়ে গেছে। মশক ভর্তির দরুণ সিনায় রশির নিশানা পড়ে গেছে। তদুপরি ঘর-দোর ঝাড়– দেয়ার দরুণ প্রায় কাপড়-চোপড় ময়লাযুক্ত থাকে। তাই গতকল্য আমি বলেছিলাম, আপনার খেদমতে গিয়ে একজন খাদেম আনুন। এজন্যেই গিয়েছিলেন। অন্য বর্ণনায় আছে- হযরত ফাতেমা বললেন, আব্বাজান! আমার ও আলীর মেষের চামড়ার একটি মাত্র বিছানা! আমরা রাত্রি বেলায় এতে শয়ন করি, আর দিনের বেলায় এতে উট-বকরীকে ঘাস-দানা খাওয়াতে হয়। তা’শুনে রাসূলে পাক (স.) বললেন, মা! সবর কর। হযরত মুসা (আ.)ও তাঁর বিবির নিকট দশ বৎসর যাবৎ একটি মাত্র বিছানা ছিল। তাও হযরত মুসা (আ.) এর জুব্বা ছিল। রাত্রি বেলায় তাতেই শয়ন করতেন। মা, আল্লাহকে ভয় কর, পরহেজগারী এখতিয়ার কর, তাঁর হুকুম-আহকাম পালন কর। ঘরের কাজ-কর্ম নিজ হাতেই সম্পাদন কর এরং রাত্রি বেলায় যখন শুইতে যাবে তখন তেত্রিশ বার সোবহানাল্লাহ, তেত্রিশ বার আলহামদুলিল্লাহ এবং চৌত্রিশ বার আল্লাহু আকবার পড়ে শয়ন কর। মনে রেখো, তা খাদেম হতেও উত্তম।

হযরত ফাতেমা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহ ও রাসূলের ওপর রাজী আছি। তিনি নবী তনয়াদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠা ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রাসূলে পাক (স.) বলেন, তিনি জান্নাতী মহিলাদের নেত্রী হবেন।

মোহাদ্দেসীন এবং ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত যে, রাসূলে পাক (স.) এর চারজন কন্যা ছিলেন। হযরত ইব্রাহিম (রা.) ব্যতীত তাঁর সকল সন্তানগণ আম্মাজান হযরত খাদিজা (রা.) এর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। রাসূলে পাক (স.) হযরত খাদিজাকে খুবই ভালবাসতেন। তাঁর জীবিতাবস্থায় তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। হযরত খাদিজার (রা.) ইন্তিকালের পর একদা তাঁর বোন হালা রাসূল (স.) এর সাথে দেখা করতে এলেন এবং ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর অনেকটা হযরত খাদিজার মত। রাসূলে পাক (স.) সে আওয়াজ শ্রবণ করতেই হযরত খাদিজার কথা মনে পড়ে গেল তাঁর, তিনি বিচলিত হলেন এবং বললেন, হালা এসো। হযরত আয়েশাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তাঁর খুবই ঈর্ষা হল এতে। তিনি বললেন, আপনি কি এক মৃত বৃদ্ধা রমণীর কথা স্মরণ করেন, আল্লাহ তায়ালা যেখানে আপনাকে উত্তম স্ত্রী দিয়েছেন। রাসূলে পাক (স.) তার উত্তরে বললেন, কখনোই নয়, যখন লোকেরা আমাকে অস্বীকার করল, তখন তিনি আমাকে সমর্থন করেছেন, যখন অন্যেরা অবিশ্বাসী ছিল, তিনি ইসলামের বিশ্বাসী হয়েছেন, যখন আমার কেউই সাহায্যকারী ছিল না, তখন তিনিই আমার সহযোগিতা করেছেন এবং আমার সন্তান তাঁর থেকেই হয়েছে।

হযরত খাদিজার (রা.) গর্ভে রাসূলে পাক (স.) এর দুই ছেলে ও চার কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেদের নাম-হযরত কাসেম ও হযরত তাহের (রা.)। কাসেমের নামানুসারেই তিনি ‘আবুল কাশেম’ ডাক নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাহের (রা.) সম্পর্কে বলা হয় যে, তাঁর আসল নাম ছিল আবদুল্লাহ। তৈয়ব এবং তাহের এ দু’টি তার উপাধি ছিল। চার কন্যার নাম-হযরত ফাতেমা, জয়নব, রোকাইয়া ও উম্মে কুলসুম (রা.)। হযরত জয়নব তাঁর সন্তানদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠা ছিলেন। কেউ কেউ হযরত জয়নবকে, কেউ হযরত রোকাইয়াকে, কেউবা উম্মে কুলসুমকে বয়োজ্যেষ্ঠ বলেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হযরত রোকাইয়া সকলের বড় এবং উম্মে কুলসুম সর্ব কনিষ্ঠা ছিলেন। পুত্র সন্তানদের সকলেই বাল্য বয়সে ইন্তিকাল করেন।
হযরত জয়নবের বিয়ে হয়েছিল আবুল আস বিন রবী এর সাথে। তাদের একটি ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করে অল্প বয়সেই ইন্তিকাল করেন। উমামা নাম্নী তাদের একজন কন্যা সন্তান ছিলেন। হযরত ফাতেমার ইন্তিকালের পর হযরত আলী (রা.) উমামাকে বিয়ে করেন। কিন্তু এ পক্ষে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেননি। হযরত রোকাইয়ার বিয়ে হয়- হযরত ওসমান (রা.) এর সাথে। দ্বিতীয় হিজরীতে তিনি বদর যুদ্ধের সময় নিঃসন্তান অবস্থায় ইন্তিকাল করেন।

বদর যুদ্ধের বিজয় সংবাদ নিয়ে হযরত আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা.) মদীনা মুনাওয়ারায় পৌঁছে দেখেন যে, মদীনাবাসীগণ হযরত রোকাইয়ার দাফন কার্য সম্পন্ন করে প্রত্যাবর্তন করছেন। অতঃপর তৃতীয় হিজরীতে তাঁরই সহোদরা উম্মে কুলসুমকে রাসূলে পাক (স.) হযরত ওসমানের নিকট বিয়ে দেন। এ কারণেই হযরত ওসমানের লকব ‘যিননূরাইন’ বা দুই নূরের অধিকারী ছিল। নবম হিজরীতে হযরত উম্মে কুলসুমও ইন্তিকাল করলে রাসূলে পাক (স.) বলেন, আমার নিকট যদি তৃতীয় কোন কন্যা থাকত তবে তাঁকেও ওসমানের নেকাহে প্রদান করতাম। উল্লেখ্য, রাসূলে পাক (স.) এর কন্যা হযরত রোকাইয়া রোগ শয্যায় থাকায় তাঁর স্বামী হযরত ওসমান (রা.) এবং স্বীয়মাতা রোগ শয্যায় থাকায় হযরত আবু উমামা বিন সালামা (রা.) বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অনুমতি পাননি।

হযরত রোকাইয়া ও উম্মে কুলসুম (রা.) এর প্রথমে আবু লাহাবের দুই পুত্র উতবা ও উতাইবার সাথে বিয়ে হয়েছিল। এটি নবুওয়াতের আগের ঘটনা। সূরা-লাহাব অবতীর্ণ হওয়ার পর আবু লাহাব তার পুত্রদ্বয়কে ডেকে রাসূল (স.) এর কন্যাদ্বয়কে তালাক দিতে নির্দেশ দেয়। অন্যথায় তাঁর সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করার হুমকি দেখায়। তাঁরা দু’জনেই পিতার কথা মেনে নেয়। উতাইবা রাসূলে পাক (স.) এর খেদমতে হাজির হয়ে অপারগতা প্রকাশ করে তালাক দেয়। কিন্তু উতবা স্বীয় স্ত্রীকে অপমান করে তালাক দেয়। এ সময় রাসূলে আকরাম (স.) আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করেন, হে আল্লাহ! তোমার কোন হিংস্র জন্তুকে উতবার ওপর জয়ী কর। তা’শুনে উতবা ভয়ে কেঁপে ওঠল এবং আবু লাহাবের নিকট গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করলে সে বলল, আমার পুত্রের আর মংগল নেই; কারণ তার প্রতি মুহাম্মদ (স.) বদ্দোয়া করেছেন। অতঃপর আবু লাহাব যথাসাধ্য তাঁর পুত্রের রক্ষণাবেক্ষণ করতে লাগল। এক সময় উতবা ব্যবসার উদ্দেশ্যে কাফেলার নেতা হয়ে শামদেশ (সিরিয়া) অভিমুখে যাত্রা করল। আবু লাহাব তার চাকরদেরকে খুব সাবধান করে বলে দিল যে, রাত্রিতে শয়নকালে কাফেলার মধ্যবর্তী স্থানে যেন তার পুত্রকে শুইতে দেয়া হয়। তার নির্দেশ মতই উতবাকে সযত্ন পাহারায় রাখা হয়। কিন্তু গভীর রাত্রে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে নিকটবর্তী জঙ্গল হতে একটি বাঘ নেমে এসে কাফেলার সকলকে শুকে শুকে কাউকে কিছু না করে অবশেষে উতবাকে ধরে চিরে ফেলে। অন্য এক বর্ণনায় জানা যায়- পথে ‘জারকা’ নামক স্থানে কাফেলা রাত্রিকালে অবতরণ কররে অকস্মাৎ কোথা হতে এক বাঘ আবির্ভ‚ত হয়ে কাফেলার চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল তা দেখে উতবা ভীত হয়ে চিৎকার করে ওঠল ও বলতে লাগল, নিশ্চয়ই তা আমাকেই গ্রাস করবে, মুহাম্মদ (স.) আমারই জন্যে বদ্দোয়া করেছে। মুহাম্মদ (স.) এখন মক্কায়, আর আমি শামদেশে। অতঃপর বাঘটি কাফেলার লক্ষ্যবস্তু উতবার ওপর লাফিয়ে পড়ল এবং তার মস্তক চুর্ণবিচ‚র্ণ করে ফেলল।

রাসূলে পাক (স.) এর পুত্র সন্তানদের সকলেই বাল্য বয়সে ইন্তেকাল করেন। কন্যা সন্তানদের মধ্যে শুধু হযরত ফাতেমার (রা.) সন্তানরাই জীবিত থেকে রাসূলে পাক (স.) এর বংশ বিস্তার করেছেন। তার সন্তানদের মধ্যে হযরত ফাতেমাই এ মর্যাদার অধিকারী। হযরত ফাতেমার অবয়ব-কাঠামো রাসূলে পাক (স.) এর সংগে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেনঃ ফাতেমার কথাবার্তা, স্বভাব-প্রকৃতি, ওঠা-বসা অবিকল রাসূল (স.) এর মত। তার সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে রাসূলে পাক (স.) বলেছেনঃ তোমার অনুসরণের জন্যে সারা পৃথিবীতে মরিয়ম (আঃ), খাদিজা (রা.), ফাতেমা (রা.) এবং আছিয়া (রা.) যথেষ্ট। হযরত ফাতেমা (রা.) ছিলেন রাসূলে পাক (স.) এর অত্যন্ত প্রিয়ভাজন, স্নেহসিক্ত সন্তান। কোন প্রসংগে রাসূলে পাক (স.) বলেছেন, ফাতেমা আমার শরীরের অংশ, যে তাকে কষ্ট দিবে সে আমাকেই কষ্ট দিবে। তার জীবিত থাকাকালীন হযরত আলী (রা.) আর কোন মহিলাকে বিয়ে করেননি।

দ্বিতীয় হিজরীর রমজান অথবা জিলহজ্জ মাসে হযরত আলী (রা.) এর সাথে সাইয়্যেদাতুন্নিসা হযরত ফাতেমা (রা.) এর বিয়ে হয়। তখন তার বয়স ছিল পনর বছর সাড়ে পাঁচ মাস, মতান্তরে আঠারো বছর আর হযরত আলী (রা.) এর বয়স ছিল একুশ বছর। মোহরানা ছিল চারশত আশি দিরহাম অথবা চারশত মেছকাল রৌপ্য। রাসূলে পাক (স.) যে মাল-সম্পদ দিয়েছিলেন তা’হচ্ছে ঃ একটি চাদর, খেজুর গাছের ছাল ভরা একটি বালিশ, একটি চামড়ার গদি, একটি দড়ির চৌকি, একটি মশক বা চার্ম নির্মিত পানির পাত্র, দু’টি মাটির কলস, দুটি সুরাই, একটি ছাগল এবং একটি আটা পেশার আঁতি। হযরত আলী (রা.) এর নিজস্ব কোন বাসগৃহ ছিল না। হযরত হারেসা বিন নোমান আনসারী (রা.) নব দম্পতির জন্যে একখানা গৃহ খালি করে দিলেন। বিয়ের পরে হযরত আলী (রা.) স্বীয় মাতা হযরত ফাতেমা বিনতে আসাদকে (রা.) বলেন যে, রাসূল (স.) এর কণ্যা আসছেন- আমি পানি ভরব এবং বাইরের কাজ করব এবং তিনি চাক্কিতে আটা পেশার কাজে আপনার সাহায্য করবেন। যদিও তার স্বামী আবু তালেব মুসলমান হননি, কিন্তু ফাতেমা বিনতে আসাদ এবং তার কিছু সন্তান ইসলামে দীক্ষিত হন। রাসূলে পাক (স.) এর জীবনকালে তাঁর ওফাত হয়। রাসূল (স.) স্বীয় জামা খুলে তাঁর কাফন তৈরী করেন এবং কবরের মধ্যে নেমে শুয়ে যান। এরকম করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, (আমার চাচা) আবু তালিবের পর তাঁর চেয়ে বেশি আর কেউ আমাকে আনুক‚ল্য দান করেনি, এজন্যে আমি তাকে আমার জামা পরিয়েছি, যাতে বেহেশতে তিনি পোশাক পান এবং কবরের মধ্যে শুয়ে গেছি, যাতে কবরের কঠোর অবস্থা একটু শিথিল হয়।

রাসূলে পাক (স.) কে সীমাহীন ভালবাসতেন হযরত খাতুনে জান্নাত (রা.)। তার বয়স তখন অল্প। হযরত ইবনে মসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স.) কাবা শরীফের নিকট নামায পড়ছিলেন এবং আবু জেহেলও তার কয়েকটি সংগী সেখানে বসা ছিল। এমন সময় তাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি বলল, তোমাদের মধ্য থেকে কে উমুক গোত্রের উটের নাড়িভুড়ি এনে মুহাম্মদ (স.) যখন সিজদায় যাবেন তার পিঠের ওপর রেখে দিতে পার?

অতঃপর তাদের মধ্য থেকে সব চাইতে বড় পাষন্ডটি (উক্বাহ) ওঠে গিয়ে তা এনে অপেক্ষায় রইল। রাসূল (স.) যখন সিজদায় গেলেন, তখন সে পাষন্ডটি তার দু’কাধের মধ্যখানে পিঠের উপর রেখে দিল। আমি তা দেখছিলাম। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। হায়, আমার যদি কিছু করার শক্তি থাকত! তিনি বলেন, তারা হাসতে লাগল এবং একে অপরের ওপর দোষ চাপাতে লাগল। রাসূলে পাক (স.) সিজদায় ছিলেন, তিনি মাথা তুলতে পারছিলেন না। এমন সময় হযরত ফাতেমা (রা.) দৌঁড়ে এসে তার পিঠ থেকে সরালে তিনি মাথা তুলে তিনবার বললেন, হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশদের পাকড়াও কর। এ বদ্-দোয়ায় তারা মনে আঘাত পেল। কেননা এই শহরে দোয়া কবুল হয়। তারপর তিনি নাম ধরে বদ্-দোয়া, করলেন, হে আল্লাহ! তুমি আবু জেহেল, উবা বিন রবীয়া, শাইবা বিন বরীয়া, অলীদ বিন উতবা, উমাইয়া বিন খলফ এবং উক্বা বিন আবি মুয়িতকে পাকড়াও কর। তিনি সপ্তম ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু বর্ণনাকারী তা ভুলে গেছেন। আবদুল্লাহ বলেন, সেই সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন, রাসূলে পাক (স.) যে সকল লোকের নাম নিয়েছিলেন আমি তাদের প্রত্যেককে বদরের অন্ধকার কূপে পড়ে থাকতে দেখেছি।

রাসূলে পাক (স.) হযরত ফাতেমাকে খুবই ভালবাসতেন। তার অভ্যাস ছিল যখনই কোন সফরে বের হবার চিন্তা করতেন তখন সব শেষে হযরত ফাতেমা (রা.) এর কাছে যেতেন এবং সফর থেকে ফিরবার পর প্রথম যিনি রাসূল (স.) এর মুখোমুখি হতেন তিনিও হযরত ফাতেমা (রা.)। হযরত ফাতেমা যখন রাসূলে পাক (স.) এর খেদমতে যেতেন, তখন তিনি দাঁড়িয়ে যেতেন, চুম্বন করতেন তাঁর কপালে এবং নিজের বসার জায়গায় বসাতেন তাঁকে। সম্মানের উপযুক্ত কোন ব্যক্তিকে দেখলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করা রাসূলে পাক (স.) এর পছন্দ ছিল। উদাহরণ স্বরূপঃ একদা রাসূলুল্লাহ (স.) এর সম্মুখে ইমরানের পিতা হযরত হোসাইন কাফের অবস্থায় রাসূল (স.) এর দরবারে বিতর্কের জন্যে উপস্থিত হন। কিছু প্রশ্নোত্তরের পর কলেমা পড়ে মুসলমান হলেন। ইমরান সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পিতার কাছে আসলেন, তাঁর হাত-পা ও কপালে চুম্বন করলেন। এতে রাসূলে পাক (স.) এর নয়নযুগল থেকে অশ্রু নির্গত হতে লাগল। তারপর তিনি উপস্থিত সাহাবাগণকে সম্বোধন করে বললেন, আমার চক্ষুর পানি ফেলার কারণ, তোমরা জান কি? উত্তরে তারা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স.) ভাল জানেন। তিনি বললেন, যখন হোসাইন গৃহে প্রবেশ করলেন তখনও তার ছেলে ইমরান ঐ জায়গায় বসা ছিলেন। তিনি স্বীয় পিতাকে দেখে তার প্রতি দৃষ্টি দিলেন না এবং উঠে দাঁড়ালেনও না। অতঃপর যখন হোসাইন কলেমা শাহাদত পড়ে মুসলমান হলেন তখন ইমরান তার পিতার হক আদায় করলেন। তা দেখে আমার চক্ষুর পানি ঝরতে লাগল। আহলে বয়তে রাসূল (স.) সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন ঃ “হে নবী পরিবার, আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে উমর ইবনে আবি সালমা (রা.) হতে বর্ণিত-তিনি বলেন, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় রাসূল (স.) উম্মে সালমার (রা.) ঘরে ছিলেন। এমন সময় তিনি ফাতেমা, হাসান ও হোসাইনকে (রা.) ডাকলেন এবং তাদেরকে একটি চাদরে আবৃত করে বললেন, হে আল্লাহ! ওরা আমার আহলে বয়েত। এ সময় হযরত আলী (রা.) রাসূলে পাক (স.) এর পিছনে দাঁড়ানো ছিলেন। সাদ্দাম বিন আম্মার হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি ওয়াছিলা ইবনে আসকার (রা.) নিকটে গেলাম। তার কাছে একদল লোক ছিল তারা হযরত আলীর উল্লেখ করতঃ আলী (রা.) কে গালি দিল, আমিও তাকে ওদের সাথে গালি দিলাম। যখন লোকেরা চলে গেল তিনি (ওয়াছিলা ইবনে আসকা) আমাকে বললেন, তুমি কি এই ব্যক্তি আলীকে গালি দিলে? আমি বললাম, লোকেরা তাকে গালি দেয়ায় আমি তাদের সাথে গালি দিয়েছি। ওয়াছিলা বললেন, আমি রাসূলে পাক (স.) হতে যা দেখেছি তা কি তোমাকে বলব? আমি উত্তরে বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আমি ফাতেমার (রা.) কাছে গিয়ে হযরত আলী (রা.) সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। ফাতেমা (রা.) বললেন, রাসূল (স.) আমার প্রতি মনোনিবেশ করলে আমি বসে তাঁর অপেক্ষায় রইলাম। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (স.) আলী, হাসান ও হোসাইনকে হাতে ধরে নিয়ে আসলেন। অতঃপর আলী এবং আমাকে তার সামনে বসালেন এবং হাসান ও হোসাইনকে নিজের উরুর জানুতে বসালেন। অতঃপর তাদেরে স্বীয় চাদরে আবৃত করতঃ ওপরে বর্ণিত আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন। যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (স.) হযরত আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন (রা.) সম্বন্ধে বলেন, যারা এদের সাথে লড়বে, আমি তাদের সাথে লড়ব এবং যারা তাদের সাথে সন্ধি করবে আমি তাদের সাথে সন্ধি করব। ইমাম আহমেদ, ইমাম হাকেম এবং তিবরানী হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, রাসূল (স.) ফাতেমা, আলী, হাসান ও হোসাইনের দিকে অঙ্গুলী ইশারা করে বলেছেন- যারা এদের সংগে সদ্ভাব রাখবে, তারা যেন আমার সাথে সদ্ভাব রাখল। আর যারা এদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে, তারা আমার সাথেই দুর্ব্যবহার করল। হযরত আবু বকর (রা.) বলেছেন, রাসূল (স.) এ কথার সাথে আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি স্বভাবতঃই সৎ এবং সৎভাবে জন্ম নিয়েছে, সে এদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবে। আর যে ব্যক্তি অসৎ এবং জন্মগতভাবে দোষী সে এদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবে না।

রাসূলে পাক (স.) এর ওফাতের ছয় মাস পরে হযরত ফাতেমা (রা.) ইন্তিকাল করেন। অন্তিম শয্যাবস্থায় রাসূল (স.) স্বীয় প্রিয়তমা কন্যাকে কাছে ডেকে আনলেন এবং তাকে চুপি চুপি কিছু বললেন। তাতে হযরত ফাতেমা কেঁদে ওঠলেন। পুনরায় চুপি চুপি কিছু বললেন। তাতে তিনি হাসলেন। পরে তাকে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানিয়েছেন যে, প্রথমবারে রাসূলে পাক (স.) তাকে বলেছিলেন যে, তিনি এ রোগেই ইহজগত ত্যাগ করবেন। তাই আমি তখন কেঁদেছিলাম। আর দ্বিতীয়বারে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, তোমার সাথে বিচ্ছেদ বেশি দিনের নয়, তুমি আমার পরিজনের মধ্য হতে সর্বাগ্রেই আমার সাথে মিলিত হতে পারবে, এ সংবাদে আমি হেসেছি। উসুদুল গাবা কিতাবে আছে- যতদিন তিনি এরপর জীবিত ছিলেন, কখনও হাসেননি। যখন সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ (স.) কে দাফন করে ফিরে এলেন, তখন হযরত ফাতেমা (রা.) হযরত আনাস (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, রাসূল (স.) এর উপর মাটি ঢালতে তোমাদের কি ভাল বোধ হয়েছে?

হযরত ফাতেমা (রা.) ১১ জিহরীর রমজান মাসে ইন্তিকাল করেন। এ সময় তার বয়স হয়েছিল উনত্রিশ বছর। একটি বর্ণনায় চব্বিশ বছর, একটি বর্ণনায় পঁচিশ বছর এবং একটি বর্ণনায় ত্রিশ বছর উল্লিখিত আছে। তাঁর কবর বিষয়েও বিতর্ক আছে। কারো কারো ধারণা হচ্ছে, তিনি জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে সমাহিত হয়েছেন। একটি বর্ণনায় তিনি ‘দারে আকীলের’ একটি কোণায় সমাধিস্থ হন। একটি বর্ণনায় আছে যে, তিনি আপন গৃহেই সমাধিস্থ হন। তিনি ছিলেন খুবই লজ্জাশীলা। সততা এবং ন্যায় নিষ্ঠায় তাঁর তুলনা ছিল না। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমি ফাতেমার চেয়ে অধিক সত্যাবাদী কাউকে দেখিনি কেবল রাসূল (স.) ছাড়া।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *