প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের প্রায় ১৩০০ বছর পর আজ বিচারকার্য হতে চলেছে শবে বরাতের। বাংলাদেশের সাধারণ মুসলিমগণ দিশেহারা। তাদের কেউ শবে বরাতকে মাজলুম বা নির্যাতিত বলছেন। যুগ যুগ থেকে পালন করে আসা এ রাতের ভবিষ্যত নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। আবার সোসাল মিডিয়া কল্যাণে আধুনিক স্কলারগণ তার বিরুদ্ধে অনঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারা শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও বাংলার মাটি থেকে শবে বরাতকে উচ্ছেদের সকল আয়োজন করে রেখেছেন। শবে বরাতের বিরুদ্ধে তারা একের পর এক অভিনব, অনভিপ্রেৎ আপত্তি তোলে যাচ্ছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বড় অভিযোগ হলো সে বিদ‘আত, কুরআন হাদীসে তার অস্তিত্ব নেই, নবী সা, সাহাবী-তাবেয়ী কেউই আমল করেননি এবং বর্তমান মক্কা-মদীনার আলেমগণ তারাও ইবাদত করেন না। তাছাড়া স্কলারগণ আরো বলেছেন এ রাতের ইবাদত তাওবার দরজা বন্ধ করে দিবে, এর একটি রোজা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে, আল্লাহর আযাব নিয়ে আসবে প্রমুখ। বাদী পক্ষের মডারেট, আধুনিক, স্মার্ট, সুদর্শন, মক্কী, মাদানী টাইটেলধারী এমনকি পি এইচ ডি হোল্ডার ইসলামিক স্কলারগণ সোচ্চার আছেন তাদের মসজিদে, মাহফিলে, বিশেষত ইউটিউব ও ফেইসবুকের পোস্টের মধ্যে। আর তরল টাকার বুস্টিংয়ের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে যুবক-যুবতীদের মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। আজ শরী‘আতের কাঠগড়াতে শবে বরাতকে হাজির করা হয়েছে। স্কলারগণ কতৃক নির্ধারিত উকীল সাহেব ও শবে বরাতের মধ্যকার জেরার চৌম্বক অংশ পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলো।
উকীল: তোমার নামটাই তো বিদ‘আত। কেননা, তোমার উল্লেখ কুরআন হাদীসে নেই। এ ব্যাপারে তোমার বলার কিছু আছে?
শবে বরাত: উকীল সাহেব। আপনাদের দেশে প্রচলিত নামাজ, রোজা, বেহেস্ত, দোযখ শব্দগুলোও তো কুরআন-হাদীসে নাই। তাই বলে কোনো দিনতো তাদের ব্যাপারে আপত্তি আসলো না। কিন্তু এগুলোর আরবি নাম যেমন- সালাত, সিয়াম, জান্নাত, জাহান্নাম/নার ইত্যাদি কুরআন হাদীসে আছে। ঠিক তেমনি শবে বরাত বাংলাদেশে আমার প্রচলিত নাম। আমার আসল নামতো কুরআনের ভাষায় ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ ( বা বরকতময় রজনী) আর হাদীসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান’ ( বা মধ্য শাবানের রজনী)। আরবি নামটার জায়গাতে আমার ফারসি নামটা বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে। তাছাড়া কুরআন নাজিল হয়েছে আরবিতে আপনারা আমার ফারসি ভাষার নাম কুরআন হাদীসে কেমনে পাবেন? এটা কেমন কথা?
উকীল: আচ্ছা বুঝলাম। তোমার নাম লাইলাতুম মুবারাকা কিন্তু এটাতো শবে কদরের কথা বুঝানো হয়েছে। তোমার কথাতো না এটা স্পষ্ট বিভ্রান্তি।
শবে বরাত: ধন্যবাদ উকীল সাহেব। আপনি কিন্তু ‘শবে কদর’ বললেন, লাইলাতুল কদর বলেন নি। এটা আমাদের দেশে প্রচলিত আর এতে কোনো দোষ নেই। পরকথা সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতে
{إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ}
‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বলতে কোন রাত সে সম্পর্কে প্রায় ২৯ টি তাফসীরের কিতাবে একথা স্পষ্ট করা হয়েছে যে এটা লাইলাতুল কদর। পাশাপাশি ২৯ টি তাফসীরে কিন্তু ইকরামা র. সহ অনেক তাবেয়ী মুফাসসিরের মতে এটা ‘মধ্য শাবানের রজনী’ বা শবে বরাতের কথাও বলা হয়েছে। শবে বরাতের অস্থিত্ব আছে বিধায়ইতো তা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, সালাতুল উসতা বা মধ্যবর্তী নামায কোনটি এ প্রসংগে অধিকাংশ সাহাবীর গ্রহণযোগ্য মত তা আসরের নামায। কিন্তু অন্যান্য সাহাবী যারা ফজর, যোহর, জুমা বলেছেন তা কি ছুড়ে ফেলতে হবে। একথা কি বলা যাবে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।
একথা সঠিক যে এ আয়াত দ্বারা শবে কদর উদ্দেশ্য। কিন্তু তাই বলে শবে বরাতের অস্থিত্বই নাই এটা বলা কতটুকু যৌক্তিক উকীল সাহেব?
উকীল: আচ্ছা শুনো। তোমার নামের অর্থ হলো বিচ্ছিন্নতা অর্থাৎ আল্লাহর রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার রাত। তাই এ রাতে যে ইবাদত করবে সে আল্লাহর রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বুঝছো?
শবে বরাত: উকীল সাহেব। আপনি মুখস্ত কথা বলছেন। বারাআত অর্থ অনেক। (এসকল শায়খদের অন্ধ তাকলীদ/অনুসরণ ছেড়ে দিয়ে) আপনি যদি বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত আরবি-বাংলা অভিধান ‘মু‘জামুল ওয়াফী’ খুলে দেখতেন, তাহলে খুব ভালো হতো। কেননা, তাতে এর অর্থ লিখা আছে, মুক্ত হওয়া, নিরপরাধ হওয়া, নির্দোষ হওয়া, দায়মুক্তি ইত্যাদি। তার মানে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করলে, তার কাছে মাফ চাইলে তিনি পাপ থেকে মার্জনা করবেন, নির্দোষ করবেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন। আর সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুফাসসির আল্লামা শামসুদ্দীন কুরতুবী র. সূরা দুখানের তাফসীরে এর আরো ৪টি নাম দিয়েছেন। তিনি বলেন,
ولها أربعة أسماء: الليلة المباركة، وليلة البراءة، وليلة الصك، وليلة القدر
এ রাতের চারটি নাম আছে বরকতময় রজনী, মুক্তির রজনী, চেক প্রদানের রজনী, ভাগ্যের রজনী।
উকীল: তাহলে তোমাকে কেন ভাগ্য রজনী বলা হয়? তোমার মধ্যে ভাগ্য নির্ধারণ হয় এটাতো ঠিক নয়। কেননা, মানুষের ভাগ্যতো আল্লাহ সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগেই লিখে রেখেছেন।
শবে বরাত: উকীল সাহেব। যদি আল্লাহ তাই করে থাকেন। তাইলে শবে কদরকেও তো ভাগ্য রজনী বলা যাবে না। মূল কথা হলো আল্লাহ পাক ৫০ হাজার বছর আগে ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন এটা ঠিক। আবার প্রতি বছর শবে কদরের রাতে এবং শবে বরাতেও ভাগ্য লিখা হয় এটাও ঠিক। শুনুন এগুলোর আলোচনাতো অনেক আগেই মুফাসসিরগণ করে গেছেন। মহিউস্সুন্নাহ ইমাম বাগাবী র. (ইন্তেকাল- ৫১০ হিজরী) প্রণীত তাফসীরু বাগবীতে রয়েছে,
وروى أبو الضحى عن ابن عباس رضي الله عنهما: أن الله يقضي الأقضية في ليلة النصف من شعبان، ويسلمها إلى أربابها في ليلة القدر.
আবুদ্দুহা র. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ব্যাপারে শাবানের মধ্য রাত তথা শবে বরাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর তা শবে কদরে দ্বায়িত্বশীল ফেরেশতাদের কাছে অর্পন করেন।
ইমাম আবু সাউদ (ইন্তেকাল- ৯৮২হি) এর তাফসীরু আবিস সাউদে রয়েছে,
يبدأُ في استنساخِ ذلك من اللوحِ في ليلةِ البراءةِ ويقعُ الفراغُ في ليلةِ القدرِ فتدفعُ نسخةُ الأرزاقِ إلى ميكائيلَ ونسخةُ الحروبِ إلى جبريلَ وكذا الزلازلُ والخسفُ والصواعقُ ،
লাওহে মাহফুজ হতে (যা ৫০ হাজার বছর আগে নির্ধারিত) শবে বরাতে ঐ বছরের ভাগ্য লিখা শুরু হয় আর তা শেষ হয় লাইলাতুল কদরে। …
উকীল: আচ্ছা বাবা বুঝলাম। কিন্তু তোমার ফজীলতের ব্যাপারেতো একটিও সহীহ হাদীস নেই।
শবে বরাত: উকীল সাহেব! এটা একটা মিথ্যা অভিযোগ। আমার ব্যাপারে প্রিয়নবীর প্রায় ১৫ জন সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণিত আছে। প্রায় একই রকম অর্থবোধক সেসকল হাদীসের মধ্যে একটি যা সহীহ ইবনে হিব্বানে (হা- ৫৬৬৫) এবং সুনান ইবনে মাজাতে (হা- ১৩৯০) রয়েছে হযরত আবু মূসা আশ‘আরী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ , فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ , إِلاَّ لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ.
মধ্য শা‘বানের রজনীতে মহান আল্লাহ রহমতের ভান্ডার নিয়ে তার সকল সৃষ্টির প্রতি এক বিশেষ ভূমিকায় আবির্ভূত হন এবং মুশরিক অথবা হিংসুক ব্যক্তি ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন। সকল আলেম এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
উকীল: না এটা ঠিক নয়। আল্লামা শায়খ আলবানীতো এটাকে সহীহ বলেন নি। বরং হাসান বলেছেন।
শবে বরাত: উকীল সাহেব! আপনি নিজে আলেম নন। তাই এ টার্মগুলো বুঝবেন না। হাসান আর সহীহ হাদীসের পার্থক্য খুব বেশী নয়। এজন্য ইমাম তিরমিজী অনেক হাদীসকে ‘হাসান সহীহ’ বলেছেন। এবার আসুন আলবানী সাহেবের কথায় তার বক্তব্য রয়েছে ‘আসসিলসিলাতুস সহীহাহ্’ নামক কিতাবে (৩য় খন্ড, ২১৮ পৃষ্ঠা)। তিনি এ হাদীসের শেষে বলেন,
حديث صحيح ، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا و هم معاذ ابن جبل و أبو ثعلبة الخشني و عبد الله بن عمرو و أبي موسى الأشعري و أبي هريرة و أبي بكر الصديق و عوف ابن مالك و عائشة
এটি সহীহ হাদীস। সাহাবীদের এক দল থেকে এ হাদীসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত আছে, যাদের একে অপরকে শক্তিশালী করেছে। যাদের থেকে বর্ণিত আছে তারা হলেন- মু‘আয বিন জাবাল, আবূ ছা‘লাবা, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর, আবূ মূসা আশ‘আরী, আবূ হুরায়রা, আবূ বকর সিদ্দীকষ, আউফ বিন মালেক ও আয়েশা রা.।
উকীল: ঠিক আছে মানলাম হাসান বা সহীহ। এ রাতের মর্যাদার কথা আছে। কিন্তু ইবাদত করা লাগবে। এমনতো কোনো কথা হাদীসে নেই। বরং শিরকমুক্ত হয়ে ইশার সালাত আদায় করে ঘুমিয়ে গেলেই আল্লাহ মাফ করবেন।
শবে বরাত: উকীল সাহেব! আপনাকে একটা হাদীস শুনাই আলী রা. বলেন, রসূল সা. ইরশাদ করেছেন,
إِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ ، فَقُومُوا لَيْلَهَا وَصُومُوا نَهَارَهَا ، فَإِنَّ اللَّهَ يَنْزِلُ فِيهَا لِغُرُوبِ الشَّمْسِ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا ، فَيَقُولُ : أَلاَ مِنْ مُسْتَغْفِرٍ لِي فَأَغْفِرَ لَهُ , أَلاَ مُسْتَرْزِقٌ فَأَرْزُقَهُ , أَلاَ مُبْتَلًى فَأُعَافِيَهُ , أَلاَ كَذَا أَلاَ كَذَا ، حَتَّى يَطْلُعَ الْفَجْرُ.
যখন শা‘বানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত আসে সে রাতে তোমরা রাত জেগে নামাজ পড়বে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে প্রথম আকাশে তার রহমত নাযিল করেন এবং বলতে থাকেন কেউ আছ কি ক্ষমা চাইবার? আমি ক্ষমা করে দিব। কেউ রোগাক্রান্ত আছ কি? আমি আরোগ্য দান করব। কেউ রিযিক চাওয়ার আছ কি? আমি তাকে রিযিক দিব। আর কেউ আছ কি? আছ কি? এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা আসতে থাকে।
তাহলে আল্লাহ তা‘আলা মাফ চাইতে, রিযিক চাইতে, রোগথেকে মুক্তি চাইতে বলছেন। আর আপনারা ঘুমিয়ে থাকলে আল্লাহ মাফ করবেন এটা কেমন কথা? বরং বেশি বেশি আল্লাহর কাছে চাওয়া এটা তিনি পছন্দ করেন। দু‘আ এটাতো শ্রেষ্ঠ ইবাদত।
উকীল: এবার তোমাকে পেয়েছি। তুমি যে হাদীসটি শুনালে তাকে তো আলবানী অত্যন্ত দুর্বল বলেছেন। অন্যান্য আলেমের মতও তাই। তাহলে কেন আমরা তা মানব?
শবে বরাত: উকীল সাহেব। হাদীসটি তার শাওয়াহেদ তথা আরো অসংখ্য হাদীসের দ্বারা সমর্থিত থাকার কারণে আর দুর্বল নেই। কেননা, এ হাদীসটি ইবনু মাজা’র আস-সুনান, ইমাম বায়হাকীর শু‘য়াবুল ঈমান ও ফাদ্বায়েলুল আওকাতে, ইমাম মুনযিরীর তারগীব ওয়াত তারহীবে, ইমাম খতীব তিবরিযীর মিশকাতুল মাসাবীহতে, ইমাম ফাকেহী তার আখবারে মাক্কাতে, ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী তার লাতায়েফুল মা‘আরেফে, ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী তার জামউল জাওয়ামেতে বর্ণনা করেছেন। আর এ স্বপক্ষে পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের আমল সাব্যস্ত থাকার কারণে এর ইবাদতের পক্ষের হাদীস আর দুর্বল নেই।
উকীল: আরে ভাই তোমার রাতে নবীজি, সাহাবী, তাবেয়ী করেননি তা আমরা কেন করবো? যে কাজ নবীজি করেননি তা আমরা করবো না।
শবে বরাত: উকীল সাহেব এটা মিথ্যা কথা যে নবীজি আমল করেননি। আসল কথা হলো নবী এ রাতে শুধু আমল করেনই নি বরং তার ফজীলতের কথাও বর্ণনা করেছেন। ইবনে মাজাতে (হাদীস- ১৩৮৯) এবং মুসনাদে আহমদে (২৬০১৮) রয়েছে আয়েশা রা. বলেন,
فَقَدْتُ النَّبِيَّ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ ذَاتَ لَيْلَةٍ ، فَخَرَجْتُ أَطْلُبُهُ ، فَإِذَا هُوَ بِالْبَقِيعِ , رَافِعٌ رَأْسَهُ إِلَى السَّمَاءِ , فَقَالَ : يَا عَائِشَةُ أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ ؟ قَالَتْ ، قَدْ قُلْتُ : وَمَا بِي ذَلِكَ ، وَلَكِنِّي ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ ، فَقَالَ : إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا , فَيَغْفِرُ لأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعَرِ غَنَمِ كَلْبٍ.
এক রাত্রে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘরে না দেখে তালাশ করতে বের হলাম। দেখলাম তিনি জান্নাতুল বাকীতে (মদীনার কবরস্থানে) আকাশের দিকে মাথা তুলে চেয়ে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বললেন, তুমি কি এমন আশংকা করছো যে, আল্লাহ ও তার রসূল তোমার প্রতি যুলুম করবেন? তিনি বলেন, আমি ভাবছি আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর নিকট গেলেন কি না? তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা শা‘বানের মধ্যবর্তী রাতে দুনিয়ার আসমানে (রহম) নাযিল করেন এবং কালব গোত্রের বকরীর পশমে চেয়েও বেশি মানুষকে ক্ষমা করেন।
এ হাদীস দ্বারা নবীর রাত জেগে ইবাদত করা, কবর যিয়ারত করা প্রমাণিত হয়। আর একটি আমল সাবস্ত করণের জন্য একটি হাদীসইতো এনাফ (যথেষ্ট)। আর আপনার কি মনে হয় যে, ১৫ জনের বেশি সাহাবী এর উপর হাদীস বলবেন, আর তারা তা পালন করবেন না। তাছাড়া ইবনে আব্বাস রা. এর প্রিয় ছাত্র ইকরামা র. নিজে আমল করেছেন। এর ফজীলত বর্ণনা করেছেন। আর আল্লামা ফাকেহী তার তারিখে মাক্কা কিতাবে মক্কাবাসীর আমল বর্ণনা করেছেন। তিনি ৩য় শতাব্দির আলেম।
উকীল: আরে ইমাম তিরমিজী এ হাদীস বর্ণনা করে নিজেই বলেছেন তা দ্বয়ীফ বা দুর্বল আর তুমি তোমাকে বাঁচাতে এটা পেশ করছো?
শবে বরাত: জনাব! ইমাম তিরমিজী নিজে দুর্বল বলেন নি। বরং, বলেছেন যে ইমাম বুুখারী এটাকে দুর্বল মনে করতেন। তিনি নিজে দুর্বল বলেছেন তা প্রমাণিত নয়। আর যদি তা দুর্বলও হয় তাতেও তা আমলযোগ্য। কেননা, দুর্বল হাদীস আমলের জন্য যথেষ্ট। দুর্বল আর জাল হাদীস এক জিনিস নয়। দুর্বল হাদীস আমলের জন্য যথেষ্ট। সকল আলেম এ ব্যাপারে একমত। বাবা অসুস্থ বা দুর্বল হলে তাকে বাবা বলে কেউ কি অস্বীকার করবে? জাল না হলেই হলো। আপনি হাদীসের জ্ঞান রাখেন না, তাই আপনার সামনে এ সনদ নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন নেই। শুধু ইমাম নববী র. এর বক্তব্য শুনুন
قال العلماء من المحدثين والفقهاء : وغيرهم يجوز ويستحب العمل فى الفضائل والترغيب والترهيب بالحديث الضعيف ما لم يكن موضوعا
মুহাদ্দিস ও ফকীহ আলেমগণ বলেন- ফজিলত, উৎসাহ-নিরোৎসাহিত করণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দায়ীফ বা দুর্বল হাদীস দ্বারা আমল করা মুস্তাহাব ও জায়েজ হবে, যতক্ষণ না তা মাওজু তথা জাল হবে।
উকীল: আচ্ছা আজকে আদালতের কাজের সময় বেশি নেই আরেকদিন জেরা হবে। এখন শেষ প্রশ্ন হলো তোমার এতো বেশি ফজীলত কিন্তু যেখানে কুরআন নাযিল হলো সে মক্কা-মদীনার ইমামরা বুঝেন নি, খালি বাংলাদেশের হুজুররা বুঝে গেলেন? তারা কেন আমল করেন না? বড় বড় শায়খরা সকলেই তোমার বিরুদ্ধে আর তুমি বাংলাদেশের হুজুরদের হালুয়া-রুটির জন্য জায়েজ হয়ে গেলে?
শবে বরাত: উকীল সাহেব প্রথম কথা হলো আপনার শায়খভক্তির কারণে আপনার (এবং আপনার মতো অনেক অন্ধ শায়খ মুকাল্লিদদের) ভাষা খুবই আপত্তিকর। এবার শুনুন মন দিয়ে-
১. রসূলের সুন্নাতের সবচেয়ে বেশি পাবন্দ ছিলেন ইবনে উমর রা. তিনি বলেছেন, (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস- ৭৯২৭)
“خمس ليال لا تُرد فيهن الدعوة: أول ليلة من رجب، وليلة النصف من شعبان، وليلة الجمعة، وليلة الفطر، وليلة النحر”
পাঁচটি রাতের দু‘আ ফিরিয়ে দেয়া হয় না। রজব মাসের প্রথম রাত, শাবানের মধ্য রাত, জুমার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত ও ঈদুল আজহার রাত ।
২. ইমাম শাফেয়ী র. যিনি এক ইজমার দলীল খুজতে গিয়ে কুরআন মাজীদ পড়েছেন ৩০০ বার। তিনি বলেছেন (কিতাবুল উম্ম- ১/২৬৪),
إن الدعاء يُستجاب في خمس ليال: في ليلة الجمعة، وليلة الأضحى، وليلة الفطر، وأول ليلة من رجب، وليلة النصف من شعبان…
নিশ্চয়ই পাঁচটি রাতের দু‘আ কবুল হয়। জুমার রাত, ঈদুল আজহার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, রজব মাসের প্রথম রাত ও শাবানের মধ্য রাত।
৩. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল যিনি তার বর্ণিত প্রায় প্রতিটি আমলযোগ্য হাদীসের উপর আমল করেছেন। একবার তিনি এক ব্যক্তিকে ডেকে শিঙ্গা লাগালেন এবং তাকে এক দিরহাম দিলেন। লোকটি নিতে না চাইলে বললেন, দেখো আমি রসূলের হাদীসে পড়েছি তিনি শিঙ্গা লাগিয়ে এক দিরহাম দিয়েছেন। তাই আমি শুধু আমল করার জন্য তা করছি অসুস্থতার জন্য নয়। তাই তুমি এক দিরহাম নাও। তিনি তার কিতাবে শবে বরাতের হাদীস লিখেছেন, আর আমল করবেন না তা কি করে হয়।
৪. এখনকার মক্কা-মদীনার আমল না জেনে আগের আমল কী ছিল তা দেখেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইমাম ফাকেহী বলেন, (আখবারে মক্কা- ৩/)
إذا كان ليلة النصف من شعبان، خرج عامة الرجال والنساء إلى المسجد، فصلوا، وطافوا، وأحيوا ليلتهم حتى الصباح بالقراءة في المسجد الحرام.
যখন মধ্য শাবানের রাত আসতো তখন সকল নারী পুরুষ মসজিদে সমবেত হতেন। তারা নামায আদায় করতেন, তাওয়াফ করতেন, সারা রাত জেগে ইবাদত বন্দেগী করতেন এমনকি সকাল পর্যন্ত মসজিদে কুরআন তেলাওয়াত করতেন।
৪. ইবনে তাইমিয়া, যিনি সকলের কাছে বিশেষ করে আমার বিরুদ্ধে মামলাকারী স্কলারগণের মাথার তাজ, তিনি বলেন (আল ফাতওয়া আল কুবরা- ৫/৩৪৪)
وأما ليلة النصف من شعبان ففيها فضل، وكان في السلف من يصلي فيها، لكن الاجتماع فيها لإحيائها في المساجد بدعة”.
আর শাবানের মধ্য রাতের অনেক মর্যাদা রয়েছে। আর পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরাম এ রাতে জেগে নামায পড়তেন। তবে মসজিদে জড়ো হয়ে রাত জাগা বিদআত।
৪. শায়েখ আব্দুর রহমান মুবারকপুরী একজন বড় আলেম এবং বাদী পক্ষের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি বলেন (তুহফাতুল আহওয়াজী- ২/২২৭)
اِعْلَمْ أَنَّهُ قَدْ وَرَدَ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ عِدَّةُ أَحَادِيثَ مَجْمُوعُهَا يَدُلُّ عَلَى أَنَّ لَهَا أَصْلًا
জেনে রেখো মধ্য শাবান (বা শবে বরাতের) ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত আছে। যা প্রমাণ করে যে, তার দলীল আাছে।
এখন আমাদের বর্তমান মক্কা-মদীনা বা আমাদের দেশের শায়খরা না করলে বা বাধা দিলে আমার অস্তিত্ব নেই -এটা বলা আমার উপর যুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়।
জজ সাহেব আদালতের কার্যক্রম আজকের মতো মুলতবি করেছেন, কারণ তাকে আজ রাতে ইবাদত-বন্দগী করতে হবে। বিচারের দ্বায়িত্ব বড় কঠিন। আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিতে হবে। জেরার জটিল আর্গুমেন্ট শুনতে আর ইচ্ছে করছে না। আবার অন্য একদিন হাজির হতে বলে আপাতত মুলতবি ঘোষণা করলেন।
লেখকঃ মুহাদ্দিস দারুন্নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা।