আ’মল

প্রসঙ্গ সুবহানাযিল মুলকি, ম্যান মেইডঃ একজন আ’লিমের দায়…

মাওলানা আবদুল আউয়াল হেলাল

সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিষয়টি নিয়ে লিখব না। কিন্তু পারলাম না। এই কয়দিনে বৃটেনের বিভিন্ন শহর থেকে পরিচিত, অপরিচিত বহু মানুষ একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়ে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে লিখতে হলো। প্রথমেই একটি বিষয় খুলাসা করা দরকার, কোন ব্যক্তির সাথে ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে লেখাটি উৎসারিত নয়। তাই পাঠক বিবেচনায় রাখবেন বক্তব্য, বক্তা নয়।

বিষয়ের আদ্যোপান্তঃ
একটি টিভি’র লাইভ প্রোগ্রামে আলোচনা করছেন পূর্ব লন্ডনের নামকরা এক মসজিদের দুই নম্বর (দ্বিতীয়) ইমাম। এক ভদ্র মহিলা টেলিফোনে জিজ্ঞেস করলেন, তারাবীহ নামাযে যে দুইটি দোয়া পড়া হয়, কোনটি কোন জায়গায় পড়তে হবে? হুজুর জানতে চাইলেন, আপনি কোন দুই দোয়ার কথা বলছেন ? প্রশ্নকারি মহিলা বললেন, সুবহানা যিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি এবং আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউযু বিকা মিনান নার। এবার হুজুর বললেন, তারাবীহ নামাযে প্রতি চার রাকাত পর পর ব্যাক হোম (আমাদের দেশে) এবং এখানেও কেউ কেউ পড়ে সুবহানা যিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি। এগুলো ম্যান মেইড, বেহেশতি জেওর ও মকসুদুল মুমিনীন জাতিয় কিছু বই ছাড়া কোন কিতাবে এগুলো নেই। এসব পড়বেন না। সওয়াবের আশায় এসব পড়লে জাহান্নামে যাবেন। এরপর বিদআত বিষয়ক বিখ্যাত হাদীসটি শুনিয়ে দিলেন।
তারাবীহ নামাযের শেষে সাধারণতঃ যে দোয়াটি পড়া হয় আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউযুবিকা মিনান নার, বললেন- এটির অর্থ খুবই সুন্দর। এটি পড়তে পারেন।

ভাইরাল হওয়া উল্লিখিত বক্তব্য সম্পর্কে আলোচনার সুবিধার্থে কয়েকটি পয়েন্ট আউট করছি।
সুবহানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি তাসবীহ হলো-
★ ম্যান মেইড বা মানুষের বানানো।
★ বেহেশতি জেওর ও মকসুদুল মুমিনীন ছাড়া অন্য কোন কিতাবে ইহা নেই।
★ সওয়াবের আশায় এসব পড়লে জাহান্নামে যাবে।
এ তিন পয়েন্ট নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে আমরা দেখবো তারাবীহ নামাযের চার রাকাত পর পর উল্লিখিত তাসবীহ পড়ার নির্দেশনা কোন কিতাবে পাওয়া যায় কি না।

প্রথমতঃ সুবহানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি… এই তাসবীহ ম্যান মেইড বা মানুষের বানানো এ দাবী ভিত্তিহীন। বহুসংখ্যক কিতাবে উল্লিখিত তাসবীহ ফিরিশতাদের তাসবীহ বা তাসবীহে মালাইকাহ বলে বর্ণিত আছে। যেমন-
ﻋﻦ ﺳﻌﻴﺪ ﺑﻦ ﺟﺒﻴﺮ ﺍﻥ ﻋﻤﺮ ﺑﻦ ﺍﻟﺨﻄﺎﺏ ﺳﺎﻝ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻋﻦ ﺻﻼﺓ ﺍﻟﻤﻼ ﺀﻛﺔ ﻓﻠﻢ ﻳﺮﺩ ﻋﻠﻴﻪ ﺷﻴﺎً ﻓﺎﺗﺎﻩ ﺟِﺒْﺮِﻳﻞ ﻓﻘﺎﻝ ﺍﻥ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀﺍﻟﺪﻧﻴﺎ ﺳﺠﻮﺩ ﺍﻟﻰ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ ﻳﻘﻮﻟﻮﻥ : ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺫﻱ ﺍﻟﻤﻠﻚ ﻭﺍﻟﻤﻠﻜﻮﺕ، ﻭﺃﻫﻞ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀ ﺍﻟﺜﺎﻧﻴﺔ ﺭﻛﻮﻉ ﺍﻟﻰ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ ﻳﻘﻮﻟﻮﻥ : ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺫﻱ ﺍﻟﻌﺰﺓ ﻭﺍﻟﺠﺒﺮﻭﺕ، ﻭﺃﻫﻞ ﺍﻟﺴﻤﺎﺀ ﺍﻟﺜﺎﻟﺜﺔ ﻗﻴﺎﻡ ﺍﻟﻰ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ ﻳﻘﻮﻟﻮﻥ : ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺫﻱ ﺍﻟﺤﻲ ﺍﻟﺬﻱ ﻻ ﻳﻤﻮﺕ .
( ﺍﻟﺪﺭ ﺍﻟﻤﻨﺜﻮﺭ ﻟﻸﻣﺎﻡ ﺍﻟﺴﻴﻮﻃﻲ ، ﺍﻟﻤﺠﻠﺪ ﺍﻻﻭﻝ ﺻﺤﻔﺔ ١١٣ – ١١٤ )
হযরত সাঈদ বিন জুবায়ির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। হযরত উমার বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু ফিরিশতাদের সালাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি কোন জবাব দিলেন না। ইতোমধ্যে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে বললেন, দুনিয়ার আকাশে কিছু ফিরিশতা সিজদারত আছেন কিয়ামত অবদি সময়ের জন্য, তারা সুবহানাযিল মুকলি ওয়াল মালাকুতি এই তাসবীহ পড়ছেন। দ্বিতিয় আকাশে কিয়ামত অবদি সময়ের জন্য কিছু ফিরিশতা রুকু অবস্থায় পড়ছেন, সুবহানাযিল ইযযাতি ওয়াল জাবারূতি। তৃতিয় আকাশে কিছু ফিরিশতা কিয়ামত অবদি সময়ের জন্য কিয়ামরত অবস্থায় পড়ছেন, সুবহানাল হায়্যিল্লাযি লা ইয়ামুতু। (ইমাম সুয়ূতী- আদদুররুল মানছূর, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ১১৩-১১৪)

ইমাম ইবনু কাছীর রাহিমাহুল্লাহ হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করেছেন। সে বর্ণনায় প্রথম তিন আকাশে ফিরিশতাগণের পঠিত তাসবীহ সুবহানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি,সুবহানা্যিল ইযযাতি ওয়াল জাবারূতি, সুবহানাল হায়্যিল্লাযি লা ইয়ামুতু; তিন আকাশে ফিরিশতাদের এ তিন তাসবীহ’র সাথে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আকাশে ফিরিশতাদের আরোও তাসবীহ উল্লেখ করেছেন।

সুতরাং সাহাবী সাঈদ বিন জুবায়ির ও আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে ফিরিশতাগণের পঠিত তাসবীহ বলে যে তাসবীহ উল্লিখিত হয়েছে, সেটিকে মুখের উপর ম্যান মেইড, বেদআত, পড়লে জাহান্নামে যাবে ইত্যাদি ফতোওয়া দিয়ে মানুষের মনে সন্দেহের বীজ বপন করা কোন আলিমের কাজ হতে পারে না।

পাঠক ! এতক্ষণে আশা করি পরিস্কার হয়েছে যে, এই তাসবীহ ম্যান মেইড বা মানুষের বানানো নয়। হাদীসে এই তাহবীহ উল্লেখ আছে।

বেহেশতি জেওর ও মকসুদুল মুমিনীন ছাড়া অন্য কিতাবে এ তাসবীহ নেই, এই দাবী রীতিমত হাস্যকর। অবশ্য কারো পড়া শোনা যদি বেহেশতি জেওর আর মকসুদুল মুমিনীন পর্যন্ত সিমীত থাকে তবে সে ভিন্ন কথা। আর না হয় ইমাম ইবনু জারীর তাবারী (২২৪-৩১০ হিজরি) প্রণীত তাফসীরে তাবারী ১ম খণ্ড, ইমাম ইবনু কাছীর (৭০২-৭৭৪ হিজরি) প্রণীত তাফসীরে ইবনু কাছীর ১ম খণ্ড এবং ইমাম সুয়ূতী (৮৪৯-৯১১ হিজরি) প্রণীত আদদুররুল মানছূর ১ম খণ্ডসহ আরো অন্যান্য কিতাবে তাসবীহে মালাইকা বলে এই তাসবীহ উল্লেখ আছে। একজন শায়খ বা আলিমের উল্লিখিত কিতাবসমূহ অধিত থাকা উচিত।

তারাবীহ নামাযে চার রাকাত পর পর এ তাসবীহ পড়াঃ
তারাবীহ নামাযে প্রতি ﺗﺮﻭﻳﺤﺔ বা চার রাকাত পর পর কিছু সময় বিশ্রামের কথা বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ আছে।বিশ্রামকালিন করণীয় সম্পর্কে চার মাযহাবের কিতাবাদিতে বর্ণনা রয়েছে। সেই বর্ণনার সারসংক্ষেপ হলো- এ সময় কী করবে, তা সম্পূর্ণ মুসল্লির ইচ্ছাধিন। চাইলে চুপচাপ বসে থাকবে।চাইলে যে কোন তাসবীহ, তাকবীর ও তাহলীল করবে। চাইল কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করবে। চাইলে দুরূদ শরীফ পড়বে। এমনকি চাইলে একাকী দু’রাকাত নফল নামায পড়তে পারবে।
ফতোওয়ায়ে শামী নামে খ্যাত হানাফী মাযহাবের কিতাব রাদ্দুল মুহতার আলাদদুররিল মুখতার এ ইমাম ইবনু আবিদীন শামী (১১৯৮-১২৫২ হিজরি) প্রতি চার রাকাত পর বিশ্রামের সময় করণীয় সম্পর্কে বলেন-
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﻘﻬﺴﺘﺎﻧﻲ : ﻓﻴﻘﺎﻝ ﺛﻼﺙ ﻣﺮﺍﺕ ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺫﻱ ﺍﻟﻤﻠﻚ ﻭﺍﻟﻤﻠﻜﻮﺕ، ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺫﻱ ﺍﻟﻌﺰﺓ ﻭﺍﻟﻌﻈﻤﺔ ﻭﺍﻟﻘﺪﺭﺓ ﻭﺍﻟﻜﺒﺮﻳﺎﺀ ﻭﺍﻟﺠﺒﺮﻭﺕ،ﺳﺒﺤﺎﻥ ﺍﻟﻤﻠﻚ ﺍﻟﺤﻲ ﺍﻟﺬﻱ ﻻﻳﻤﻮﺕ، ﺳﺒﻮﺡ ﻗﺪﻭﺱ ﺭﺏ ﺍﻟﻤﻼﺀﻛﺔ ﻭﺍﻟﺮﻭﺡ …..
( ﺭﺩﺍﻟﻤﺤﺘﺎﺭ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﺪﺭ ﺍﻟﻤﺨﺘﺎﺭ، ﺍﻟﻤﺠﻠﺪ ﺍﻟﺜﺎﻧﻲ، ﺻﺤﻔﺔ ٤٧٩ )
কাহাস্তানী বলেছেন, (এ সময় ) তিনবার বলবে-সুবহানাযিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানাযিল ইযযাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়ায়ি ওয়াল জাবারূত, সুবহানাল মালিকিল হায়্যিল্লাযি লা ইয়ামুতু , সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুল মালাইকাতি ওয়ার রূহ…
(রাদ্দুল মুহতার আলাদদুররিল মুখতার,২য় খণ্ড পৃষ্ঠা ৪৭৯)

সুতরাং বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেখানেই হানাফী মাযহাবের অনুসারি মুসলমানের অধিবাস, তারা ইমাম ইবনু আবিদীন রাহিমাহুল্লাহ’র নির্দেশনা অনুযায়ি তারাবীহ নামাযে প্রতি চার রাকাত পর পর উল্লিখিত তাসবীহ পাঠ করেন।

দ্বীনী শিক্ষায় সতর্কতাঃ
সাহাবী আবু হুরাইরা, আনাস বিন মালিক, যায়িদ বিন সাবিত, আবদুল্লাহ বিন আব্বাস,আবদুল্লাহ বিন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুম’র ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ বিন সিরীন রাহিমাহুল্লাহ (ওফাত ১১০ হিজরি) দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ﺍﻧﻈﺮﻭﺍ ﻋﻤﻦ ﺗﺄﺧﺬﻭﻥ ﺩﻳﻨﻜﻢ লক্ষ রেখো, তোমরা তোমাদের দ্বীন কার কাছ থেকে গ্রহন করছো ? তাই ইসলামি শিক্ষা গ্রহনের ক্ষেত্রে উস্তাদের আকীদা বিশ্বাস, তাকওয়া, ইলমি গভীরতা ও আমানতদারি, সনদ পরম্পরা ইত্যাদির খুঁজ খবর নিয়ে উস্তাদ নির্ধারণ করতে হবে। নতুবা এভাবেই ফিরিশতাগণের পঠিত তাসবীহকে ম্যান মেইড, বিদআত আখ্যায়িত করে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেবে।

নবীজির নির্দেশনাঃ
পরিশেষে মুসলিম শরীফের মুকাদ্দিমা বা ভূমিকায় বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করে লেখার ইতি টানতে চাই।
ﻋﻦ ﺍﺑﻲ ﻫﺮﻳﺮﺓ ﺭﺿﻲ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻪ ﻋﻦ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻗﺎﻝ : ﺳﻴﻜﻮﻥ ﻓﻲ ﺍﺧﺮ ﺍﻣﺘﻲ ﺃﻧﺎﺱ ﻳﺤﺪﺛﻮﻧﻜﻢ ﺑﻤﺎ ﻟﻢ ﺗﺴﻤﻌﻮﺍ ﺃﻧﺘﻢ ﻭﻻ ﺁﺑﺎﺀﻛﻢ ﻓﺈﻳﺎﻛﻢ ﻭﺍﻳﺎﻫﻢ .
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, আমার উম্মতের আখেরি যামানায় এমন কিছু লোক আভির্বুত হবে তারা তোমাদের সামনে এমন সব অভিনব বয়ান পেশ করবে,যা তোমরা কখনো শুনোনি, তোমাদের বাপ দাদারও শুনেনি। তোমরা তাদের থেকে দূরে থেকো, আর তাদেরকে তোমাদের থেকে দূরে রেখো।

হায় ! সেদিন টেলিভিশনে প্রশ্নকারি মহিলাকে যদি বলে আসতে পারতাম, বোন! ঐ কথিত শায়খ আপনাকে এবং অগণিত দর্শক শ্রোতাকে সেদিন মিসগাইড করেছেন। ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *