মনীষাসংবাদ

কুরআনে পাকের এক নিরলস খাদিমের বিদায়

মাওলানা মাহমুদ হাসান চৌধুরী রায়হান

হযরত মাওলানা মো. আব্দুশ শাকুর চৌধুরী (র.) ফুলতলী কিছুদিন পূর্বে আমাদের ছেড়ে মাওলার সান্নিধ্যে চলে গেছেন। মরহুমের ইন্তেকালে শোকে ভাসছেন তাঁর হাজারো ছাত্র, পরিবার-পরিজন, এলাকাবাসীসহ শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কঠোর লকডাউনের মাঝেও হাজারো মানুষের ভালোবাসায় চিরবিদায় নিলেন কুরআনে পাকের এই নিরলস খাদিম।

জীবদ্দশায় তিনি অনেক দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার গভর্নিং বডির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন ২ বার। চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বেশিরভাগ সময় দ্বীনি মাহফিল ও দাওয়াতি কাজে ব্যস্ত থাকতেন। সেজন্য তিনি বাড়িতে খুব কমই অবস্থান করতেন। এলাকার মানুষের সাথে সদাহাস্যজ্বল, অমায়িক ও হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহারের কারণে মানুষজন তাকে ভালোবাসত এবং শ্রদ্ধা করত।

তবে তাঁর সব পরিচয় ছাপিয়ে যে বিষয়টি মূখ্য ছিলো তিনি ছিলেন ইলমে কিরাতের একজন একনিষ্ঠ খাদিম ও বিজ্ঞ উস্তায। হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর কিরাতের প্রথম দিকের ছাত্রদের মধ্যে তিনি উল্লেখযোগ্য ছিলেন। দীর্ঘসময় ছাহেব কিবলাহর সান্নিধ্যে থেকে কিরাত শিক্ষার সুযোগ লাভ করায় তিনি ইলমে কিরাতে অনেক পারদর্শী ছিলেন।

ফুলতলী ছাহেব কিবলার (র.) প্রতিষ্ঠিত দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট, প্রধান কেন্দ্রে রামাদ্বান মাসে সুদীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে খিদমাত করেছেন নিরলসভাবে। দারুল কিরাতের সর্বোচ্চ ক্লাস ছাদিছ জামাতের পরীক্ষক হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন দীর্ঘদিন। এমনকি তাঁর ইন্তেকালের কিছুদিন আগে ফুলতলীতে দারুল কিরাতের বিশেষ কোর্সে দারস দিয়েছেন নিয়মিত। কোর্স শেষের তিনদিন আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একমাস পর ১১ই জুলাই ২০২১ ঈসায়ীতে ৮১ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।

তিনি ছাত্রদের নিকট অনেক শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। তাঁর আবেগঘণ বিশুদ্ধ তিলাওয়াতে ছাত্ররা মুগ্ধ হতো। সদাহাস্যজ্বল এবং সন্তানসুলভ অমায়িক স্নেহের কারণে ছাত্ররা উনার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পেত বেশি। সম্মোহনী গল্পাচ্ছলে অনেক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে ছাত্রদের সাথে আলোচনা করতেন। এমনকি তিনি যখন বাড়িতে যেতেন তখন অনেক ছাত্র উনার সাথে বাড়ি পর্যন্ত চলে যেত।

আমরা দেখেছি, অনেক বয়স হওয়া সত্বেও দারুল কিরাতে নিয়মিত ও যথাসময়ে ক্লাস নিতেন। কিরাত, মশক ও সবক গ্রহণের পাশাপাশি সবসময় তাজবীদের ক্লাসও নিতেন। ছাত্রদের পড়ার মধ্যে কোন সমস্যা থাকলে সেগুলো নিয়ে সবার সাথে আলোচনা করতেন ও সমাধানে সচেষ্ট হতেন।

রামাদ্বান মাসে দীর্ঘদিন দারুল কিরাতের খিদমাতে নিয়োজিত থাকায় দেশ বিদেশে তাঁর হাজার হাজার ছাত্র ছড়িয়ে আছেন। এছাড়া ওয়াজ মাহফিলে যাতায়াতের সুবাধে তাঁর আলাদা একটি পরিচিতি ও সুনাম ছিল। এজন্য বৃহত্তর সিলেটে উনার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ও মায়ার মানুষজন আছেন। গলার স্বর হযরত ছাহেব কিবলাহ’র সাথে অনেকটা সামঞ্জস্য থাকায় অনেকেই তার বয়ানে আবেগ আপ্লূত হতেন।

কালামে পাকের এই ত্যাগী খাদিম দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে মাওলার সান্নিধ্যে চলে গেছেন। সাদকায়ে জারিয়া হিসাবে রেখে গেছেন তাঁর ইলমে কিরাতের হাজার হাজার ছাত্র। সিলসিলা থেকে সিলসিলা ধরে এই সাদকায়ে জারিয়া বহমান থাকবে। যার সাওয়াব তার রূহের মাগফিরাত চাইতে থাকবে। এটা নিশ্চয় এক মহাসৌভাগ্যের বিষয়।

আমরা কায়মনোবাক্যে দু’আ করি কালামে পাকের খাতিরে মহান আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করুন এবং দরজা বুলন্দ করুন। তার সারাজীবনের ইলমে কিরাতের খিদমাতের ওসিলায় জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মাকাম নসীব করুন। আমীন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *