আ’মলআক্বীদা

ঈদে মীলাদুন্নবী ﷺ : কিছু প্রশ্নের জবাব

হাফিয মাওলানা মারজান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী

বরকতময় রবিউল আউয়াল মাসেই পৃথিবীপৃষ্ঠে শুভাগমন করেছিলেন সৃষ্টিজগতের প্রতি মহান স্রষ্টার সবচেয়ে বড় রহমত, আমাদের প্রিয়নবী সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাই এ মাস মুমিনের জন্য পরম আনন্দের। এ মাসে আমরা হৃদয়ের সব আবেগ, অনুভূতি ঢেলে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করি। যারা মীলাদুন্নবী উদযাপন করার বিপক্ষে, তাদের কাছ থেকে প্রত্যেক রবিউল আউয়ালে আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়। আমরা প্রশ্নগুলো একত্রিত করে কুরআন-সুন্নাহ ও ইনসাফপূর্ণ যুক্তির আলোকে জবাব দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছি। উক্ত নিবন্ধে হাদীসের সাথে মাকতাবাতুশ শামিলাহ অনুসারে হাদীসের নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
ঈদে মীলাদুন্নবী কেন উদযাপন করা হয়?
ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা হয় নিআমতের শুকরিয়া আদায় করা, নিআমতকে স্মরণ করা এবং খুশি প্রকাশ করার জন্য। আল্লাহ যখন তাঁর বান্দাদের প্রতি নিআমত দান করেন, তখন নিআমতের শুকরিয়া আদায় করা বান্দার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে আল্লাহ আমাদেরকে শুকরিয়া আদায় করার তাগিদ দিয়েছেন। বলেছেন,
وَمَن شَكَرَ فَإِنَّمَا يَشْكُرُ لِنَفْسِهِ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ رَبِّي غَنِيٌّ كَرِيمٌ
“যে শুকরিয়া আদায় করল, সে তার নিজের (কল্যাণের) জন্যই শুকরিয়া আদায় করল। আর যে অকৃতজ্ঞ হলো (সে জেনে রাখুক) আমার রব অভাবমুক্ত, মহানুভব।” (সূরা আন নামল, আয়াত-৪০)
আল্লাহ কেবল শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ-ই দেননি, বরং এর প্রতিদান ও শুকরিয়া আদায় না করার শাস্তিও ঘোষণা করেছেন। বলেছেন,
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِن شَكَرْتُمْ لأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
“স্মরণ করো, যখন তোমাদের রব ঘোষণা করেন, যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য আমার নিআমত বৃদ্ধি করে দেব। আর তোমরা যদি অকৃতজ্ঞ হও, (তবে) আমার আযাব অত্যন্ত কঠোর।” (সূরা ইবরাহীম, আয়াত-৭)
যে কোনো নিআমতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য প্রথমে ওই নিআমতকে স্মরণ রাখা আবশ্যক। আমাদের পূর্ববর্তী উম্মাহ বনী ইসরাঈলকে আল্লাহ এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন, এবং আমাদেরকেও দিয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ
“হে মুমিনগণ, তোমাদের প্রতি আল্লাহর নিআমতকে স্মরণ করো।” (সূরা মায়িদা, আয়াত-১১; সূরা আহযাব, আয়াত-৯)
কেবল স্মরণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং আল্লাহ আমাদেরকে নিআমত প্রাপ্তির জন্য আনন্দিত হওয়ার অনুপ্রেরণাও দিয়েছেন। বলেছেন,
قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَٰلِكَ فَلْيَفْرَحُوا
“বলুন, আল্লাহর করুণা ও রহমতের বদৌলতেই (কুরআন এসেছে)। অতএব এর প্রতি সবার আনন্দিত হওয়া উচিৎ।” (সূরা ইউনুস, আয়াত-৫৮)
আমাদের প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিআমত কী, সেটি স্বয়ং আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন,
لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ
“নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত করুণা করেছেন, যখন তাদের নিকট তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৬৪)
উপরোক্ত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের জন্য আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিআমত হচ্ছেন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বাকি সব নিআমত আমরা পেয়েছি এই নিআমতের ওয়াসীলায়। যেহেতু আমাদেরকে নিআমতের শুকরিয়া আদায় করা, নিআমতকে স্মরণ করা এবং খুশি প্রকাশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই আমরা ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করার মাধ্যমে আমাদের প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিআমতকে স্মরণ করি, খুশি প্রকাশ করি এবং নিআমতের শুকরিয়া আদায় করি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তাঁর নিজের মীলাদ পালন করেছেন?
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা হয় আল্লাহর নিআমতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য। আমরা দেখি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের মীলাদ তথা জন্মের শুকরিয়া আদায়স্বরূপ প্রতি সোমবার রোযা রাখতেন। আবু কাতাদাহ আনসারী (রা.) বলেছেন,
وَسُئِلَ عَنْ صَوْمِ يَوْمِ اَلِاثْنَيْنِ قَالَ ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ وَبُعِثْتُ فِيهِ
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, সোমবার দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনে আমার প্রতি (প্রথম) ওহী নাযিল হয়েছে।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬২)
ঈদে মীলাদুন্নবী যে পদ্ধতিতে উদযাপন করা হয়, শরীআতে কি এর কোনো দলীল আছে?
প্রথমত, আমরা ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করাকে শারঈ ইবাদত মনে করি না। শারঈ ইবাদত কেবল সেগুলোই, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সুস্পষ্টভাবে আমাদের জন্য আবশ্যক করেছেন এবং নিয়মকানুন শিখিয়ে দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, যদি পদ্ধতির কথা বলতে হয়, তাহলে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করার সুন্নাহ-সমর্থিত পদ্ধতি হচ্ছে রোযা রাখা, যেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনে রোযা রেখেছেন। এছাড়া কুরআন শরীফে নিআমতকে স্মরণ করা এবং খুশি প্রকাশ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যা আমরা প্রথম প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করেছি। অতএব রোযা রাখা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত, জীবনাদর্শ ও মানাকিব আলোচনা করার মাধ্যমে নিআমতকে স্মরণ করা এবং হালাল পন্থায় খুশি প্রকাশ করার দলীল রয়েছে। এবার যদি কেউ খুশি প্রকাশ করতে গিয়ে হারাম পন্থা অবলম্বন করে, তাহলে সেটি অবশ্যই বর্জনীয়। এটি কেবল মীলাদুন্নবীর ক্ষেত্রে নয়। বরং যে কোনো নামে, যে কোনো অনুষ্ঠান বা উদযাপন করার ক্ষেত্রে এ মূলনীতি কার্যকর হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ওয়ায করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনভর সাহাবীদেরকে ওয়ায করেছেন। এবার কেউ যদি ওয়াযের জন্য জনসমাগম ঘটায় এবং শামিয়ানা টানিয়ে মাহফিলের আয়োজন করে, তাহলে সেটি একটি পদ্ধতিগত ইজতিহাদ হবে। যদি পদ্ধতি হালাল পন্থায় হয়, তাহলে তা মুবাহ অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য। আর পদ্ধতির মধ্যে হারাম কিছু প্রবেশ করলে তা অবশ্যই বর্জনীয়। কেউ যদি বলেন, সাহাবায়ে কিরাম এভাবে ঘটা করে মীলাদুন্নবী পালন করেননি, তাহলে সেটি ঠিক কথা। তবে সাহাবীরা ঘটা করে সীরাত কনফারেন্স, ওয়ায মাহফিল কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানও পালন করেননি। অথচ আমাদের সময়ে প্রত্যেক দল ও গোষ্ঠী যার যার অনুষ্ঠানগুলো অত্যন্ত আড়ম্বর সহকারে পালন করে। এটি একটি পদ্ধতিগত ইজতিহাদ ব্যতীত আর কিছুই নয়।
ইসলামে ঈদ মাত্র দুটি। তাহলে ঈদে মীলাদুন্নবীকে ‘ঈদ’ বলা হয় কেন? এই ঈদের নামায কখন পড়া হয়?
ইসলামে ঈদ মাত্র দুটি– এ কথাটি মূর্খতার পরিচায়ক। ইসলামে ‘শারঈ ঈদ’ দুটি– ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদ্হা। শারঈ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, যা ইসলামী শরীআহ কর্তৃক আবশ্যকীয়, এবং এর হুকুম-আহকাম শরীআহ কর্তৃক নির্ধারিত। শাব্দিক অর্থে ইসলামে আরও অনেক ঈদ রয়েছে। ঈদ শব্দের অর্থ খুশির প্রত্যাবর্তন, অর্থাৎ যে খুশি ফিরে ফিরে আসে। একবার আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) সূরা মায়িদার ৩ নং আয়াত তিলাওয়াত করছিলেন। তখন এক ইয়াহুদী বলল, যদি এ আয়াত আমাদের জন্য নাযিল হত, তাহলে আমরা ওই দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করতাম। ইবন আব্বাস (রা.) বললেন,
فَإِنَّهَا نَزَلَتْ فِي يَوْمِ عِيدٍ فِي يَوْمِ جُمُعَةٍ وَيَوْمِ عَرَفَةَ
“এ আয়াতটি (আমাদের) ঈদের দিনেই নাযিল হয়েছে। এটি নাযিল হয়েছে শুক্রবার, আরাফার দিন।” (তিরমিযী, হাদীস নং ৩০৪৪)
অর্থাৎ আয়াতটি যেদিন নাযিল হয়েছে, সেদিন ছিল শুক্রবার এবং তারিখ ছিল ৯ই যিলহজ্জ তথা আরাফার দিন। ইবন আব্বাস (রা.) শুক্রবার এবং আরাফার দিনকে ঈদের দিন বলেছেন। বছরে শুক্রবার আসে ৫২টি, আরাফাহ আসে একবার। ৫৩টি ঈদ তো এখানেই হয়ে গেল। যারা বলেন, ঈদে মীলাদুন্নবী ‘ঈদ’ হলে সেই ঈদের নামায কখন পড়া হয়? আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করছি, আরাফার দিনও তো ঈদের দিন। সেই ঈদের নামায কখন পড়া হয়?
বস্তুত, মুসলমানদের যে কোনো খুশির দিনকে শাব্দিক অর্থে ঈদ বলা যায়। পবিত্র কুরআনে (সূরা মায়িদা, আয়াত-১১৪) হযরত ঈসা (আ.) এর একটি দুআ রয়েছে, যেখানে তিনি আসমান থেকে খাদ্য অবতীর্ণ করার জন্য আরয করেছেন। সাথে বলেছেন, খাদ্য অবতীর্ণ হলে তা পূর্বাপর সবার জন্য ঈদ হয়ে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত ঈসা (আ.) যখন ‘ঈদ’ বলেছেন, তখন কি তিনি সেই ঈদের আলাদা নামাযও আদায় করেছেন? জবাব হচ্ছে, না। কারণ তিনি শারঈ অর্থে ঈদ বলেননি। বলেছেন শাব্দিক অর্থে। একইভাবে আমরাও ১২ই রবিউল আউয়ালকে ঈদে মীলাদুন্নবী বলি। শারঈ ঈদ হিসেবে নয়, বরং শাব্দিক অর্থে খুশির দিন বুঝানোর জন্য।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম ১২ই রবিউল আউয়াল হয়েছিল, এর কোনো প্রমাণ আছে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম হয়েছিল ‘আমুল ফিল’ তথা হাতির বছর। যে বছর আবরাহা হাতির বাহিনী নিয়ে কাবা শরীফ ভাঙ্গতে এসেছিল, সে বছরই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন। কাইস ইবন মাখরামা (রা.) বলেছেন,
وُلِدْتُ أَنَا وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الفِيلِ
“আমি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতির বছর জন্মগ্রহণ করেছি।” (তিরমিযী, হাদীস নং ৩৬১৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন সোমবার, যা আমরা ইতোপূর্বে (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬২) উল্লেখ করেছি। তারিখটি ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রথম জীবনী লেখক, প্রখ্যাত তাবিঈ ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক এই মত পোষণ করেছেন, যা হাদীস ও সীরাতের কিতাবসমূহে উল্লেখিত আছে। আমরা কেবল হাদীসের কিতাব থেকে কথাটি আনব। ইবন ইসহাক বলেছেন,
وُلِدَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِاثْنَتَيْ عَشْرَةَ لَيْلَةً مَضَتْ مِنْ شَهْرِ رَبِيعٍ الْأَوَّلِ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের ১২টি রাত গত হওয়ার পর (অর্থাৎ ১২ তারিখ সকালে) জন্মগ্রহণ করেছেন।” (আল-মুসতাদরাক, হাদীস নং ৪১৮২; শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং ১৩২৪; দালাইলুন নুবুওয়্যাহ, খ. ১, পৃ. ৭৪)
১২ই রবিউল আউয়াল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেছিলেন। তাহলে এ দিন শোক পালনের পরিবর্তে শুধু আনন্দ উদযাপন করা হয় কেন?
হাদীসের দিকে গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তিকাল করেননি। মাস রবিউল আউয়াল-ই ছিল, তবে তারিখটি ১২ নয়। এটি আমাদের গবেষণা এবং আমরা এর প্রমাণ দিচ্ছি।
এক ইয়াহুদী উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর কাছে সূরা মায়িদার ৩ নং আয়াত উল্লেখ করে বলল, যদি এ আয়াত আমাদের জন্য নাযিল হত, তাহলে আমরা ওই দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করতাম। উমর (রা.) বললেন,
قَدْ عَرَفْنَا ذَلِكَ اليَوْمَ وَالمَكَانَ الَّذِي نَزَلَتْ فِيهِ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ قَائِمٌ بِعَرَفَةَ يَوْمَ جُمُعَةٍ
“আমরা জানি, এই আয়াত কোন দিন এবং কোথায় নাযিল হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৫)
সূরা মায়িদার ৩ নং আয়াত নাযিল হয়েছিল বিদায় হজ্জের দিন, অর্থাৎ ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জ, আরাফার ময়দানে। উমর (রা.) এর কথা থেকে এটিও জানা যায় যে, দিনটি ছিল শুক্রবার। এবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের দিন সম্পর্কে একটি হাদীস দেখা যাক। আনাস (রা.) বলেছেন,
أَنَّ الْمُسْلِمِينَ بَيْنَاهُمْ فِي الْفَجْرِ يَوْمَ الاِثْنَيْنِ وَأَبُو بَكْرٍ رضى الله عنه يُصَلِّي بِهِمْ فَفَجَأَهُمُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم قَدْ كَشَفَ سِتْرَ حُجْرَةِ عَائِشَةَ… وَتُوُفِّيَ ذَلِكَ الْيَوْمَ
“এক সোমবার যখন লোকেরা আবু বকর (রা.) এর ইমামতীতে ফজরের নামায আদায় করছিলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়িশা (রা.) এর ঘরের পর্দা সরিয়ে মানুষের সামনে আসলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই দিনই ইন্তিকাল করেছেন।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২০৫)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেছেন ১১ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে, এতটুকু সবার জানা। আনাস (রা.) এর কথা থেকে এটিও জানা যায় যে, দিনটি ছিল সোমবার। এবার ছোট একটি হিসেব কষলে দেখা যায়, বিদায় হজ্জের দিন, অর্থাৎ ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জ যদি শুক্রবার হয়, যেভাবে উমর (রা.) বলেছেন, তাহলে ১১ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার হতে পারে না। বিদায় হজ্জের দিন থেকে ইন্তিকালের দিন পর্যন্ত তিনটি মাস গত হয়েছিল। ১০ম হিজরীর যিলহজ্জ মাস এবং ১১ হিজরীর মুহাররাম ও সফর মাস। এরপর রবিউল আউয়াল মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেন। আরবী মাস ৩০ অথবা ২৯ দিনে হয়ে থাকে। ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জ শুক্রবার ধরে নিয়ে যিলহজ্জ, মুহাররাম ও সফর– এই তিন মাসকে যদি ৩০ দিন করে ধরি, তাহলে ১১ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল হয় রবিবার। দুই মাস ৩০ ও এক মাস ২৯ দিন করে ধরলে ১২ই রবিউল আউয়াল হয় শনিবার। দুই মাস ২৯ ও এক মাস ৩০ দিন করে ধরলে ১২ই রবিউল আউয়াল হয় শুক্রবার। আবার তিনটি মাসই ২৯ দিন করে ধরলে ১২ই রবিউল আউয়াল হয় বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহজ্জ শুক্রবার (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৫) ধরে নিলে, ১১ হিজরীর ১২ই রবিউল আউয়াল কোনো অবস্থাতেই সোমবার হয় না। অথচ হাদীসে (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২০৫) স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার ইন্তিকাল করেছেন। তাই সহীহ বুখারীর উল্লেখিত দুটি হাদীসের আলোকে মানতেই হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তিকাল করেননি। ১১ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসের অন্য কোনো তারিখে ইন্তিকাল করেছেন, তবে দিন ছিল সোমবার। হিসেবটি বিশ্বাস না হলে নিজেরা করে দেখতে পারেন।
তবুও যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তিকাল করেছেন, তাতেও আমাদের জন্য শোক পালন করার সুযোগ নেই|
কারণ কারও মৃত্যুতে তিনদিনের অধিক শোক পালন করতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন, কেবল স্বামীহারা নারী ব্যতীত। যে নারীর স্বামী মারা গেছেন, তার জন্য চারমাস দশদিন পর্যন্ত শোক পালন করার বিধান রয়েছে (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৮১)। অপরদিকে 12ই রবিউল আউয়াল আনন্দিত হওয়া বা খুশি প্রকাশ করতে কোনো বাধা নেই। তাই আমরা এ দিনে শোক পালন করি না, বরং খুশি প্রকাশ করি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের এত বছর পরেও কেন ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করতে হবে?
এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে দুটি হাদীসের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) বলেছেন, সাহাবীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে (তাবুক অভিযানে) যাওয়ার পথে হিজর নামক এলাকা অতিক্রম করলেন। ওই এলাকায় সামুদ জাতির বসবাস ছিল। সাহাবীরা সেখানে একটি কূপ থেকে পানি সংগ্রহ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা জানতে পেরে সাহাবীদেরকে ওই পানি ফেলে দিতে বললেন এবং অন্য একটি কূপ দেখিয়ে সেখান থেকে পানি নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। প্রথম কূপটি ছিল সামুদ গোত্রের। তারা ওই কূপ থেকে পানি ব্যবহার করত। দ্বিতীয় কূপ থেকে নবী সালিহ (আ.) এর উষ্ট্রী পানি পান করত। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৩৭৯)
আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বলেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এসে দেখলেন ইয়াহুদীরা আশুরার দিন রোযা রাখে। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল,
هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللهُ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ فَصَامَهُ مُوسَى قَال فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
“এটি বরকতময় দিন। এদিন আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তাই মূসা (আ.) এদিন রোযা রাখতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের চেয়ে মূসা (আ.) এর অধিক নিকটবর্তী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রাখলেন এবং সাহাবীদেরকেও রাখার নির্দেশ দিলেন।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০০৪)
প্রথম হাদীসে আমরা দেখলাম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে সামুদ জাতির কূপ থেকে পানি পান করতে নিষেধ করেছেন। কারণ সামুদ জাতির উপর আল্লাহ আযাব দিয়েছিলেন। সালিহ (আ.) এর উট যে কূপ থেকে পানি পান করত, সে কূপের পানি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ ওই উট আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন ছিল। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ওই এলাকায় সামুদ জাতি এবং সালিহ (আ.) এর বসবাস ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে। এতদিনে ওসব কূপ কতবার শুকিয়েছে আর কতবার তাতে নতুন পানি এসেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবুও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
একইভাবে দ্বিতীয় হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূসা (আ.) ও বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহর দয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং রোযা রেখেছেন। অথচ এ ঘটনা প্রায় দুই হাজার বছর আগের। এতে বুঝা যায়, একটি ঘটনার গুরুত্ব যদি কারও কাছে থাকে, তাহলে হাজার বছর পরও এটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে সমস্যা নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাজার হাজার বছর আগের ঘটনাকে শুধু গুরুত্বই দেননি, বরং সে অনুযায়ী কিছু পদক্ষেপও নিয়েছেন। আর আমরা উম্মত হয়ে দেড় সহস্রাব্দ পার হওয়ার আগেই আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের মহান নিআমতটি ভুলে যাব? আমরা পৃথিবীপৃষ্ঠে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমনকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং মহা বরকতময় উপলক্ষ মনে করি। তাই আজও সেই দিন আসলে আমাদের হৃদয় খুশিতে ভরে ওঠে এবং আমরা হামদ-না’ত ও আলোচনার মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। এটিই আমাদের কাছে ঈদে মীলাদুন্নবী।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন ও আদর্শের আলোচনা সারা বছর করা উচিৎ। তাহলে একটি দিনকে আলোচনার জন্য কেন বেছে নেওয়া হয়?
প্রথমত, আমরা কখনও আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আলোচনাকে একটি দিনে সীমাবদ্ধ রাখি না। আমাদের আযানে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি শাহাদাত, নামাযে দুরূদ-সালাম এবং সভা-সমাবেশে না’তে রাসূল উপস্থিত থাকে। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আলোচনা ব্যতীত আমাদের মাহফিল শেষই হয় না। আমাদের সিলসিলার আউলিয়া-মাশায়িখের ওযীফা হচ্ছে, প্রতিদিন (নামাযের বাইরে) অন্তত দুইশতবার দুরূদ শরীফ পাঠ করা।
দ্বিতীয়ত, এটি ঠিক যে, রবিউল আউয়াল মাসে আমরা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মবৃত্তান্ত, মানাকিব, ইরহাসাত ইত্যাদির কথা বিশেষভাবে আলোচনা করি। যেভাবে বদর দিবসে বদর যুদ্ধ, সাহাবীদের ত্যাগ ও ইসলামের বিজয়ের কথা আলোচনা করি। ১০ই মুহররম কারবালা, খিলাফাত ও আহলে বাইতের কুরবানীর কথা আলোচনা করি। এটি একটি সাধারণ মানবিক আবেগ। যখন যে উপলক্ষ আসে, স্বাভাবিকভাবেই মানুষের দৃষ্টি সেদিকে ফেরে।
মীলাদ শরীফ পাঠ করার কোনো দলীল আছে কি?
মীলাদ শরীফ পাঠ করা বলতে আমরা কিছু আমলকে উদ্দেশ্য করি। প্রথমে কুরআন শরীফ থেকে কিছু অংশ তিলাওয়াত করা, এরপর দুরূদ ও না’তে রাসূল পাঠ করা, এরপর তাওয়াল্লুদ তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম ও বংশবৃত্তান্ত আলোচনা করা, এরপর সালাম জানানো। প্রত্যেকটি আমলের দলীল রয়েছে। কুরআন তিলাওয়াত এবং দুরূদ ও সালাম পাঠ করার দলীল উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন মনে করছি। না’তে রাসূল পাঠ করা সাহাবীদের সুন্নাত। হাসসান ইবন সাবিত, আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা, কা’ব ইবন যুহাইর (রা.) প্রমুখ সাহাবীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য প্রশংসাসংবলিত বহু কসিদা পাঠ করেছেন। নবীদের জন্মবৃত্তান্তের আলোচনা রয়েছে পবিত্র কুরআনে। নবী মূসা (আ.) (সূরা কাসাস), নবী ঈসা (আ.) (সূরা মারইয়াম) প্রমুখের জন্মবৃত্তান্ত ও পারিবারিক পরিচয় আল্লাহ নিজে বর্ণনা করেছেন। এমনকি সায়্যিদা মারইয়াম, যিনি নবী নন, তাঁর জন্মবৃত্তান্তও আল্লাহ কুরআনে বর্ণনা করেছেন (সূরা আলে ইমরান)। আর আমরা আদবের জন্য মীলাদ পাঠ করার সময় দাঁড়িয়ে সালাম প্রেরণ করি। মীলাদ শরীফ বা যে কোনো মাহফিল শেষে আমরা খাবারের আয়োজন করি বিধায় অনেকে এ নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করেন। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
أَفْشُوا السَّلَامَ وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ وَصَلُّوا بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ بِسَلَامٍ
“পরস্পর সালামের প্রচলন করো, একে অপরকে খাবার খাওয়াও, রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামায পড় এবং (এগুলোর বিনিময়ে) শান্তির সাথে জান্নাতে প্রবেশ করো।” (ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৩৩৪)
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুগত উম্মত হিসেবে কবূল করুন।
[সূত্র- মাসিক পরওয়ানা]

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *