বাংলাদেশে পীর-মুরিদীর নামে যে ভণ্ডামী চলছে, তাতে সাধারণ মুসলমান “পীর” শব্দ শুনলেই একটু নাক ছিটকান। আর এরকম করাই স্বাভাবিক। কারণ ভণ্ড পীরদের ভণ্ডামি চরম সীমায় পৌঁছেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ও উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে একটু ঘাটাঘাটি করলে বুঝা যায়, এতদাঞ্চলে ইসলামের আগমণ ও প্রসার ঘটেছিল পীর-মাশায়েখদের হাতেই। আরো জানা যায় যে, লাখো লাখো মানুষ সঠিক পথের দিশা পেয়েছে এই পীর-মাশায়েখদের হাতেই। তাই সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভণ্ড পীরদের ভণ্ডামির পাশাপাশি হক্কানী পীরদের ভালবাসেন; তাঁদের সাথে সম্পর্ক রাখেন।
ইতিহাস আর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে যে কেউ বলতে বাধ্য যে, দিন দিন “পীর” এর সংখ্যা কমছে আর “ভণ্ড পীর” এর সংখ্যা বাড়ছে। এর পিছনে আমাদের হুজুগে স্বভাব, অন্ধবিশ্বাস আর ইলমশূন্যতাই দায়ী। “পীর” শুনলেই সবাই তাকে ভক্তি করা শুরু করে দেয়; একটু যাচাই-বাছাইও করেনা যে, এই “পীর” আলিম কি না, দুনিয়ার প্রতি লোভী কি না, তার আমল-আখলাক ঠিক আছে কি না ইত্যাদি।
পীরের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখার উদ্দেশ্য হল, তাঁর কাছ থেকে দীনের কিছু বিষয় শিক্ষা করা, আমল-আখলাকের কিছু দিশা পাওয়া, অন্তর পরিশুদ্ধকরণের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা ইত্যাদি। পীরের নিজেরই যদি আমল ঠিক না থাকে, তবে তিনি অন্যকে আমলের শিক্ষা দিবেন কীভাবে? আর তার সাথে ভাল সম্পর্ক রেখেই কী লাভ? তাই কোনো পীরের সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলার আগেই একটু যাচাই-বাছাই করে নেওয়া উচিত।
যারা “পীর” শব্দ শুনতেই পারেন না, তাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা ভণ্ডদের ভণ্ডামির জন্য ঢালাওভাবে সবাইকে খারাপ বলে পীরবিরোধী শ্লোগান দিবেন না। যদি দেশে সঠিক পীর থাকে, এমনকি একজনও যদি থাকে, তবুও আপনাদের ন্যায়পরায়ণতার হক হচ্ছে, ভণ্ড পীরদের ভণ্ডামির বিরোধিতার পাশাপাশি সঠিক পীরদের অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া। পীর মানতেই হবে বা পীর ধরতেই হবে এরকম কোনো কথা আমি বলি না; আমি পীর-মাশায়িখদের সাথে ভাল সম্পর্ক রাখার কথা বলি। ভাল মানুষের সংস্পর্শে থাকলে ভাল হওয়া যায়। এই প্রভাব জীবন গঠনে সহযোগিতা করে। এই সম্পর্ক রাখা আত্মার জন্য একটা চিকিৎসা।
এই চিকিৎসা নিয়ে অসংখ্য লোক সোনার মানুষে পরিণত হয়েছে; বদলে দিয়েছে নিজের চরিত্রকে, পরিবারকে, সমাজকে।
এরকম একজন পীর ছিলেন আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.)। সকল ভণ্ড পীরের মুখোশ উন্মোচন করে তিনি মানুষকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রসারে আহবান করেছিলেন। তাঁর ইলম ও আমলে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রভাবিত হয়েছিল, তাঁর উত্তরসুরীদের দ্বারা এখনো মানুষ প্রভাবিত হচ্ছে। তাঁর সংস্পর্শে এসে কত মানুষ যে আলোর দিশা পেয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা রাব্বে কারিমই ভাল জানেন। তিনি শুধু পীর ছিলেন না; তিনি ছিলেন একাধারে মুহাদ্দিছ, মুফতি, মুফাসসির ও কারী। কেবল তাই নয়, তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে হাজারো মুহাদ্দিছ, মুফতি, মুফাসসির ও লক্ষাধিক কারি। তাঁর ছাত্রের ছাত্র, ছাত্রের ছাত্রের ছাত্র – এই ধারাবাহিকতার যে সূত্র তৈরি হয়েছে, ইনশা’আল্লাহ, তা কিয়ামত পর্যন্ত চলবে।
তাঁর বড় ছাহেবজাদা ও খলিফা আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী সাহেবের কাছ থেকে সম্প্রতি সহস্রাধিক মুহাদ্দিছ ইলমে হাদিসের সনদ গ্রহণ করেছেন। তাঁর অসংখ্য অবদানের মধ্যে এই দু’একটি উল্লেখ করে এই বিষয়টি বুঝাতে চাচ্ছি যে, এত আলিম-ওলামা আল্লামা ফুলতলী (রহ.) কে “পীর” হিসেবে সম্মান করে তাঁর সাথে ভাল সম্পর্ক রেখেছেন, আলোর দিশা পেয়েছেন। তাহলে আমরা যারা তাঁকে ভালবাসি, তাঁর রেখে যাওয়া দিনি খিদমতে অংশগ্রহণ করি, আমরা আলিমদের সাথে আছি।
যারা ফুলতলীতে আসেননি, ভ্রমণের উদ্দেশ্যে হলেও একবার আসুন, দেখুন, যাচাই-বাছাই করুন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ফুলতলী পর্যবেক্ষণ করে ভণ্ড পীরদের সাথে ফুলতলীর পার্থক্য নির্ণয় করুন।
আগামী ১৫ ই জানুয়ারী আল্লামা ফুলতলী (রহ.) এর বার্ষিক ইসালে সাওয়াব মাহফিল (জকিগন্জ, সিলেট)। বিশিষ্ট আলিম-ওলামা, মুহাদ্দিছ ও শিক্ষাবিদগণ জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখবেন। যিকির-আযকার, দুআ-দুরুদ, ওয়াজ-নসিহত ইত্যাদিতে কেটে যাবে একদিন-একরাত। আপনারা সাদর আমন্ত্রিত।
(লেখক, লেকচারার, ইসলামিক স্টাডিজ, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ)