জীবনীমনীষা

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) : হিজরী পঞ্চদশ শতকের এক মহান মুজাদ্দিদ

মারজান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী 

গত এক শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে যে কয়েকজন বহুমুখী প্রতিভাধর মনীষী এসেছেন, আল্লামা আব্দুল লতীফ চৌধুরী ফুলতলী (র.) তন্মধ্যে অন্যতম। উম্মাহ’র স্বার্থ সংরক্ষণ এবং দ্বীনী ও সামাজিক পরিসরে অবিস্মরণীয় খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে ২০০৮ সালে ইহজগতকে বিদায় জানানো এ মহান মুজাদ্দিদ আজও কোটি মানুষের হৃদয়পটে “ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ” নামে অক্ষয়-অমর হয়ে আছেন। তাঁর কর্মময় জীবনের একটি ক্ষেত্র ছিল তাজদীদ বা সংস্কার। এ নিবন্ধে আমরা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র সংস্কারমূলক কার্যক্রমকে ভারতীয় উপমহাদেশের বাস্তবতায় আলোচনা করব।

ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে চলে আসা তাসাওউফের বহুমুখী অবদানকে বিশ্লেষণ করলে আহলে তাসাওউফ তথা সূফীদের কার্যক্রমকে আমরা ৬টি ভাগে ভাগ করতে পারি। ১. ইসলাম প্রচার ২. আত্মিক পরিশুদ্ধি ৩. মানবসেবা ৪. ইলমী খিদমাত ৫. সমাজ সংস্কার ও ৬. দ্বীন কায়িমের প্রচেষ্টা। এর মধ্যে প্রথম ৩টি কার্যক্রম তাসাওউফের প্রতিটি সিলসিলায় বিদ্যমান। তরীকা যা-ই থাকুক, এ ৩টি বৈশিষ্ট্য প্রত্যেক সূফী শাইখের মধ্যে পাওয়া যাবে। পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে উপরিউক্ত ৬টি কার্যক্রমকে ব্যাখ্যা করতে চাই।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রথম আড়ম্বরপূর্ণ আগমন ঘটেছিল বনু উমাইয়া শাসনামলে। যদিও ওই আগমনের প্রভাব বেশিদূর বিস্তৃত হয়নি, তথাপি মুহাম্মাদ ইবন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর আরব ও পারস্য থেকে সূফী শাইখদের উপমহাদেশে আগমন ছিল লক্ষণীয়। তাঁরাই মূলত উপমহাদেশে জনমিতি পরিবর্তনের মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। সূফীদের ন্যায়ানুগ জীবনযাপন, উত্তম আখলাক, নিঃস্বার্থ ব্যক্তিত্ব এবং সর্বোপরি মানুষকে মূল্যায়ন করার প্রবণতা ভারতবাসীর জন্য একেবারেই অভূতপূর্ব ছিল। উঁচু বর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নিপীড়িত নিচু বর্ণের হিন্দুদের কাছে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব ছিল অচিন্তনীয়। এমন নয় যে, উঁচু বর্ণের বা প্রতিষ্ঠিত হিন্দুরা ইসলাম কবূল করেনি। তবে সার্বিক বিবেচনা করলে সমাজের নিপীড়িত, অবহেলিত, দুর্বল মানুষের ইসলাম কবূলের পাল্লাই ভারী ছিল। সাম্য-মৈত্রীর আদর্শের সাথে যুক্ত হয়েছিল তাওহীদ বা একত্ববাদের যৌক্তিকতা। অসংখ্য দেবতার সামনে বারেবারে ভিক্ষা মাগার চেয়ে এক অসীম ক্ষমতাবান ও দয়াময় স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস রাখাই যৌক্তিক–এটি অনুধাবন করা খুব কষ্টকর নয়। এক্ষেত্রে সূফীদের উত্তম আখলাক ও দাওয়াতের মায়াময় ভঙ্গিমা ও ইসলাম প্রচারে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আরবী না জানা হিন্দুরা কুরআন পড়তে পারেনি সত্য। তবে মানুষ পড়তে ভুল করেনি। তাই ক্ষমতাধর রাজা পৃথ্বীরাজের চেয়ে দীনহীন দরবেশ খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতীকে তাদের কাছে অধিক আস্থাভাজন মনে হয়েছিল। এমনিতেই হিন্দু-বৌদ্ধ ঋষিদের মধ্যে সংসার ত্যাগের প্রবণতা ছিল। তবে ওলী-আউলিয়ার সংস্পর্শে এসে তারা সমাজ-সংসারের মধ্যে থেকেও আল্লাহর জন্য নিজেকে বরাদ্দ করে দেওয়ার হাকীকত বুঝতে পেরেছিল। যেহেতু সূফী শাইখগণ দুনিয়ার লোভ থেকে মুক্ত ছিলেন, তাই সহায়-সম্পত্তি গড়ার চেয়ে বিলিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁদের আদর্শ। বিপদে মানুষ তাঁদের কাছে আসত। তাঁরা রুকইয়া করতেন, মানুষের উপকার হতো। দরিদ্ররা এসে তাঁদের লঙ্গরে ভিড় জমাত। যা কিছুই থাকত, সবাই ভাগ করে খেত। মোটকথা, সূফীদের কাছে ইসলাম প্রচার, আত্মিক পরিশুদ্ধি ও মানবসেবা আলাদা ছিল না। এ তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁদের জীবন ও কর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এটি ছিল উপমহাদেশে তাসাওউফের প্রথমার্ধ। এ সময়ের প্রসিদ্ধ নামের মধ্যে আলী ইবন উসমান হুজবেরী, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী, নিযামুদ্দীন আউলিয়া, শাহজালাল ইয়ামানী রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ সূফী শাইখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরপর শুরু হয় উপমহাদেশে তাসাওউফের দ্বিতীয়ার্ধ। তখন উপমহাদেশে মুসলিম শাসন চলছিল। তবে শাসনব্যবস্থা যতটা দৃঢ় ছিল, দ্বীনদারী ততটা মজবুত ছিল না। দ্বীনের ভেতর নানাবিধ কুসংস্কারের প্রবেশ, ইলমে দ্বীনের চরম ঘাটতি এবং বহিঃস্থ ও অন্তঃস্থ শত্রুর অবিরাম ষড়যন্ত্রের ফলে প্রচারণামূলক কার্যক্রমের চেয়ে দৃঢ়করণের প্রয়োজন ছিল বেশি। তখন যারা ইসলামী আকাঈদ ও জীবনব্যবস্থাকে দৃঢ়করণের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরাও ছিলেন আহলে তাসাওউফ। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় নাম হচ্ছে– ইমাম আহমদ ফারুকী সারহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফে সানী, ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী এবং আমিরুল মুসলিমীন সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী রাহিমাহুমুল্লাহ। ইমাম মুজাদ্দিদে আলফে সানীর দ্বীনী, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার (তাজদীদ), ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ’র অভাবনীয় ইলমী খিদমাত এবং শহীদে বালাকোট সায়্যিদ আহমদের জিহাদ এ উপমহাদেশে তাসাওউফের অবদানকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। জিহাদ প্রথমার্ধের সূফীরাও করেছেন। তাঁদের জিহাদ ছিল ইসলাম প্রচার ও মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। পক্ষান্তরে সায়্যিদ আহমদ বেরলভীর জিহাদ ছিল ইসলামী নিযাম প্রতিষ্ঠার তাগিদে। দুটিই সমপরিমাণ জরুরি ছিল। পার্থিব বিবেচনায় হয়তো সবাই সমভাবে সফল হতে পারেননি। তবে আমরা যে আজ মুসলমান হয়ে টিকে আছি, এর পেছনে তাঁদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয়ার্ধের ওই তিন মনীষীকে আমি যথাক্রমে ১১, ১২ ও ১৩ হিজরী শতকের মুজাদ্দিদ মনে করি। তাঁদের ব্যাপারে মাসিক পরওয়ানার পূর্বেকার সংখ্যাগুলোতে আমি পৃথক পৃথক নিবন্ধ লিখেছি। এখানে তাঁদের নাম উল্লেখ করার একমাত্র কারণ হচ্ছে প্রাসঙ্গিকতা।

 

কারণ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র মধ্যে তাঁর পূর্বসূরি ওই তিন মুজাদ্দিদ এবং তৎপরবর্তী মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী ও মাওলানা শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী রাহিমাহুমাল্লাহ’র ছায়া স্পষ্টভাবে বিদ্যমান ছিল। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ তাঁদের কর্মসূচিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার সার্থক প্রয়াস পেয়েছিলেন।

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র তাজদীদ তথা সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে প্রথমেই আসে পবিত্র কুরআনের খিদমাত। আল্লাহর কালামের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত, যা একজন মুসলমানের জন্য জানা ফরয, সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় তিনি যে কর্মসূচি সম্পাদন করেছিলেন, তা যেমন অভাবনীয়; তদ্রূপ এ কর্মসূচিকে সফল করার লক্ষ্যে প্রথমত তিনি নিজেকে যেভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, তাও একইভাবে অভাবনীয়। প্রসঙ্গত বলছি, বাংলার মুসলমানদের কাছে কুরআনের তিলাওয়াত সরাসরি আরব থেকে আসেনি। ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারতের মধ্য দিয়ে এসেছে। ফার্সি, পশতু, উর্দু ইত্যাদি ভাষার সংস্পর্শে এসে আরবী পঠন কিছুটা ভিন্নতর হয়েছে। যেহেতু আরবীর চেয়ে উর্দু বাংলা ভাষার অধিক নিকটবর্তী, তাই আরবী হরফ পাঠ করার সময় স্বর এবং উচ্চারণ উর্দুর দিকে খানিকটা ঝুঁকে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু কুরআন তিলাওয়াতের জন্য শর্ত হচ্ছে, ইলমে কিরাতের অবিচ্ছিন্ন পাঠধারা যেভাবে চলে আসছে, সেভাবেই তিলাওয়াত করতে হবে, তিলাওয়াতকারী যে ভাষায়ই কথা বলুক না কেন। আলাদাভাবে ইলমে কিরাত শিক্ষা অর্জন করা ব্যতীত তিলাওয়াতের হক আদায় করা সম্ভব হয় না। ইলমে কিরাতের শিক্ষা অর্জন না করার ফলে অনেক বড় বড় আলিম-উলামার তিলাওয়াত শুনলে আফসোস করতে হয়। এটিই ছিল তৎকালীন বাংলাভাষী আসাম-বাংলা অঞ্চলের বাস্তবতা। এমনকি ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ মাদরাসায় উচ্চশিক্ষা শেষ করার পরও তাঁর তিলাওয়াত শুনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তাঁর মুর্শিদ মাওলানা শাহ ইয়াকুব বদরপুরী (র.)। মুর্শিদের নির্দেশে ইলমে কিরাতে অধিকতর বুৎপত্তি অর্জনের লক্ষ্যে তিনি প্রথমে প্রখ্যাত কারী হাফিয আব্দুর রউফ করমপুরী (র.) এর কাছে কিরাত শিক্ষা অর্জন করেছেন। আব্দুর রউফ করমপুরী তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কারীদের কাছ থেকে ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করেছিলেন। এরপর ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ মক্কা শরীফে গিয়ে হারামাইনের ইমামগণের পরীক্ষক শাইখ আহমদ হিজাযী মাক্কী (র.) এর কাছে দীর্ঘদিন অধ্যয়ন করেছেন। ভারতবর্ষের একজন শিক্ষার্থীর জন্য ইলমে কিরাত শিখতে মক্কা শরীফে যাওয়া, সেখানে হারামাইনের প্রধান কিরাত পরীক্ষকের কাছে নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ করা এবং তাঁর কাছ থেকে সনদ নিয়ে আসা অভূতপূর্ব এক ব্যাপার ছিল। ফিরে এসে অন্যান্য কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি তিনি কিরাত শিক্ষাদান শুরু করেন। বিশিষ্ট বুযুর্গ মাওলানা আব্দুন নূর গড়কাপনীকে (র.) শিক্ষাদানের মাধ্যমে সূচিত হওয়া ফুলতলী ছাহেবের কিরাতের খিদমাত আজ বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। বাংলাভাষী অঞ্চলের গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের আনাচে কানাচে আজ দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের ১০ হাজারের অধিক শাখা বিদ্যমান। রয়েছে লতিফিয়া কারী সোসাইটির মতো দক্ষ সংস্থা, যারা এ খিদমাতের সুষ্ঠু তদারকি করে আসছে। কত লক্ষ লক্ষ মানুষ এ প্রতিষ্ঠানের অধীনে ইলমে কিরাত শিক্ষা অর্জন করেছেন, তা আলাদা এক গবেষণার বিষয়। আরব বিশ্বের বাস্তবতায় মাপলে ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ’র কিরাতের খিদমাত কেবল একটি ‘খিদমাত’ হিসেবেই গণ্য হতো। কিন্তু ভারতবর্ষের বাস্তবতায় এটি একটি তাজদীদ তথা সংস্কার। যাবতীয় ভাষাগত প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে ফুলতলী ছাহেব বাংলাভাষী মানুষের কাছে কুরআনকে সেভাবেই তুলে ধরেছেন, যেভাবে সাড়ে চৌদ্দশ বছর ধরে এর অবিচ্ছিন্ন পাঠধারা চলে আসছে। একটি হরফের উচ্চারণকে তিনি মূল থেকে বিকৃত হতে দেননি, চাই এর জন্য যত লড়াই করা লাগুক না কেন। দারুল কিরাতের জন্য তিনি নিজের সম্পত্তির বিশাল একটি অংশ ওয়াকফ করে রেখে গেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শেখায় (সহীহ বুখারী, ৫০২৭)। যে বিশাল পরিসরে এবং যে নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে আল্লামা ফুলতলী (র.) ইলমে কিরাতের খিদমাত আঞ্জাম দিয়েছেন, তা যেমন এই হাদীসের বাস্তবিক রূপ, একইভাবে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজ, শ্রেষ্ঠতম তাজদীদ।

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর দ্বিতীয় সংস্কারমূলক কাজ হচ্ছে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইজ্জত ও মাহাব্বাতকে মানুষের হৃদয়ে এমনভাবে প্রতিস্থাপিত করা, যেভাবে সাহাবায়ে কিরামের হৃদয়ে প্রতিস্থাপিত ছিল। বিষয়টির মধ্যে তাজদীদ তথা সংস্কারের দিকটি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। আরবে সূচিত নজদী আন্দোলনের একটি সরাসরি ফলাফল হচ্ছে কট্টরতা। এ কট্টরতার (যা প্রাচীন খারিজী মতবাদের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য ছিল) বহিঃপ্রকাশস্বরূপ রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যক্তিসত্তার প্রতি এ আন্দোলনের অনুসারীদের হৃদয়ের আবেগে ভাটা পড়ার উদাহরণ আমরা দেখেছি। তারা দ্বীনকে এক ধরণের হৃদয়হীন রোবটিক অনুশীলনের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ভারতের বিখ্যাত দেওবন্দী আন্দোলনের একটি ধারায় আরবের নজদী আন্দোলনের ছোঁয়া লেগেছিল। তাই ওই কট্টরতা এখানেও আমদানি হয়। নজদী আন্দোলনের সরাসরি সমালোচনা করলেও পুরো দেওবন্দী আন্দোলনকে আমি সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ইচ্ছুক নই। দেওবন্দী আন্দোলনের অনেক অবদান রয়েছে এ উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে। তবে এদের যে ধারাটি নজদী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, তাদের থেকে বহু অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময়টিতে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ এ উপমহাদেশে নজদী আদর্শের কঠোর বিরোধিতা করেছেন এবং যুগের ফ্যাশনের প্রতিকূলে গিয়ে বাংলাভাষী মুসলমানদের হৃদয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইযযত ও মাহাব্বাতকে শক্তভাবে প্রতিস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন। এটিকেই তিনি তাঁর ওয়ায-নাসীহাতের প্রতিপাদ্য বানিয়েছেন। তাঁর এ তাজদীদের ফলাফল আজ আমাদের চোখের সামনের বাস্তবতা।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, ফিকহী মতবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং অপ্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসাইল নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের মধ্যে মানুষ যখন ইসলামের রূহানিয়াত তথা আল্লাহর মাহাব্বাত ভুলতে বসেছিল, তখন মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী (র.) এক মুজাদ্দিদ হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। একই কাজ এ শতাব্দীতে করেছেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাহাব্বাতকে যিন্দা করতে চেয়েছেন। বলাই বাহুল্য যে, রূহানিয়াত তথা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অকৃত্রিম মাহাব্বাত ব্যতীত দ্বীন পালন করা এমন হয়ে যাবে, যেন ইটের ওপর ইট রেখে প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছে কিন্তু ইটের মধ্যখানে সিমেন্টের জুড়া নেই। দেখতে হয়তো এটিকে প্রাসাদ মনে হবে, কিন্তু এর স্থায়িত্ব কয়েক মূহুর্তও হবে না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মাহাব্বাতকে ছেড়ে দিয়ে কেবল ফিকহী বিধিনিষেধের ওপর দ্বীন পালন করাও এই প্রাসাদের সমতূল্য। শয়তান যে কোনো সময় ফুঁক দিয়ে এ প্রাসাদ গুড়িয়ে দিতে পারে।

আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর তৃতীয় তাজদীদ ছিল ইসলামের বিভিন্ন পরিভাষা বাংলায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে সতর্কতা আরোপ করা। পবিত্র কুরআন আরবী ভাষায় নাযিল হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও আরবীভাষী ছিলেন। ইসলাম যখন আরবের সীমানা ছাড়িয়ে অনারব এলাকায় পৌঁছাল, তখন ইসলামের বিভিন্ন পরিভাষা অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হলো। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যেত, ইসলামের পরিভাষাগুলো যে ভাষায় অনূদিত হচ্ছে, ওই ভাষায় আগে থেকে চলে আসা ধর্মীয় ও সামাজিক শব্দসমূহ ইসলামে প্রবেশ করছে। আমাদের বাংলাভাষী অঞ্চলে ‘আল্লাহ’ শব্দের প্রতিশব্দ করা হয়েছিল প্রভু, ‘ইবাদাত’ শব্দের প্রতিশব্দ করা হয়েছিল উপাসনা। এভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষেত্রে ‘নেতা’ ও কুরআন শরীফের ক্ষেত্রে ‘সংবিধান’ পরিভাষা ব্যবহার করার প্রবণতা শুরু হয়েছিল। অথচ শাব্দিকভাবে ইবাদাত অর্থ উপাসনা এবং সায়্যিদ শব্দের অর্থ নেতা হলেও দুটির মধ্যে ধারণামূলক (Conceptual) পার্থক্য বিদ্যমান। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামের সাথে আরবীতে সায়্যিদ ব্যবহার করা হলেও বাংলায় এর প্রতিশব্দ ‘নেতা’ করা উচিৎ নয়। নেতা ও সংবিধান বলতে আমাদের মনে যে ধারণা আসে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুমহান ব্যক্তিত্ব এবং পবিত্র কুরআনের মর্যাদা এরচেয়ে যোজন যোজন ওপরে। এ বিষয়টি আপাতদৃষ্টে কারও কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে, এ দরজা খুলে দিলে ইসলামের স্বাতন্ত্র্য এক সময় হুমকির মুখে পড়ত। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ ইসলামের পরিভাষাগুলোর সম্মান রক্ষায় একাই লড়াই করেছেন এবং মূলের ওপর টিকিয়ে রাখতে সফল হয়েছেন।

ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর আরও কয়েকটি খিদমাত ছিল যা তাঁর তাজদীদী পরিচয়কে পাকাপোক্ত করেছে। প্রথমটি হচ্ছে, বিপুল সংখ্যক মসজিদ-মাদরাসা ও খানেকা প্রতিষ্ঠা। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর একক প্রচেষ্টায় দেশে ও দেশের বাইরে কতটি মসজিদ-মাদরাসা ও খানেকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার নিশ্চিত পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে সমাজের গঠনমূলক সংস্কার এবং স্থায়ীভাবে দ্বীনী ভাবধারা কায়িম করার লক্ষ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ-মাদরাসা ও খানেকা আমাদের সমাজে বড় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। দেখিয়ে দিচ্ছে যে, একটি মসজিদের স্থায়ী এবং বহুমুখী কার্যক্রম বা একটি মাদরাসা থেকে বের হওয়া কয়েকশ শিক্ষার্থী সমাজে সত্যিকার পরিবর্তন আনতে সক্ষম। দ্বিতীয়টি হচ্ছে তাঁর রচনাবলি। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) একজন প্রাজ্ঞ আলিম ও সুলেখক ছিলেন। ইলমে দ্বীনের প্রতিটি শাখা, যথা কিরাত, হাদীস, তাফসীর, আকাঈদ, ফিকহ, উসূল, ইলমে তাসাওউফ ও তারিখে তাঁর বুৎপত্তি ছিল। একইসাথে তাঁর কাব্যপ্রতিভাও ছিল অনন্য। তাফসীর (প্রথম দুই পারা), তাজবীদ, তাসাওউফ, সীরাত ও দৈনন্দিন আমল বিষয়ক তাঁর লেখা অতি উঁচু মানের। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নালায়ে কলন্দর’ মননশীল পাঠকের জন্য বড় বিস্ময় হয়ে আছে, যেখানে তিনি নিজেকে ‘এ যুগের রূমী’ হিসেবে প্রমাণ করেছেন।

তৃতীয়টি হচ্ছে তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ নিজে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় অংশীদার ছিলেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশে তিনি ছিলেন ইসলামের এক বিশ্বস্ত পাহারাদার। প্রথাগত রাজনীতির বাইরে সসম্মানে অবস্থান করে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ইসলামের পাহারাদারি করেছেন। যখন, যেভাবে, যে দিক থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থের ওপর কোনো আঘাত এসেছে, ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ প্রকৃত মুমিন হওয়ার হক আদায় করে এর সর্বোচ্চ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেছেন। আমর বিল-মারূফ ও নাহী আনিল মুনকারের এত উৎকৃষ্ট সম্মিলন কম মানুষের মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া ও বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ এবং আল ইসলাহ’র প্রবাসী শাখাগুলো আহলে সুন্নাতের আকীদাকে সর্বত্র সর্বোত্তম সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে।

চতুর্থটি হচ্ছে খিদমাতে খালক তথা মানবসেবা। যখন মানুষকে দুঃখ-দুর্দশা থেকে পরিত্রাণের সময় এসেছে, তখন ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, স্থান কোনো কিছুর ভিন্নতা দেখেননি। আল্লাহর সৃষ্টির তরে নিঃস্বার্থভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আজও যে তাঁর মাযারের পাশে হাজার ইয়াতীমের পদধ্বনি শোনা যায়, তা তাঁর নিজের কাজের প্রতিদান। তাঁর ছাহেবজাদা ও খলীফা পুত্র আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী (বড় ছাহেব) নিজের জীবনকে সঁপে দিয়েছেন ইয়াতীম, অনাথ, দুস্থ, অসহায় মানুষের সেবাকল্পে। লতিফিয়া এতিমখানা এর উজ্জ্বল প্রমাণ।

প্রবন্ধের শুরুতে আমরা ভারতবর্ষে সূফী শাইখদের কার্যক্রমকে ৬টি ভাগে ভাগ করেছিলাম। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে উপরিউক্ত ৬টি কার্যক্রমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি হয়তো সমভাবে সফল হননি, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর সরব উপস্থিতি ও আন্তরিক প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অতএব দৃঢ়ভাবে বলা যায়, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ছিলেন হিজরী পঞ্চদশ শতকের অন্যতম মুজাদ্দিদ।

১৪ জানুয়ারী, ২০২২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *