বর্তমানে মিরাজের চাঁদ চলছে। আলহামদুলিল্লাহ! এ সময় এলে মিরাজ সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা আলিমগণ করেন। কারো মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এমনকি কেউ কেউ প্রশ্ন করেও থাকেন, রজব মাস এলে মিরাজের আলোচনা, অমুক মাস এলে অমুক বিষয়ের আলোচনা। এসবের ভিত্তি কী? এর সহজ উত্তর হলো, মূলত: তা আমরা শিখেছি কুরআনুল কারীম থেকে। কুরআনুল কারীমে আল্লাহপাক কি কি পদ্ধতিতে মানুষদের নসিহত প্রদান করেছেন তা অনুধাবন করতে হবে।
ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহিমাহুল্লাহ তাঁর লিখিত االفوز الكبير في اصول التفسير কিতাবে উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তা’লার নসিহত করার এক পদ্ধতি হল التذكر بايام الله অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সংগঠিত হয়েছে এসবের আলোচনা করা। অপর পদ্ধতি হলো التذكر بآلاء الله অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে যে নিয়ামতসমুহ দান করা হয়েছে এগুলোর আলোচনা করা। এ দুটির মধ্যে মিরাজের ঘটনা রয়েছে। মিরাজ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যা ইতোপূর্বে কখনো এবং কারো বেলায় সংগঠিত হয়নি। আর কখনো সংগঠিত হবেও না। একথা দিয়ে বুঝানো হচ্ছে না যে, কারো মিরাজ হয়নি বরং অন্যান্য নবীগণেরও মিরাজ হয়েছে। যেমন হযরত মুসা আলাইহিস সালামের মিরাজ হয়েছিল তূর পর্বতে। হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামের মিরাজ হয়েছে সমুদ্রে মাছের পেটে। আরো অনেক নবীর মিরাজ হয়েছে বিভিন্নভাবে। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ বা উর্ধজগতের সফর যেভাবে হয়েছে অন্য কোন নবীর মিরাজ সেভাবে হয়নি।
কিতাবাদি পড়লে বুঝা যায়, মুহাককিক উলামা সৃষ্টি জগতকে উপরে এবং নীচে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। নীচের ভাগের নাম আলমে খলক এবং উপর ভাগের নাম আলমে আমদ। উভয়টির মধ্যখানের বর্ডার বা সীমারেখার নাম হল সিদরাতুল মুনতাহা। সিদরাতুল মুনতাহার নীচের জগতের যারা বাসিন্দা এবং দায়িত্বরত আছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজে তাশরিফ নেয়ার আগে এ সীমানা পেরিয়ে উর্ধজগতে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব হয় নি। আপনারা জানেন, হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম মিরাজ রজনীতে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঘর থেকে বের করে আনলেন, সঙ্গে থাকলেন, কিন্তু সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে বিদায় নিলেন। বললেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আর অগ্রসর হওয়ার ইজাজত নেই। সেখানে কেউ যাবে না, এটা হল আল্লাহ’র বিধান। অগ্রসর হলে কি হবে, নিম্ন জগতের কেউ সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে সামনে যেতে চাইলে কি হবে, এ সম্পর্কে পারস্যের কবি শেখ সাদি রাহিমাহুল্লাহ তাঁর এক কবিতায় সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। ফার্সি সে কবিতাংশের সরল অনুবাদ হলো- ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি যদি আর এক চুল পরিমাণ উপরের দিকে উঠি তাহলে আল্লাহর তজল্লির নূর আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করে দেবে। এজন্যে আমাদের উপরের দিকে ওঠা নিষেধ।
মোট কথা এই, সিদরাতুল মুনতাহার নিম্ন জগতের কেউ এর আগে কখনো উপরের দিকে যাননি এবং কখনো যাওয়া সম্ভব হবে না। এই অসম্ভব কাজ একমাত্র সম্ভব হয়েছিল আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেলায়। মিরাজ সম্পর্কে নানা দিক দিয়ে আলোচনা হতে পারে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ আলোচনা শেষ করা যাবে না। কেবলমাত্র বরকত লাভের জন্য যৎসামান্য আলোচনা করছি।
বর্তমান সময়েও কোন কোন মানুষ বলে থাকেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম মিরাজে সশরীরে যাননি, রূহানিভাবে গেছেন এবং ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্ন জগতে তাশরিফ নিয়েছেন। এই ধারণা সঠিক নয়। কারণ সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ’র মিরাজ অস্বীকারকারীগণ যে দলিলের ভিত্তিতে তা করেছিলেন তাদের সে দলিলের মাঝেই রাসুলুল্লাহর সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে মিরাজের প্রমান নিহীত রয়েছে।
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চাচাতো বোন হযরত উম্মে হানি রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘরে ঘুমে ছিলেন, সেখান থেকে মিরাজে তশরিফ নিয়েছেন। কোন কোন কিতাবে পাওয়া যায় এ ঘর থেকেই গিয়েছেন। আবার কোন কোন কিতাবে পাওয়া যায়, হারাম শরীফ থেকে গিয়েছেন। মূলত: একই কথা, কেননা সব হরমের এলাকায় অবস্থিত।
হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম ইশারা দিয়ে রাসুলুল্লাহকে উম্মে হানির ঘর থেকে উঠালেন। মুলতজামে নিয়ে বহু কাজ-কর্ম সম্পন্ন করেছেন। এরপর প্রথমে বাইতুল মাকদিসের পথে রওয়ানা দিয়েছেন। সেখান থেকে উর্ধজগতের দিকে গিয়েছেন। পূর্ণ সফর শেষ করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের আগে আগেই মক্কা শরীফে ফিরে এসেছেন। এসে প্রথমে চাচাতো বোন উম্মে হানির নিকট অলৌকিক এই সফরের বিবরণ দিলেন। শোনে হযরত উম্মে হানি রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ ! আমার অনুরোধ এ বিষয়টি আপনি আর কাউকে বলবেন না। এমনিতে কাফেররা আপনাকে নিয়ে নানা কথা বলছে, এখন যদি মিরাজের কথা বলেন তারা তা বিশ্বাস করবে না। কারণ মক্কা শরীফ থেকে দ্রুতগামী উটে চড়ে বাইতুল মাকদিস যেতে প্রায় ত্রিশ দিন লাগে। আর দুর্বল উট হলে চল্লিশ দিন লেগে যায়।
এমতাবস্থায় আপনি যদি বলেন ইশার পর গিয়েছেন এবং ফজরের পূর্বে ফিরে এসেছেন, তাহলে কেউ তা বিশ্বাস করবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ অনুরোধ রাখার মতো নয়। আল্লাহ নিয়েছন, তাঁর কুদরতের এ বর্ণনা পেশ করতে হবে। এরই মধ্যে মিরাজের প্রাথমিক বিবরণ সম্বলিত আয়াত নাযিল হলোঃ
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ-
“পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বারাকাতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।”
মিরাজের ঘটনা শোনার পর মক্কার কাফেররা হাসি-ঠাট্টা শুরু করলো। এমনকি কিছু নতুন মুসলমানও বলতে লাগলেন, না না, মিথ্যাবাদি ব্যক্তির প্রতি ঈমান আনা যায় না। একথা বলে তারা আবার মুরতাদ হয়ে কাফের হয়ে গেলো। সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মিরাজের কথা অস্বীকার করলো মক্কাবাসি কাফের মুশরিকরা। কথা হলো, যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, আমি স্বপ্ন দেখেছি এভাবে গিয়েছিলাম। তাহলে কারো অস্বীকার করার কোন কারণই থাকতো না। সুতরাং কাফের মুশরিকদের এই অস্বীকৃতিই সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মিরাজের প্রথম দলীল। সর্বপ্রথম যারা অস্বীকার করলো তাদের অস্বীকারটাই হল বিষয়ের বাস্তবতার সঠিক প্রমাণ। আল্লাহ তায়ালার কাজ এভাবেই হয়।
মিরাজের বিস্তারিত বিবরণ অনেক দীর্ঘ। চুম্বক অংশ হলো- হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুরাকে উঠিয়ে রওয়ানা হলেন। কিছু দূর অতিক্রম করার পর আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি বুরাক থামালাম, আপনি এখানে নেমে দু’রাকাত নামাজ আদায় করুন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জানা আছে, আজকের কোন রুটিন জিবরাইলের হবে না। আজকের সব কার্যক্রম হবে সম্পূর্ণ আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে নির্ধারিত। সুতরাং তিনি এখানে কী, নামবো কেন, নামাজ আদায় করবো কেন? এরকম কোন প্রশ্ন না করেই নামাজ আদায় করে নিলেন। এরপর বললেন, জিবরাইল এ স্থানে কী ? তিনি জবাব দিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহ বলেছেন, আপনি কিছু দিন পর মক্কা শরীফ থাকতে না পেরে তাঁর ইশারায় এখানে হিজরত করে আসবেন। এ স্থানের বর্তমান নাম ইয়াসরিব পরে মদিনা হবে। যেহেতু আল্লাহপাকের ইচ্ছা ইয়াসরিব বা মদীনা মুনাওয়ারায় আপনি স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন, এজন্যে এই জমিনে আপনি আসার আগেই আল্লাহ তা’লা আসমান থেকে খায়ের-বরকত দান করেছেন। এখন তিনি চাচ্ছেন আগের সেই খায়ের-বরকতের ভাগ যেনো আপনি গ্রহণ করেন এবং আপনার কদম মোবারকের খায়ের-বরকত এ জমিনে পড়ুক।
এখানে একটি মাসয়ালা শিখলাম, কোন আল্লাহওয়ালা বা আল্লাহর মহব্বতের কোন বান্দা যদি কোন জমিনে কদম রাখেন তা হলে তাঁর কদম রাখার উসিলায় সেখানে খয়র-বরকত নাযিল হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখেন যারা অর্থাৎ আল্লাহওয়ালা বা আউলিয়ায়ে কিরাম, তাঁরাও যে জমিনে চলাফেরা করেছেন এবং যে স্থানে অবস্থান করেছেন, আর যে স্থানে সমাধিত হয়েছেন তাঁদের উসিলায় সে স্থান বরকতময় হয়ে যায়। এজন্য তাঁদের সমাধিস্থলকে মাজার শরীফ বা রওজা শরীফ বলা হয়ে থাকে।
নবীজি জিবরাইল আলাইহিস সালাম’র সঙ্গে আবারো চলতে লাগলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর জিবরাইল আলাইহিস সালাম আবারো আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আপনি বুরাক থেকে নেমে এখানেও দু’রাকাআত নামাজ আদায় করেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম জিজ্ঞেস করলেন এখানে কী? তিনি বললেন, সামনে দেখতে পাচ্ছেন একটি মাঠ। যার নাম ওয়াদিয়ে কারসা, দু’ পাহাড়ের মধ্যস্থান উপত্যকা। সেখানে আপনার ভাই হযরত মুসা আলাইহিস সালাম তাঁর রওজা শরীফে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন। তাঁকে এ মাঠে দাফন করায় এবং তাঁর রওজা শরীফ থাকায় আল্লাহপাক এ স্থানে খাস বরকত দান করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছা এ বরকতের কিছু অংশে আপনাকে শরীক করবেন। আর আপনার দ্বারা নতুন আরো কিছু বরকত হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে দান করবেন।
কোন কোন বন্ধুগণ বিশেষ স্থানের ফযিলত ও বরকত অস্বীকার করে প্রশ্ন উত্থাপন করে বলে থাকেন, আল্লাহকে বাড়িতে বসে কিছু বললে তিনি কি শুনবেন না? কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশেষ বিশেষ কারণে একেক স্থানে একেক রকমের ফযিলত ও বরকত রয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার করতে কুরআনুল কারীম থেকে সংক্ষিপ্তভাবে একটি কাহিনী পেশ করছি। বিবি মরিয়ম আলাইহাস সালাম হলেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এর মাতা। মরিয়ম আলাইহাস সালাম মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তাঁর মা মানত করেছিলেন আমার কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করলে আমি তাকে আল্লাহর নামে ওয়াকফ করে দেবো। সে যুগের শরিয়তের রায় ছিল আল্লাহর নামে কোন সন্তান মানত করলে তাকে আল্লাহর ঘর মসজিদ ব্যতিত অন্য কোথাও কোন কাজে লাগানো যেতো না। মহিলার মেয়ে সন্তান হলে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। একটি মেয়ে মসজিদের কি খেদমত করতে পারবে। মরিয়ম আলাইহাস সালাম কিছু বড় হলে মা তাঁকে নিয়ে গেলেন বাইতুল মাকদিসের ইমাম হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামের কাছে। (বর্তমান সিরিয়াতে তাঁর রওজা শরীফ রয়েছে।) বললেন, আমি একে আল্লাহর নামে মানত করেছিলাম। আপনি আমার সে মানতটি যেভাবে আদায় হয় সেভাবে আদায় করেন। শুনে হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম হযরত মরিয়ম আলাইহাস সালামকে নিজ ঘরে নিয়ে লালন-পালন করা শুরু করলেন। হযরত মরিয়ম আলাইহাস সালাম যখন ঝাড়ু দেয়ার মত উপযুক্ত হলেন তখন মসজিদের কাছে একটি হুজরা তৈরি করে দিলেন। সে হুজরাতে তিনি সময় সময় খাবার নিয়ে আসেন। তিনি ছাড়া আর কোন পুরুষ লোক সেখানে যেনো প্রবেশ করতে না পার সে ব্যবস্থাও করলেন।
একদা হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম মরিয়ম আলাইহাস সালাম’র ঘরে খাবার নিসে এসে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন। দেখলেন সেখানে ভিন দেশী বেমৌসুমি নানারকমের ফল রয়েছে। আজকাল বিদেশি ফল যেখানে সেখানে পাওয়া যায়। এসব ফল দেখে হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম মনে মনে ভাবেন আমি তালা না খুললে কারো পক্ষে সম্ভব নয় কামরাটা খোলা। কামরাটি খোলে কে? আর বিদেশি ও বেমৌসমি ফল এ মেয়ের কামরায় কিভাবে আসে। তিনি দেখেন আর লজ্জায় কোন কথা বলেন না। কিছু দিন পর জিজ্ঞাসা করলেন يا مريم ان لك هذا অর্থাৎ হে মরিয়ম ! তুমি এসব কোথা থেকে পেয়েছ? তখন মরিয়ম বললেন قالت هو من عند الله অর্থাৎ এসব আল্লাহর তরফ থেকে আমার নিকট আসে। এই উত্তর শুনে হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম’র মনে একথা ভাবনা হল, তাঁর কোন ছেলে সন্তান ছিলেন না। বহুদিন থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন, ইয়া আল্লাহ! আমাকে একজন নেককার ছেলে সন্তান দান করেন। আমি দুনিয়া থেকে চলো যাবো। আপনার দ্বীনের এবং বায়তুল মাকদিসের খেদমতের দায়িত্ব কার উপর দিয়ে যাবো। আল্লাহ পাক তাঁর দোয়ার কোন জবাব দান করলেন না। ছেলে সন্তানও পেলেন না। এভাবে দোয়া করতে করতে হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম’র বয়স নব্বই বছরের কাছাকাছি অথচ তাঁর বিবির গর্ভে কোন সন্তানাদি হয়নি। তিনি ভাবলেন, যে আল্লাহ তিন অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেললেন এ মেয়ের দ্বারা। তাহলে আমাকে সে আল্লাহ অসম্ভব অবস্থায় সন্তান দান করতে পারবেন না কেন?
হযরত মরিয়ম আলাইহাস সালাম’র সেই কামরায় বসে জাকারিয়া আলাইহিস সালাম দোয়া করলেন, ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাকে নেককার ছেলে সন্তান দান করেন فهب لى من لدنك وليا_يرثنى ويرث من أل يعقوب واجعله رب رضيا দোয়া শেষ হয়েছে। আজ আল্লাহর তরফ থেকে জবাব চলে এলো يزكريا انا نبشرك بغلم اسمه يحي _ لم نجعل له من قبل سميا হে জাকারিয়া তোমাকে সুসংবাদ শুনাচ্ছি আমি তোমাকে এক ছেলে সন্তান দান করব। তাঁর নাম হবে ইয়াহইয়া। ইতোপূর্বে এমন নাম আর কারো হয় নি।
এখানে একটু গভীরভাবে অনুধাবনের চেষ্টা করলেই বুঝা যাবে যে, হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম এতদিন বাড়িতে এবং বাইতুল মাকসিদে গিয়ে কত দোয়া করলেন। এর কোন জবাব ও ছেলে সন্তান পেলেন না। আজ মরিয়ম আলাইহাস সালাম’র কামরায় বসে দোয়া করার সাথে সাথে জবাব পেয়ে গেলেন। সাথে এও বলে দেয়া হলো ছেলে হবে না মেয়ে হবে তুমি সে সন্দেহ করো না, আমি তাঁর নাম রেখে দিচ্ছি ইয়াহইয়া! বুঝে নাও সে নিশ্চিত ছেলে সন্তানই হবে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, নবীগণের মধ্যে দু’জনের নাম আল্লাহর তরফ থেকে সরাসরি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। একজন হলেন ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম। যা কুরআনুল কারীমে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। আর সিয়ার ও হাদীসের কিতাবে আছে, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এর নাম “মুহাম্মদ” আল্লাহর তরফ থেকে রাখা হয়েছে। নবীজীর জন্মের অল্পদিন আগে মা আমিনা স্বপ্ন দেখেন কে যেন এসে বলছেন, আমিনা তোমার গর্ভে সারা সৃষ্টির সেরা এক মহামানব জন্মগ্রহণ করবেন। তাঁর নাম রেখো মুহাম্মদ। ইতিহাসের কোন কোন বর্ণনায় আছে, দাদা আবদুল মুত্তালিব এ নাম রেখেছিলেন। আবার কোন কোন বর্ণনা মতে আমিনা রেখেছিলেন। এই বর্ণনাসমুহ নিয়ে কোন মতবিরোধ করার সুযোগ নেই। এ তিন বর্ণনার সুন্দর সমন্বয় হলো নাম রেখে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। স্বপ্নে দেখেছিলেন মা আমিনা, আর নাম ঘোষণা করেছেন দাদা আবদুল মুত্তালিব।
আজ হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম বিবি মরিয়ম আলাইহাস সালাম’র হুজরায় বসে দোয়া করেছিলেন বলে আল্লাহর কাছে সেটা কবুল হয়েছে৷ ঘটনাটি কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন هنالك دعا زكريا ربه হযরত মরিয়ম আলাইহাস সালাম’র হুজরায় বসে জাকারিয়া আলাইহিস সালাম তাঁর আল্লাহকে ডেকে বলেছিলেন আমাকে পুত্র সন্তান দান করুন। আল্লাহ সব স্থান থেকেই তো দেখেন এবং শুনেন। তাহলে সেখানে বসে (هنالك শব্দ দ্বারা স্পষ্ট ) দোয়া করলে আল্লাহ কেন শুনলেন। সব তাফসীর গ্রন্থে বলা হয়েছে এখানে هنالك শব্দ প্রয়োগ আল্লাহপাক এ স্থানের বিশেষ গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ বিশেষ স্থানের এবং ব্যক্তির উসিলা নিয়ে কিছু বললে আল্লাহ তা’লা তা শুনেন। হযরত মরিয়ম আলাইহাস সালাম’র মত মহব্বতের বান্দী যাকে আল্লাহ তিন অসম্ভবকে সম্ভব করে হেফাজতের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর কাছে বসে আল্লাহকে বলার কারণে তিনি আরেক অসম্ভবকে সম্ভব করে দিলেন। উপরোক্ত কথাগুলো উল্লেখ করার কারণ হল স্থানের গুরুত্ব বুঝানো।
হযরত মুসা আলাইহিস সালামকে যে মাঠে সমাহিত করা হয়েছে সে স্থানের মধ্যে খয়র-বরকত আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে বিধায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামকে বলা হল আপনি এ স্থানে দু’রাকাআত নামাজ আদায় করুন।
আরো কিছু দূর চলার পর জিবরাইল আলাইহিস সালাম আবার আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আপনি এখানেও দু’রাকাআত নামাজ আদায় করুন।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম জিজ্ঞেস করলেন, এস্থানে কী? জিবরাইল বললেন, এ স্থানের নাম বায়তুল লাহম। ( ইংরেজি ভাষায় বলা হয় বেথেলহাম।) এখানে আপনার ভাই ঈসা আলাইহিস সালাম’র জন্ম হয়েছে। তাঁর জন্মের কারণেই স্থানটিকে বরকতময় করা হয়েছে। প্রসঙ্গত: আপনারা হজ্জ বা উমরায় গেলে মসজিদে হারামের পূর্বদিকে যে স্থানে নবীজী জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখানে যান। বর্তমানে তা একটি মাকতাবাহ বা লাইব্রেরি করে রাখা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ মানুষকে যেতে নিরুৎসাহিত করে। তারা বলতে চায় এ স্থানটির বিশেষ কোন মর্যাদা নেই।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম’র জন্মের কারণে যদি বাইতুল লাহাম বা বেথেলহামে খয়র-বরকত নাযিল হয়, তাহলে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম’র জন্ম যে স্থানে সেখানে তো খয়র-বরকত নাযিল হবেই।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এর মিরাজের আংশিক এ বিবরণ থেকে আমরা কিছু সবক শিখে নিলাম। এ হিসেবে আল্লাহ তা’লার বহু ইহসান জাহির হয়েছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামকে মিরাজে নেয়ায়। মিরাজের ইতিহাস সত্যিই আশ্চর্যজনক। এজন্য কুরআন শরীফের উসূলে নসিহত অনুযায়ী আমরা এসবের আলোচনা করি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামকে মিরাজ শরীফ নিয়ে আল্লাহ তা’লা বিশেষ নৈকট্য দান করেন। প্রথমে বুরাকে নবীজীর যাত্রা শুরু হল এরপর রফরফ দিয়ে রওনা হলেন। এখানে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমি ক্যাসেটে শুনছি এক আলেম মিরাজ সম্পর্কে এমন কিছু বয়ান করেছেন, আমি এসব কথার কোন ভিত্তি খুঁজে পাইনি। সেই আলিমের বর্ণিত কাহিনী হলো- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম মিরাজে তশরিফ নেয়ার জন্য আল্লাহ তা’লা রফরফ নামক বাহনটি পাঠালেন। বাহনটি এত উঁচু ছিলো যে, তাতে রাসুলুল্লাহ উঠতে পারছিলেন না। নবীজি তখন একজন যুবককে দেখলেন। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে তুলে দেবো। রাসুলুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি আপনার উম্মতের মধ্যে একজন, আমার নাম আবদুল কাদির। বক্তৃতার এই কথায় বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রাহিমাহুল্লাহ’র ফযিলত পরিস্ফুটিত হলো। কিন্তু এ কথাগুলো মেনে নেয়া যায় না দুটি কারণে। প্রথম কারণ, এখানে যে সময়টির কথা বলা হয়েছে সেসময় একমাত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম ছিলেন। তিনি যদি বিষয়টি না জানান তবে চিন্তা গবেষণা করে বের করার তো সুযোগ নেই। মিরাজের বিবরণ সম্পর্কিত যত হাদীস পড়েছি বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী সাহেব রাসুলুল্লাহকে রফরফে উঠিয়ে দিয়েছিলেন এমন বর্ণনা কোথাও পাইনি।
দ্বিতীয় কারণ, যিনি মেহমান করে তাঁর হাবিবকে নিয়েছেন তিনি কি বুঝলেন না যে, এত উঁচু রফরফে তাঁর হাবিব উঠতে পারবেন না। মূলত: ঐ আলেম বড়পীর সাহেবের উচ্চ মর্যাদা বুঝাতে গিয়ে নবীজীর সুমহান মর্যাদাকে খাটো করে ফেলেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এর মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এমন কথা বলা বা বিশ্বাস করা ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ যিনি যত উচ্চ মর্যাদার ওলি বা বুযুর্গ হোন সব বেলায়ত বা বুর্যুর্গির কেন্দ্রবিন্দু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম। তাঁর আনিত শরীয়তের যথাযথ অনুসরণ ব্যতীত বেলায়ত বুযুর্গির সুযোগ নেই।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজে তশরিফ নিলেন। সে সময়কার অবস্থাদি রাসুলুল্লাহ পরিষ্কার করে বলে গিয়েছেন। তবে সর্বোচ্চ কোথায় নিয়ে যাওয়া হল, সরিফুল আকলাম না আরশে আজিমে, কোথায় বসে তাঁদের মধ্যে আলাপ হয়েছে হাদিস তালাশ করলে খোঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু যুক্তির মাধ্যমে বুঝা যায় আল্লাহপাক তাঁর হাবিবকে এগিয়ে এসে নিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্পষ্ট কোন হাদীসে এখনো পাইনি। পড়ার মধ্যে আছি। তবে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরশে হোক বা অন্যত্র আল্লাহর দরবারে সরাসরি হাজিরী দিয়েছেন। তিনি জানতেন তাঁর আগে আদম সন্তানদের মধ্য কেউ এ স্থান পর্যন্ত যাননি। আল্লাহ তা’লার এতো বড় ইহসান। তাই আল্লাহর দরবারে হাদিয়া পেশ করা প্রয়োজন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিয়া পেশ করলেন التحيات لله والصلوة والطيباب প্রত্যেক নামাজ শেষ করার সময় আমরা তা পাঠ করি। নামাজ মুমিনের মিরাজ। হাদীস শরীফে আছে الصلوة معراج الؤمنين রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে তাঁর মানসিক, দৈহিক, আর্থিক যা কিছু আছে বললেন, ইয়া আল্লাহ! আমি সব আপনার দরবারে পেশ করছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর তরফ থেকে সালাম দেয়া হল السلام عليك ايها النبي ورحمة الله وبركاته
কুরআন শরীফে আমরা পাই, অনেক নবীগণের নিকট আল্লাহ তা’লা সালাম পাঠিয়েছেন। যেমন سلام علي نوح في العلمين, سلام علي الياسين, سلام علي موسي وهارون এভাবে বহু সালাম প্রেরণ করেছেন।সব নবীর কাছে আল্লাহপাক বাহকের মাধ্যমে সালাম প্রেরণ করেছেন। আর আমার আপনার নবীকে আল্লাহ তা’লা তাঁর দরবারে নিয়ে সরাসরি সামনে রেখে বলেছিলেন-
السلام عليك ايها النبي ورحمة الله وبركاته
আরবি ব্যাকরণ যারা জানেন, তারা বুঝেছেন বাস্তবে এক আল্লাহ ও রাসূল ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই। এজন্যেই রাসুলুল্লাহকে সালাম দিতে গিয়ে আল্লাহ তা’লা এক বচনের শব্দ السلام عليك ব্যবহার করেছেন। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সালামের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন السلام علينا وعلي عباد الله الصالحين ইয়া আল্লাহ! আপনার সালাম আমরা সবাই গ্রহণ করলাম। এখানে সবাই বলতে কারা, অন্য কেউ তো ছিলো না। বুযূর্গানে কেরামগণ বিশ্লেষণ করেছেন যে, আল্লাহর খাস কুরবতে পৌঁছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম পেয়ে মনের মধ্যে উম্মতের মহব্বত উঁকি দিয়েছে। একারণেই তিনি একবচন বাদ দিয়ে তামাম উম্মতকে তাঁর মনের মাঝে রেখে সালামের জবাব দিয়েছেন السلام علينا ইয়া আল্লাহ! আপনার সালাম আমি একা গ্রহণ করছি না, আমার সব উম্মতকে সাথে নিয়ে গ্রহণ করছি।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু এই উম্মতের জন্য রহমত নয় বরং তিনি রাহমাতুল্লিল লিল আলামিন। মানব সৃষ্টির শুরু থেকে যত মুমিন এসেছেন সবারই এ রহমতের ভাগ পাওয়ার হক আছে। এজন্য উম্মাতকে শরীক করার পর মূহুর্তে তামাম নেককার মুমিনগণকে শরীক করেছেন السلام علينا وعلي عباد الله الصالحين বলে।
একবার চিন্তা করুন রাউফ রাহিম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই জগতসহ আরো যত জগত আছে তা পাড়ি দিয়ে উর্ধ জগতে পৌঁছে, আল্লাহর আরশ পর্যন্ত গিয়ে আমাদের মত গুনাহগার উম্মতকে ভুলেন নি।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। বিষয়টি নিয়ে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যেও ইখতিলাফ বা মতানৈক্য ছিল। পরবর্তী মান্যবর উলামার মধ্যেও এ মতানৈক্য বিদ্যমান আছে। এজন্য আমার মত নগণ্য একজন মানুষ এ বিষয়ে কথা বলা সমীচিন মনে করি না। তবু যেহেতু বিষয়টি নিয়ে বর্তমানেও বিভিন্ন পক্ষ তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়, তাই বাধ্য হয়ে উল্লেখ করতে হচ্ছে। বিষয়টি হলো মিরাজ রজনীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা’লাকে সরাসরি তাঁর চর্ম চক্ষে দেখেছেন কি না।
কারো কারো মতে দেখেন নি । আবার কারো কারো মতে দেখেছেন। দেখেন নি যারা বলেন তাদের যুক্তি হল যে, মানুষের চর্ম চক্ষুর মাঝে এই ক্ষমতা নেই যে আল্লাহকে দেখবে। তাঁরা হযরত মুসা আলাইহিস সালাম’র ঘটনা উল্লেখ করেন। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম একবার ইচ্ছা করলেন আল্লাহ তা’লাকে দেখার। আল্লাহ প্রথমে বললেন, আমাকে দেখতে পারবে না। আর চাক্ষুস দেখার যদি ইচ্ছা থাকে তাহলে তূর পাহাড়ের দিকে লক্ষ্য করো। যখন মুসা আলাইহিস সালাম তুর পাহাড়ের দিকে তাকালেন, তুর পাহাড়ের উপর আল্লাহর নূরের তাজাল্লী পড়ার সাথে সাথে মুসা আলাইহিস সালাম দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এমতাবস্থায় কারো পক্ষে সরাসরি চর্ম চক্ষে আল্লাহকে দেখা কিভাবে সম্ভব।
এখানে আমি কিছু কথা বলতে চাই। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ পাক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দিলেন السلام عليك ايها النبي ورحمة الله وبركاته আল্লাহর এ সালামটি কি নবীজি সরাসরি শুনেছিলেন? নাকি না শুনেই জবাব দিয়েছিলেন? সাধারণ বিবেক বলে, অবশ্যই শুনে জবাব দিয়েছিলেন। আল্লাহর কালাম সরাসরি শুনে রাসুলুল্লাহর দৈহিক শ্রবণ শক্তির কোন ব্যত্যয় ঘটলো না বরং তিনি তা শুনলেন, বুঝলেন এবং জবাবও দিলেন। কারণ রাসুলুল্লাহর কান মোবারকের ক্ষমতা সেসময় আল্লাহপাক বৃদ্ধি করে দিয়েছিলেন। যদি শ্রবণ শক্তি বেড়ে আল্লাহর কালাম সরাসরি শুনতে পারলেন। তাহলে একটি নজর আল্লাহপাককে দেখার জন্য দৃষ্টি শক্তি বেড়ে ঐ পর্যায়ে যেতে পারবে না কেন? উল্লিখিত যুক্তির আলোকে আমি মনে করি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি আল্লাহ তা’লার দীদার লাভ করেছেন। কিতাবাদি অধ্যয়ন করলে পাওয়া যায়, মিরাজের রাত্রিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’লা যে পরিমাণ উপরের দিকে তুলছেন, যে স্তরে নিয়েছেন সেই স্তরের ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে দিয়েছিলেন।
আরো একটু অগ্রসর হয়ে বলতে চাই, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সত্তা আল্লাহর দানকৃত নূরে ভরপুর। যদিও তা বশরিয়্যাত এবং ইনসানিয়াত দ্বারা আবৃত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নূর। সাধারণ মানুষ যেনো তাঁর সাথে সহজে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারে, কথা বলে উপকৃত হতে পারে সেজন্যে আল্লাহ তা’লা নবীজির নূরানী সত্তাকে বাশারিয়্যাতের কভার দ্বারা আবৃত করে দিয়েছিলেন।
আমি কোন কোন সময় বলি, হিতে বিপরীত হয়েছে। আল্লাহ তাঁর হাবিবকে বাশার বা মানবকুলে জন্ম দিয়েছিলেন আমরা যাতে সহজে তাঁর দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির দিশা পাই। কিন্তু আমরা আমাদের মত গঠন দেখে বলতে শুরু করেছি তিনি আমাদের দশজনের মত একজন ছিলেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নজির কোন দিক দিয়ে নেই। তাঁর আভ্যন্তরিন দিক বাদ দিলাম, ব্যাহিক বদন মোবারকের সমতূল্য সৌন্দর্য সৃষ্টিকুলের অন্য কারো আছে বলে বিশ্বাস করলে ঈমাণ থাকবে না।
সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ শায়ির বা কবি ছিলেন হাসসান বিন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি রাসুলুল্লাহর ব্যাহিক সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করেছিলেন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। বলেছিলেন-
واحسن منك لم تر قط عين +واجمل منك لم تلد النساء
ইয়া রাসুলাল্লাহ! কোন চোখ কোন দিনও আপনার চেয়ে সুন্দর কিছু দেখেনি। কোন নারী আপনার চেয়ে সুন্দর শিশু কখনো জন্ম দিতে পারে নি।
কবিতাটি হাসসান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনেই আবৃত্তি করেছেন। অথচ তিনি তাঁকে নিবৃত করেন নি। মূলত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বাহ্যিক সৌন্দর্যের যথাযথ প্রকাশ কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
এ হিসেবে আকাইদের এক মাসয়ালা হল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জাত, সৃষ্টি, চরিত্র সকল কিছুর উপর সুদৃঢ় ঈমান থাকতে হব। আপনার ঈমান থাকতে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে সুন্দর কোন মানুষ দুনিয়াতে কোন দিন প্রেরিত হননি এবং কিয়ামত পর্যন্ত প্রেরিত হবেনও না। যদি তাঁর ব্যাহিক সৌন্দর্য্যের সমান কেউ নেই তাহলে মানুষ কিভাবে ভাবতে পারে যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ দশজনের মত একজন মানুষ ছিলেন। অন্য দশজন মানুষের মত তাঁরও হাত ছিল ঠিক । কিন্তু তাঁর হাতের ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন? বদর যুদ্ধে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাঠে বের হয়ে দেখলেন তাঁর সাথে মাত্র ৩১৩ জন সঙ্গী। ঘোড়া মাত্র দু’ তিনটি। তলওয়ার নেই, তলোওয়ার স্বল্পতায় খেজুরের ডাল নিয়ে সাহাবীগণ বের হয়েছেন যুদ্ধ করতে। অপর দিকে কাফেররা বিপুল অস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ১০০০ হাজার জন।
আসন্ন বিপদ চিন্তা করে তিনি আল্লাহর দিকে খেয়াল করলেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ কে আল্লাহপাক সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি যেখানে আটকে যেতেন সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক হয়ে যেত। তাৎক্ষনিক আল্লাহ এর সমাধান জানিয়ে দিতেন। আল্লাহ বললেন, আপনি পেরেশান হবেন না। আমি একটা শিক্ষা দিচ্ছি আপনি তা পালন করুন। এক মুষ্টি বালু আপনার হাতে নিন। রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন বালু হাতে নিলেন তখন উপস্থিত সাহাবীগণ দেখেছেন।
বালুতে ফু’ দিয়ে কাফেরদের দিকে ছুড়ে মারলেন। কাফেরগণ তখনও কাছে আসে নি। সাহাবীগণ সম্মুখে আর তিনি পেছনে, মধ্যখানে বিস্তর মাঠ। মাঠের অপর প্রান্তে সারিবদ্ধ কাফেরগণ। রাসুলুল্লাহ ﷺ বালু ছুঁড়ে মারলে একটিও সাহাবীগণের কারো উপরে পড়ে নি। মধ্যখানে খালি মাঠেও পড়ে নি। মাঠের ঐ প্রান্তে থাকা কাফেরদের উপর সব বালু গিয়ে পড়লো। আর এমনভাবে বালুগুলো পড়লো প্রত্যেক কাফেরের চোখে এক-দুই বালুর কণা ঢুকলো। পড়ার সাথে সাথে তারা চোখ কচলাতে শুরু করলো, সাহাবীগণ সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলেন। যুদ্ধ শেষ হল, মুসলমানগণ বিজয়ী হলেন।
সাহাবীগণের মধ্য হতে কয়েকজন একদিন এক স্থানে একত্রিত হলেন। তখন বলাবলি করলেন, আচ্ছা! সেদিন (বদর যুদ্ধে) আশ্চর্যজনক অনেক কিছু আমরা দেখলাম। রাসুলুল্লাহ ﷺ যখন কাফেরদের দিকে বালু হাতে নিয়ে ছুড়ে মারলেন তখন আমাদের কারো উপর এবং খালি মাঠে না পড়ে মাঠের ঐ প্রান্তে দাঁড়ানো কাফের বাহিনীর উপর গিয়ে পড়লো, সাথে সাথেই তাদের চোখ কচলানো শুরু করতে হলো। তা কিসের কারণে হল। উপস্থিত সকলেই যে যার অভিমত দিচ্ছেন, কিন্তু বিষয়টির হকীকত বের করা সহজ ছিলো না। তখন আল্লাহ দেখলেন তাঁরা গবেষণা করে কিছু পাবে না। আসল রহস্য যদি বলে দিই তাহলে তাঁদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পাবে এবং আমার নবীর উপর তাঁদের ভাব বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ সব সময়ই চান তাঁর হাবিবের উপর মানুষের ভাব বাড়ুক। আর কিছু আলিম নামধারি ব্যক্তির প্রচেষ্টা কিভাবে মানুষের মন থেকে নবীর ভাব কমানো যায়। দু’তিন দিন যাওয়ার পর আল্লাহ তা’লা জিবরাইল আলাইহিস সালামকে বললেন, তুমি আমার নবীর কাছে গিয়ে বালু ছুড়ে মারার আসল রহস্য বলে আসো। তখনই আয়াত নাযিল হল وما رميت اذ رميت ولكن الله رمي অর্থাৎ হে আমার নবী! (বদরের দিন ) বালু হাতে নিয়ে ছুড়ে মারলেন, সেটা তো আপনি মারেন নি, আমি স্বয়ং আল্লাহ সেদিন মেরেছি।
এবার রহস্য বেরিয়ে এলো। আল্লাহ কোনো কিছু ছুড়ে মারলে ১০০০ জনের চোখে কেন, সৃষ্টি জগতের সকল চোখ ওয়ালা ব্যক্তির চোখে ঢুকানো সম্ভব।
এ আয়াতটিতে বড় কঠিন স্ববিরোধী কথা রয়েছে। কোন বিচারকের সামনে স্ববিরোধী কথা বললে বিচারক বলবে, তোমার কথা বলা হয় নি। আল্লাহর স্ববিরোধী কথা বলা উচিত নয়। তিনি তো আলিমুল গাইব। আল্লাহ বলেন مارميت اذ رميت যখন আপনি ছুড়ে মারলেন, তখন আপনি ছুড়ে মারেন নি। একথা আমরা কিভাবে মেনে নেবো। আল্লাহ বললেন اذ رميت যখন আপনি ছুড়ে মারলেন, مارميت তখন আপনি ছুড়ে মারেন নি। এর মীমাংসা হলো ولكن الله رمي বরং আল্লাহ ছুঁড়ে মেরেছেন।
আসল কথা হল এই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মাথা মোবারক থেকে পা মোবারক পর্যন্ত রাব্বুল আলামীন এমনভাবে তৈরি করেছেন যার মধ্যে সবসময় আল্লাহর দানকৃত নূর বিদ্যমান।সুতরাং সময়ের প্রয়োজনে আল্লাহ তাঁর খোদায়ী শক্তিকে তাঁর যে কোন অঙ্গের ভেতর প্রবেশ করিয়ে মানুষের সাধ্যাতীত কাজ করিয়ে নেন। তাইতো দেখা যায় সেদিন হাত মোবারক মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ছিলো কিন্তু ছুড়ে মারার সময় এই হাতের ভেতর যে শক্তি কাজ করেছে প্রকৃত পক্ষে এ শক্তি ছিল স্বয়ং আল্লাহর।
রাসুলুল্লাহর হাত মোবারক তো আপনার আমার হাতের মতই ছিলো। কিন্তু তাঁর হাত মুবারকের ক্ষমতা আপনার আমার হাতের মত নয়। যাই হোক এতক্ষণ একটি অঙ্গের সামান্য আলোচনা হলো। মূলত: তাঁর মাথা মোবারক থেকে পা মোবারক পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গের আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিলো। দেখার বেলায় যতই আপনার আমার মত হোক; হাকীকতে সমান ছিলো না।
রাসুলুল্লাহ এত কম সময়ের মধ্যে মিরাজে গেলেন কিভাবে? উর্ধজগতে যেতে অগ্নিস্তর, বরফস্তর এগুলো পেরিয়ে গেলেন কিভাবে । এ সমস্ত জঠিল বিষয় বুঝতে হলে ইলেক্ট্রিক সিসটেমের দিকে গভীরভাবে তাকালে কিছুটা হলেও সহজে বুঝা সম্ভব। রাসুলুল্লাহর ﷺ ভেতর আল্লাহ তা’লা তাঁর নূর দান করেছেন। ইমাম কাযী আয়ায রাহিমাহুল্লাহ রচিত শিফা কিতাবের শরাহ রচনা করেছেন ইমাম মোল্লা আলী কারী রাহিমাহুল্লাহ। তিনি এক স্থানে লিখেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ভেতর আল্লাহপাক যে নূর রেখেছেন সেটাকে মানুষের হেদায়েতের উদ্দেশ্যেই আল্লাহ লুকিয়ে রেখেছেন। যদি রাব্বুল আলামীন তাঁর আরশে আজীমে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহকে রাখেন তবে তাঁর নূরানী সত্তাকে আরশে আজীমও ধরে রাখতে পারবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মিরাজের আলোচনায় আমরা অন্য কিছু না বলে সহজে বলবো, তিনি নিজে যে স্থান পর্যন্ত গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন তা আমাদের মানতেই হবে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত’র সমস্ত উলামার ইজমা হলো একবার তিনি সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মিরাজে গিয়েছেন। তা অবিশ্বাস করলে আপনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতভুক্ত হতে পারবেন না।
আল্লাহপাকের শুকরিয়া তিনি আমাদেরকে আখিরী নবীর উম্মতের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। তাই রজব, শাবান, রবিউল আউয়াল ও রামাদান মাসে বিভিন্নভাবে আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করা প্রয়োজন। এমাস সমুহে আল্লাহ তা’লার বড় বড় নিয়ামত আমরা লাভ করেছি।
আসুন রজব মাসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম কর্তৃক শিখিয়ে দেয়া দোয়া বেশি করে পড়ি:
اللهم بارك لنا فى رجب وشعبان وبلغنا رمضان
(হে আল্লাহ! রজব এবং শাবান মাসে আমাদেরকে বরকত দান করুন আমাদেরকে রামাদান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।)
[ ২০০৯ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাসে বৃটেনের নর্থহাম্পটন শহরে প্রদত্ত বয়ান। ]
অনুলিখন : এ এইচ এম আসলাম | সম্পাদনা : মো. আবদুল আউয়াল হেলাল