মনে করুন, আপনাকে পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেউ নির্জন কোনো পাহাড়ের গুহায় বন্দী করে রাখল। দীর্ঘকাল আপনি বিরহ যাতনায় ভোগলেন। অতঃপর কোনো এক সুপ্রভাতে বন্ধন মুক্ত করে দিল। আপনি তখন প্রভাতী তারা ও শুকতারাকে সাক্ষী রেখে দিন রাত পথ চলতে লাগলেন। ঘরে ফিরার অবদমিত আকাক্সক্ষা হৃদয়ে নিয়ে ফেলে আসা জীবনের করুণ ইতিহাস স্মরণ করে কাঁদতে কাঁদতে আপনি চলছেন। আপনার সে উপলব্ধি কি আমরা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব?
আজ আপনি ছুটছেন মদীনার পথে, অতীত জীবনের কথা স্মরণ করে অনুতাপ করতে করতে। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে আপনার সবচেয়ে আপনজন যিনি, তার দরবারে চলছেন। অন্তরে জ্বালানো মিটি মিটি আশার প্রদীপকে ঝড়ের মুখে টিকিয়ে রাখুন। ছালাত ও ছালাম পাঠ করতে করতে পথ অতিক্রম করুন। যদি ভাবমূলক কোনো নাত বা কবিতা পাঠ করতে মন চায় তবে তাই করুন। সঙ্গীদের সাথে আলাপ করলে শুধু রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলোচনা করুন।
সালাত ও সালাম পাঠ করতে করতে অন্তকরণকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতের সাগরে ডুবিয়ে দিন। আপনি যেন মরুর আকশে রাতজাগা একাকী তারা। রাতজাগা তারার মতো আপনার সজল দৃষ্টিতে শুধু প্রতিফলিত হোক সে সবুজ গুম্বুজ। মাঝে মধ্যে সালাত ও সালাম পাঠ করতে করতে পথিপার্শ্বের পাথরের পাহাড় ও মরু প্রান্তরগুলি অবলোকন করুন। এ সকল পাহাড় ডিঙিয়ে বিশাল মরু পার হয়ে জন্মভূমি ত্যাগ করে কত আসহায় নারী ও পুরুষ মদীনায় এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে পৌঁছে ছিলেন। তাদের কত অশ্রæ, কত রক্ত হেফাযত করে রেখেছে এ সকল পাহাড় ও মরু প্রান্তর।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগে রাহমাতুল্লিল আলামীন জন্মভূমি ত্যাগ করে এ দুর্গম পথ অতিক্রম করেছিলেন। এ সকল পাহাড় ও মরু প্রান্তর পবিত্র চরণধূলি লাভ করে ধন্য হয়েছিল।
যদি সুযোগ থাকে পথিমধ্যে যে সকল স্থানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম অবস্থান করেছেন বা নামায আদায় করেছেন সে সকল স্থানে নফল নামায পড়া (পথের মসজিদগুলির মধ্যে), দুআ করা, দুরূদ ও সালাম পাঠ করা উত্তম। অনুরূপভাবে যে কুপগুলি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাগণ ব্যবহার করেছেন সেগুলির পানি পান করাও উত্তম।
মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফ আসার পথে এ ধরনের যে মসজিদ ও কুপ রয়েছে তন্মধ্যে নিম্নলিখিত মসজিদ ও কুপগুলির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রকাশ থাকে যে, সকল মসজিদ ও কূপ মূল সড়কের সন্নিকটে নয়। প্রথমে মসজিদগুলির নাম পরে কূপগুলির নাম উল্লেখ করা হলো।
উল্লেখযোগ্য মসজিদের মধ্যে রয়েছে: ১) মসজিদে বনি তোয়া ২) মসজিদে তানঈম ৩) মসজিদে ছারিফ ৪) মসজিদে মাররুজজাহরান ৫) মসজিদুল বয়েত ৬) মসজিদুল খালিছ ৭) মসজিদে গদিরে খম ৮) মসজিদে জুহফা ৯) মসজিদে বদর ১০) মসজিদে গাজালা ১১) মসজিদে রাওহা ১২) মসজিদে ইরকুজজবিয়া ১৩) মসজিদে মুআররাছ ১৪) মসজিদে যুল হলায়ফা।
উল্লেখযোগ্য কূপসমুহের মধ্যে রয়েছে: ১) বিরে খালিছ ২) বিরে কুদাইমা ৩) বিরে মাছতুরা ৪) বিরে শায়খ ৫) বিরে গার ৬) বিরে রাওহা ৭) বিরে হাসানী ৮) বিরে আশহাব ৯) বিরে শহব।
মদীনা শরীফ থেকে উমরা বা হজ্জ করার উদ্দেশ্যে যারা মক্কা শরীফ যান তারা যুল হুলায়ফা থেকে ইহরাম বাঁধেন। যুল হুলায়ফা মদীনা শরীফ থেকে ছয় মাইল দূরে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এখানে ইহরাম বেঁধেছিলেন এবং রাত্রি যাপন করেছিলেন।
মদীনার মুসাফির যখন যুল হুলায়ফায় পৌঁছেন তখন তিনি স্মরণ করেন এ মাটিকেই একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র দেহের পরশে ধন্য করেছিলেন। এ স্থানটি একদিন লাখো সাহাবীর কন্ঠে ‘লাব্বায়েক’ শ্রবণ করেছিলো। তাই বলা যায় যুল হুলায়ফা ও ওয়াদিয়ে আকিক প্রেম-প্রীতি ভালোবাসার বৃষ্টিস্নাত একটি পবিত্র উদ্যান। আপনি যুল হুলায়ফায় পৌঁছলে সম্ভব হলে গোসল করে, না হয় উত্তমরূপে ওযু করে উত্তম কাপড় পরিধান করে খুশবু ব্যবহার করে দুরাকাত নামায আদায় করে দুআ করুন। নেহায়েত মনোযোগ সহকারে সালাত ও সালাম পাঠ করুন।
যদি সম্ভব হয় (অসুবিধা না থাকে) তবে পায়ে হেঁটে কেঁদে কেঁদে মনযিলে মকসুদের দিকে এগিয়ে চলুন। যদি সওয়ারীতে উপবিষ্ট থাকেন তবে সওয়ারীকে দ্রুত গতিতে চালনা করুন। আকুল কান্নায় ভেঁঙ্গে পড়ার চেষ্টা করুন। আপনার হৃদয় সাগরে মহব্বতের উদ্বেলিত তরঙ্গমালা আছাড় খেয়ে মরবে। দুরূদ ও সালাম পাঠ করতে করতে এগিয়ে যান। পবিত্র মদীনা যখন দেখবেন তখন দরূদ পাঠ করার পর এ দুআ পাঠ করুন:
اَللّٰهُمَّ هَذَا حَرَمُ نَبِيِّكَ فَاجْعَلْهُ لِىْ وِقَايَةً مِّنَ اَلْعَذَابِ وَسُوْءِ الْحِسَابِ.
তরজমা: হে আল্লাহ! এ আপনার নবীর হরম। এ হরমকে আমার জন্য আযাব থেকে রক্ষা ও শেষ হিসাবের মন্দ ফল থেকে রক্ষার কারণ বানিয়ে দাও।
হে মুসাফির! এখন আপনার দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন সফল হতে চলছে। আশার নিশীর অবসান হলো; সামনে সোনালী প্রভাত। এ সুপ্রভাত জীবনে কখনো ফিরে আসতে নাও পারে। আপনার সামনে সিরাজাম মুনীরা। অন্ধকার থেকে আলোর রাজ্যে আপনি প্রবেশ করেছেন। মদীনা শরীফে প্রবেশ করার সময় পড়বেন:
بِسْمِ اللهِ مَاشَاءَ الله لاَقُوَّةَ اِلاَّ بَاللهِ رَبِّ اَدْخِلْنِىْ مُدْخَلَ صِدْقٍ وَّاَخْرِجْنىْ مُخْرَجَ صِدْقٍ وَّارْزُقْنِى زِيَارَةَ رَسُوْلِكَ مَارَزَقْتَ اَوْليِاَئَكَ وَاَهْلَ طَاعَتِكَ وَاَنْقِذْنِىْ مِنْ اَلناَّرِ وَاغْفِرْلِىْ وَارْحَمْنِىْ يَاخَيْرَ مَسْئُوْلٍ اَللّٰهُمَّ اَجْعَلْ لَّنَا فِيْهَا قَرَارًا وَّرِزْقاَ حَسَنًاَ.
তরজমা: আল্লাহ তাআলার নামে প্রবেশ করছি। আল্লাহ তাআলা যা চান তাই হয়। আল্লাহ ছাড়া শক্তি সামর্থ্যরে উৎস নেই। হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে যথার্থ বিশ্বাসের সাথে (ঈমানের সাথে) প্রবেশ করাও এবং বাহির কর। তোমার ওলী (খাস বান্দা) গণকে তোমার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারত যেভাবে নসীব করেছ আমাকেও সেভাবে যিয়ারত নসীব কর। দোযখের আগুন থেকে আমাকে রক্ষা কর। আমাকে ক্ষমা করে দাও ও আমার প্রতি করুণা প্রদর্শন কর। হে আল্লাহ! মদীনা মুনাওয়ারাকে আমাদের শান্তির আলয় করে দাও এবং আমাদের উত্তম রিযিক দান কর।
মাকছুরা শরীফের উপর অবস্থিত ‘গুম্বুদ্বে খাদরা’ (সবুজ মিনার) যখন নয়ন সমক্ষে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে তখন আরো ভাবাপ্লুত কন্ঠে সালাত ও সালাম পাঠ করুন। অতিশয় সুন্দর সে মোহনরূপ দর্শনের ধ্যানে ডুবে যান। আপনার তখনকার ধ্যান ধারণার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। বাহ্যিক আচরণ এবং রিয়ার দ্বারা ইশক্কে কলুষিত করবেন না। মৌন স্তব্ধ পাথরের পাহাড় যেমন তার বুক চিরে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে আপনিও তেমন ভদ্র, শান্ত ও তন্ময় হয়ে অশ্রুর ঝর্ণাধারায় বুকের আগুনকে ঠান্ড করুন।
অনেকের পক্ষে যুল হুলায়ফায় গোসল করা সম্ভব হয় না। মদীনা শরীফ পৌঁছে প্রয়োজনীয় কর্ম শেষে গোসল করে, সম্ভব না হলে উত্তমরূপে ওযূ করে পাক কাপড় পরিধান করে খুশবু ব্যবহার করে দুরূদ ও সালাম পাঠ করতে করতে মসজিদে নববীর দিকে রওয়ানা হবেন।
মসজিদে প্রবেশ করার পূর্বে কিছু সদকা করা উত্তম। বাবে জিবরীল দিয়ে মসজিদে নববীতে প্রবেশ করা উত্তম। অসুবিধাবশত যে কোনো দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যায়। মসজিদে প্রবেশ করার সময় ডান পা আগে দিবেন। নিম্নের দুআ পাঠ করবেন এবং নফল ইতিকাফের নিয়ত করবেন:
اَللّٰهُمَّ صَلِّ عَلى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلٰى اٰلِ سَيِّدِنَا مُحَمْدٍ اَللّٰهُمَّ اَغْفِرْلِىْ ذُنُوْبِىْ وَافْتَحْ لِىْ اَبْواَبَ رَحْمَتِكَ- اَللّٰهُمَّ اجْعَلْنِىْ اليَوْمَ مِنْ اَوْجَهِ مَنْ تَوَجَّهَ اِلَيْكَ وَاَقْرَبِ مَنْ تَقَرَّبَ اِلَيْكَ وَاَنْجَحِ مَنْ دَعاَكَ وَابْتَغِى مَرْضَاكَ.
আপনি এখন এমন এক স্থানের নিকট দিয়ে চলছেন যে স্থান আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে উত্তম। যেখানে রাহমাতুল্লিল আলামীন সরদারে দুজাহান হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাম করেছেন। এখানে দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা অবতীর্ণ হন, দিন শেষে চলে যান। আরো সত্তর হাজার আসেন। নির্ধারিত সত্তর হাজার ছাড়াও এখানে অগণিত ফেরেশতার আনাগোনা।
হে মুসাফির! আপনি সহস্র সহস্র ফেরেশতা, শত শত আল্লাহর মকবুল বান্দাহর মাঝখানে। সম্ভ্রমে বিনয়ের সাথে এগিয়ে চলুন, সামনে রিয়াদুল জান্নাত। জান্নাতের বাগানে আপনি প্রবেশ করেছেন। সেখানে পৌঁছে দুরাকাত তাহিয়াতুল মসজিদ নামায আদায় করবেন যদি মাকরূহ সময় না হয়। মাকরূহ সময় বলতে সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও ঠিক দুপুরের সময়। এভাবে ফজরের নামাযের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত, আছরের নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
যদি ফরয নামায আরম্ভ হয়ে যায় তবে তাহিয়াতুল মসজিদ না পড়ে জামাতে শরীক হবেন। তখন তাহিয়াতুল মসজিদ পড়ার প্রয়োজন হবে না।
যদি জায়গা না পান তবে মসজিদে যে কোনো স্থানে দুরাকাত তাহিয়াতুল মসজিদ পড়বেন। প্রথম রাকাতে সূরা কাফিরূন ও দ্বিতীয় রাকাতে সূরা এখলাছ পড়া ভালো। মিহরাবুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তাহিয়াতুল মসজিদ পড়া উত্তম। নামাযের পর হামদ ও দরূদ পাঠ করে দুআ করবেন। কোনো কোনো উলামার মতে শুকরিয়ার সিজদা করা ভালো। আমাদের হানাফী উলামাগণের অনেকের মতে দুরাকাত শুকরিয়া নামায পড়া ভালো। তাহিয়াতুল মসজিদ পড়ার পর আদবের সাথে মাকছুরা শরীফের দিকে আসবেন। সালাম পেশ করার সময় মাকছুরা শরীফের দক্ষিণ পাশে উত্তরমুখী হয়ে দাঁড়াবেন। অর্থাৎ কিবলার দিকে পিঠ দিয়ে চেহারা মুবারকের দিকে মুখ করে দাঁড়াবেন। তবে অনেকের মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র দৃষ্টির সামনে নিজেকে উপস্থিত করার উদ্দেশ্যে সোজা চেহারা মুবারকের দিকে না দাঁড়িয়ে যৎসামান্য পরিমাণ কিবলার দিকে মোড় নিবেন। তার অর্থ এ নয় যে, আপনি কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াবেন। মাকসুরা শরীফের বেষ্টনী বাব জালীর দক্ষিণ পাশে জালীর মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা বরাবরে ছিদ্র আছে এবং চাঁদের নিশানা আছে।
প্রকাশ থাকে যে, চেহারা মুবারকের দিকে দাঁড়ালে সামনের দিক উত্তর, পিছনের দিক দক্ষিণ, ডান দিক পূর্ব এবং বাম দিক পশ্চিম হয়। এখন যতবেশি সম্ভব আদবের দিক লক্ষ্য রেখে বিনীত নয়নে হাত-পা নড়াচড়া না করে অন্তরের ধ্যানের সাথে নামাযের মতো হাত বেঁধে দাঁড়াবেন। আমাদের হানাফী মাযহাবের উলামাগণের মধ্যে নামাযের মতো হাত বাঁধা বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে হাত বাঁধাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আসল কথা হলো, এখানে দেহ মন সব কিছুকে খালিসভাবে আদবের বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলতে হবে। উল্লেখ্য, হাত যদিও না বাঁধেন তবুও বাঁধার অবস্থার চেয়েও বেশি আদবের খেয়াল রাখবেন।
হে মুসাফির! লক্ষ্য করুন, আপনি কোথায় দাঁড়ালেন? ফেলে আসা জীবনের দিনগুলিতে কত উত্থান-পতন আপনার হয়েছে। জীবনে চলার পথে কত ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত হয়ে আজ ক্ষত-বিক্ষত ব্যথিত হৃদয় নিয়ে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে যিনি আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত আপনজন তাঁরই দরবারে এসেছেন। জীবনে বার বার এ দরবারে আসা কি সহজসাধ্য ব্যাপার? তাই আজ জনমের মতো কেঁদে কেঁদে সালাম পেশ করুন। ওসীলা নিয়ে দুআ করুন। শাফাআত ভিক্ষা করুন। বিশ্বাসের ভীত যদি নড়বড়ে হয়, বঞ্চিত হয়ে ফিরে আসতে পারেন।
ادب گاہست زیر آسماں نازک تراز عرش
نفس گم کردہ بآیدبایز یدوجنید ا یجاہ
পাক-দরবারে দাঁড়িয়ে শুধু সালাম পেশ করে চলে আসলে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কর্ম বাদ পড়ে যায়।
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওসীলা নিয়ে দুআ করা।
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শাফাআত চাওয়া।
ইমাম ইবনুল হুমাম বলেন-
ثُمَّ يَسْأَلُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الشَّفَاعَةَ فَيَقُولُ يَا رَسُولَ اللهِ أَسْأَلُك الشَّفَاعَةَ، يَا رَسُولَ اللهِ أَسْأَلُك الشَّفَاعَةَ وَأَتَوَسَّلُ بِك إلَى اللهِ فِي أَنْ أَمُوتَ مُسْلِمًا عَلىٰ مِلَّتِك وَسُنَّتِك.
তরজমা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শাফাআত চাইবেন। বলবেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি আপনার কাছে শাফাআতপ্রার্থী। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার কাছে শাফাআতপ্রার্থী। আপনার ওসীলা আল্লাহ তাআলার দরবারে পেশ করছি যেন আমি মুসলমান রূপে মৃত্যুবরণ করি, আপনার মিল্লাতের উপর ও আপনার সুন্নতের উপর। (ফতহুল কাদির, ৩য় খÐ, ৯৫ পৃষ্ঠা)
ইমাম ইবনুল হুমাম বলেন-
وَيَسْأَلُ اللهَ تَعَالٰى حَاجَتَهُ مُتَوَسِّلًا إلَى اللهِ بِحَضْرَةِ نَبِيِّهِ عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ. وَأَعْظَمُ الْمَسَائِلِ وَأَهَمُّهَا سُؤَالُ حُسْنِ الْخَاتِمَةِ وَالرِّضْوَانِ وَالْمَغْفِرَة.
তরজমা: আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করবেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দাঁড়িয়ে তারই ওসীলা নিয়ে। দুআগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুআ হল-
১. আল্লাহ তাআলা যেন খাতিমা বিল খায়র করেন (অর্থাৎ স্বীয় রহমতের দ্বারা ঈমানের সাথে নিরাপদে মৃত্যুর সংকটময় মুহূর্তে পার করে নেন)।
২. আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি।
৩. ক্ষমা। (ফতহুল কাদির ৩য় খন্ড, ৯৫ পৃষ্ঠা)
যদি আদবের দিকে পূর্ণ লক্ষ্য রেখে ভাবাপ্লুত হৃদয়ে অন্তরের আবেগে দীর্ঘ সালাম পেশ করা যায় তবে উত্তম। না হয় মনোযোগ সহকারে আদবের দিকে লক্ষ্য রেখে সংক্ষিপ্ত সালামের শব্দকে বার বার উচ্চারণ করে হৃদয়কে ভাবমত্ত করা যায়। পূর্ববর্তী মাননীয় উলামায়ে কিরামের মধ্যে অনেকের অভ্যাস ছিল ভাব ভক্তির সাথে কেঁদে কেঁদে সংক্ষিপ্ত সালাম পেশ করা।
জালি (বেষ্টনি) থেকে কিছু দূরে যথোচিত বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়ান। আপনি বিশ্বাস করুন রাহমাতুল্লিল আলামীন আপনাকে দেখছেন, আপনার কথাগুলি শ্রবণ করছেন, আপনার ফরিয়াদ শ্রবণ করছেন। আপনার সালামের উত্তর দান করছেন।
অতঃপর নম্রসুরে নিম্নরূপ সালাম পেশ করবেন (বেশি উচ্চ কন্ঠও নয়, একেবারে আস্তেও নয়)।
السَّلَامُ عَلَيْك يَا رَسُولَ اللهِ،
السَّلَامُ عَلَيْك يَا خَيْرَ خَلْقِ اللهِ،
السَّلَامُ عَلَيْك يَا خِيرَةِ اللهِ مِنْ جَمِيعِ خَلْقِهِ،
السَّلَامُ عَلَيْك يَا حَبِيبَ اللهِ،
السَّلَامُ عَلَيْك يَا سَيِّدِ وَلَدِ آدَمَ،
السَّلَامُ عَلَيْك أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ،
يَا رَسُولَ اللهِ، إنِّي أَشْهَدُ أَنْ لَا إلٰهَ إلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّكَ عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
وَأَشْهَدُ أَنَّكَ يَا رَسُولَ اللهِ قَدْ بَلَّغْتَ الرِّسَالَةَ وَأَدَّيْتَ الْأَمَانَةَ وَنَصَحْتَ الْأُمَّةَ وَكَشَفْتَ الْغُمَّةَ،
فَجَزَاكَ اللهُ عَنَّا خَيْرًا، جَزَاكَ اللهُ عَنَّا أَفْضَلَ مَا جَزَى نَبِيًّا عَنْ أُمَّتِهِ.
اللّٰهُمَّ اٰتِهِ الْوَسِيلَةَ وَالْفَضِيلَةَ، وَالدَّرَجَةَ الرَّفِيعَةَ، وَابْعَثْهُ الْمَقَامَ الْمَحْمُودَ الَّذِي وَعَدْتَّهُ،
وَأَنْزِلْهُ الْمَنْزِلَ الْمُقَرَّبَ عِنْدَك، إنَّك سُبْحَانَك ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ.
তরজমা: ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনার উপর সালাম। সালাম আপনার উপর, হে সৃষ্টির সর্বোত্তম। আল্লাহ তাআলা কর্তৃক সৃষ্টির মধ্যে মনোনীত সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যক্তিত্ব আপনার উপর সালাম। হে আল্লাহর হাবীব, আপনার উপর সালাম। হে বনী আদমের সরদার, আপনার উপর সালাম। হে নবী আপনার উপর সালাম, আল্লাহর রহমত ও বরকত আপনার উপর নাযিল হোক। ইয়া রাসূলাল্লাহ! নিশ্চয় আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য অন্য কেউ নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আপনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন, আমানত পৌঁছে দিয়েছেন, উম্মতের সার্বিক মঙ্গল কামনা করেছেন এবং সার্বিক মঙ্গলের আহবান করেছেন, দুঃখের কারণগুলি দূর করেছেন। আল্লাহ তাআলা উম্মতের পক্ষ থেকে নবীগণকে যে উত্তম প্রতিফলন দান করেছেন তন্মধ্যে উত্তম প্রতিদান যেন আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে দান করেন। হে আল্লাহ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দান করো ওসীলার মর্যাদা, ফযীলত ও বুলন্দ মরতবা। তোমার ওয়াদাকৃত মাকামে মাহমুদে তাঁকে অধিষ্ঠিত করো। তোমার নৈকট্য দান করো। (হে আল্লাহ!) নিশ্চয় তুমি পবিত্র, মহান অনুগ্রহশীল।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওসীলা নিবেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শাফাআত চাইবেন। বলবেন-
ياَ رَسُوْلَ اللهِ اَسْئَلُكَ الشَّفاَعَةَ وَاَتَوَسَّلُ بِكَ اِلَى اللهِ فِى اَنْ اَمُوْتَ مُسْلِمًا عَلىٰ مِلَّتِكَ وَسُنَّتِكَ.
তরজমা: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার নিকট শাফাআত চাইছি এবং আপনার ওসীলা নিয়ে আল্লাহর নিকট দুআ করছি যেন আপনার সুন্নত ও দ্বীনের উপর আমাকে মৃত্যু দান করেন।
যদি কোনো ব্যক্তি বিশেষ সালাম পৌঁছানোর জন্য বলে থাকেন তবে তার সালাম এভাবে পেশ করবেন।
السَّلاَمُ عَلَيْكَ ياَرَسُوْلَ اللهِ مِنْ فُلاَنِ بْن فُلاَنٍ يَسْتَشْفِعُ بِكَ اِلٰى رَبِّكَ وَاَشْفَعْ لَهُ وَلِجَمِيْعِ الْمُسْلِمِيْنَ.
ইয়া রাসূলুল্লাহ! অমুকের ছেলে অমুকের পক্ষ থেকে আপনার উপর সালাম। তিনি আপনার রবের সমীপে আপনার শাফাআতের আবেদন করছেন। আপনি ঐ ব্যক্তি ও তামাম মুসলমানের শাফাআত করুন।
فُلاَنِ بْن فُلاَنٍ এর স্থলে ঐ ব্যক্তির নাম ও পিতার নাম বলবেন। যেমন :
الَسَّلاَمُ عَلَيْكَ ياَرَسُوْلَ اللهِ مِنْ عِمَادِ الدِّيْنِ بْنِ عَبدِ اللَّطِيْفِ يَسْتَشْفِعُ بِكَ اِلٰى رَبِّكَ وَاَشْفَعْ لَهُ وَلِجَمِيْعِ الْمُسْلِمِيْنَ.
ইমাম কাসতালানী (র.) প্রণীত মাওয়াহিবের ভাষ্যকার আল্লামা যুরকানী বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি যিয়ারতকারীর নিকট সালাম পৌঁছানোর জন্য আবেদন করেন এবং যিয়ারতকারী ঐ ব্যক্তির সাথে ওয়াদা করেন যে, তিনি সালাম পৌঁছাবেন তবে উক্ত ব্যক্তির পক্ষে সালাম পৌঁছানো ওয়াজিব হয়ে যায়।
যদি অনেক লোক সালাম পৌঁছানোর জন্য বলেন এবং সকলের নাম স্মরণ না থাকে তবে এভাবে তাদের পক্ষ থেকে সালাম পেশ করবেন:
اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ ياَرَسُوْلَ اللهِ مِنْ جَمِيْعِ مَنْ اَوْصَانِىْ بِالسَّلاَمِ عَلَيْكَ.
তরজমা: ইয়া রাসূলাল্লাহ! যারা আপনার নিকট সালাম পৌঁছানোর জন্য আমাকে বলেছেন তাদের পক্ষ থেকে আপনার উপর সালাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর উত্তর পাশে আবূ বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এমনভাবে আছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র কাঁধের বরাবরে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর চেহারা মুবারক। তাই একহাত ডান দিকে সরে দাঁড়িয়ে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে সালাম করবেন। চেহারা মুবারকের বরাবরে ছিদ্র আছে।
السَّلَامُ عَلَيْك يَاخَلِيْفَةَ رَسُولِ اللهِ- السَّلَامُ عَلَيْك يَا صَاحِبَ رَسُوْلِ اللهِ فِى الْغَارِ-السَّلَامُ عَلَيْك يَا رَفِيْقَهُ فِى الْاَسْفَارِ- السَّلَامُ عَلَيْك يَا اَمِيْنَهُ عَلَى الْاَسْرَارِ جَزَاكَ اللهُ عَنَّا اَفْضَلَ مَاجَزَى اِمَامًا عَنْ اُمَّةِ نَبِيِّهِ وَلَقَدْ خَلَفْتَه بِأَحْسَنِ خَلْفٍ وَسَلَكْتَ طَرِيْقَهُ وَمِنْهَاجَهُ خَيْرَ مَسْلَكٍ وَقَاتَلْتَ اَهْلَ الرِّدَّةِ وَالْبِدْعِ وَمَهَّدْتَ الْاِسْلَامَ وَوَصَلْتَ الْاَرْحَامَ وَلَمْ تَزَلْ قَائِلًا لِلْحَقِّ نَاصِرًا لِاَهْلِهِ حَتّٰى اَتَاكَ الْيَقِيْنُ- وَالسَّلَامُ عَلَيْك وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ اللّٰهُمَّ اَمِتْنَا عَلٰى حُبِّهِ وَلَاتُخَيِّبْ سَعْيَنَا فِى زِيَارَتِهِ بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ.
তরজমা: হে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খলীফা! আপনার উপর সালাম। হে পর্বতের গুহায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী, আপনার উপর সালাম। সালাম আপনার উপর, হে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সফরের সাথী। সালাম আপনার উপর, হে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোপন তথ্যের হেফাযতকারী। কোনো ইমামকে নবীর উম্মতের পক্ষ থেকে যে উত্তম প্রতিদান করা হয়, তন্মধ্যে উত্তম প্রতিদান যেন আপনাকে আল্লাহ তাআলা দান করেন। নিশ্চয় আপনি সর্বাপেক্ষা সুষ্ঠুভাবে খিলাফতের কর্তব্য সম্পন্ন করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথে আপনি নিজেকে পরিচালিত করেছেন এবং সে পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, যে পদ্ধতি সর্বাপেক্ষা ভালো। মুরতাদ ও বিদআতী দলের সাথে আপনি জিহাদ করেছেন। ইসলামকে আপনি শক্তিশালী করেছেন। সদা-সর্বদা সত্য কথা বলেছেন। সত্য পথের পথিকগণকে সাহায্য করেছেন মৃত্যু পর্যন্ত। আপনার প্রতি সালাম। আপনার উপর আল্লাহর রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হোক। হে আল্লাহ তাআলা, আমি যেন তাঁর মহব্বতের মধ্যে মৃত্যুবরণ করি। হে সর্বাপেক্ষা অধিক রহমতের মালিক, তোমার রহমতের বদৌলতে আমার যিয়ারতের এ প্রচেষ্টা যেন বৃথা না যায়।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর উত্তর পাশে হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এমনভাবে আরাম করেছেন যে সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর স্কন্ধদেশের বরাবরে তাঁর চেহারা রয়েছে। তাই আরোও একহাত ডান দিকে সরে দাঁড়ালে আপনি হযরত উমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর চেহারা মুবারকের সামনে নিজেকে উপস্থিত করতে পারবেন। সেখানে আদবের সাথে দাঁড়িয়ে নি¤œরূপ সালাম পেশ করবেন। চেহারা মুবারকের বরাবরে ছিদ্র আছে।
اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا اَمِيْرَ الْمُؤْمِنِيْنَ يَا مُظْهِرَ الْاِسْلَامِ اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ يَا مُكَسِّرَ الْاَصْنَامِ- جَزَاكَ اللهُ عَنَّا اَفْضَلَ الْجَزَاءِ وَرَضِىَ عَمَّنِ اسْتَخْلَفَ فَقَدْ نَظَرَ لِلْمُسْلِمِيْنَ وَالْاِسْلَامِ حَيَّا وَمَيْتًا فَكَفَّلْتَ الْاَيْتَامَ وَوَصَلْتَ الْاَرْحَامَ وَقَوَى بِكَ الْاِسْلَامُ وَكُنْتَ لِلْمُسْلِمِيْنَ اِمَامًا مَرْضِيًّا وَهَادِيًا مَّهْدِيًا جَمَعْتَ شَمْلَهُمْ وَاَغْنَيْتَ فَقِيْرَهُمْ وَجَبَرْتَ كَسِيْرَهُمْ فَالسَّلَامُ عَلَيْكَ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُه.
তরজমা: হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার উপর সালাম। হে ইসলামকে প্রকাশকারী, আপনার উপর সালাম। ভূত ও মূর্তি ধ্বংসকারী, আপনার উপর সালাম। আল্লাহ তাআলা যেন আপনাকে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম প্রতিদান দেন। আল্লাহ তাআলা যেন তাঁর উপর সন্তুষ্ট হন যিনি আপনাকে খলীফা মনোনীত করেছিলেন। নিশ্চয় তিনি জীবনে মরণে মুসলমানদের মঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন। আপনি এতীমের প্রতিপালন করেছেন। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেছেন। আপনি ইসলামকে শক্তিশালী করেছেন। আপনি মুসলমানদের পছন্দনীয় হেদায়াতকারী এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত ইমাম ছিলেন। আপনি মুসলানগণের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করেছেন, সম্বলহীনকে সম্পদশালী করেছেন, মুসলমানদের ভাঙ্গনকে সংহত করেছেন। আপনার প্রতি সালাম। আপনার উপর আল্লাহর রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হোক।
আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিদমতে সালাম পেশ করার পর অর্ধহাত পরিমাণ বাম দিকে এসে উভয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উভয়ের প্রতি সালাম পেশ করবেন:
اَلسَّلَامُ عَلَيْكُمَا يَا ضَجِيْعَىْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَرَفِيْقَيْهِ وَوَزِيْرَيْهِ وَمُشِيْرَيْهِ وَالْمُعَاوِنَيْنِ لَهُ عَلَى الْقِيَام فِى الدِّيْنِ- وَالْقَائِمَيْنِ بَعْدَه بِمَصَالِحِ الْمُسْلِمِيْنَ جَزَاكُمَا اللهُ اَحْسَنَ الْجَزَاءِ- جِئْنَا نَتَوَسَّلُ بِكُمَا اِلىٰ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِيَشْفَعْ لَنَا وَيَسْأَلَ رَبَّنَا اَنْ يَّتَقَبَّلَ سَعْيَنَا وَيُحْيِنَا عَلىٰ مِلَّتِهِ وَيُمِيْتَنَا عَلَيْهَا وَيُحْشَرَنَا فَىْ زُمْرَتِهِ.
তরজমা: সালাম আপনাদের উভয়ের উপর হে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বিশ্রাম গ্রহণকারী, তাঁর সাথী, ওযীর, পরামর্শদানকারী, দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে সাহায্যদানকারী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর দ্বীনের মহান দায়িত্ব সম্পন্নকারীদ্বয়, আল্লাহ তাআলা যেন আপনাদের উভয়কে উত্তম প্রতিদান দান করেন। আপনাদের উভয়ের সামনে আমরা উপস্থিত হয়েছি রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমীপে আপনাদের ওসীলা গ্রহণ করার জন্য। রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন আমাদের শাফাআত করেন। তিনি আমাদের পরওয়ারদিগারের নিকট দুআ করেন যেন আমাদের প্রচেষ্টা আল্লাহর দরবারে গ্রহণীয় হয় এবং আমরা যেন মিল্লাতে মুহাম্মদীর উপর জীবন অতিবাহিত করি ও মৃত্যুবরণ করি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দলের সাথে যেন হাশর হয়।
তারপর বাম দিকে সরে পুনরায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মুবারকের সামনে আসবেন এবং পাঠ করবেন:
يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- قَدْ قَالَ اللهُ تَعَالىٰ سُبْحَانَه وَلَوْ اَنَّهُمْ اِذْ ظَلَمُوْا اَنْفُسَهُمْ جَائُوْكَ فَاسْتَغْفَرُوْا اللهَ وَاسْتَغْفَرَلَهُمُ الرَّسُوْلُ لَوَجَدُوا اللهَ تَوَّابًا رَّحِيْمًا- فَجِئْناكَ ظَالِمِيْنَ لِاَنْفُسِنَا مُسْتَغْفِرِيْنَ مِنْ ذُنُوْبِنَا فَاشْفَعْ لَنَا اِلٰى رَبِّنَا وَاسْئَلْه اَنْ يُّمِيْتَنَا عَلٰى سُنَّتِكَ وَاَنْ يَّحْشُرَنَا فِى زُمْرَتِكَ.
তরজমা: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আল্লাহ বলেছেন, যারা গোনাহ করে নিজের উপর অত্যাচার করেছে, তারা যদি আপনার কাছে এসে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাদের জন্য মাগফিরাত চান তবে নিশ্চয় আল্লাহ তাআলাকে সে তওবা কবুলকারী ও করুণা প্রদর্শনকারীরূপে পাবে। ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা আপনার নিকট এসেছি নিজেদের উপর অত্যাচার করে গোনাহের মাগফিরাত কামনা করতে। আপনি আমাদের জন্য আমাদের পরওয়ারদিগারের নিকট শাফাআত করুন। আপনি দুআ করুন যেন আল্লাহ তাআলা আপনার সুন্নতের উপর আমাদেরকে মৃত্যু দান করেন এবং আপনার সঙ্গীদের সাথে হাশরে একত্রিত করেন।
অতঃপর বিনয় সহকারে হাত উঠিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওসীলা নিয়ে আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করবেন। দুআ করবেন নিজের জন্য, পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন, পীর, মুর্শিদ, উস্তায ও যাদের হক আপনার উপর আছে তাদের জন্য এবং সব মুসলমানের জন্য।
অতঃপর মাকছুরা শরীফের সম্মুখ থেকে মাকছুরা শরীফের পশ্চিমে অবস্থিত রিয়াদুল জান্নাতে প্রবেশ করবেন (মিম্বর শরীফ ও কবর শরীফের মধ্যবর্তী স্থানকে রিয়াদুল জান্নাহ বলা হয়)। রিয়াদুল জান্নাতে প্রবেশ করে উস্তুনায়ে আবি লুবাবার নিকট দাঁড়িয়ে দুরাকাত নফল নামায পড়ে দুরূদ পাঠ করে আল্লাহ তাআলার নিকট গোনাহের মাগফিরাত চাইবেন। তারপর পবিত্র মিম্বর শরীফের হাতলে (রুম্মানায়) ডান হাত রেখে দুরূদ পাঠ করবেন ও দুআ করবেন। অতঃপর উস্তুনায়ে হান্নানা (হান্নানা নামক থাম) এর নিকট এসে দুরূদ পাঠ করবেন এবং দুআ করবেন। অতঃপর অন্যান্য বরকতময় থামগুলির নিকট এসে দুআ করবেন। সহজসাধ্য হলে নফল নামায আদায় করবেন।
মোল্লা আলী কারী (র.) মদীনা শরীফ অবস্থানকালে যে কয়েকটি কাজ করা উত্তম বলেছেন তন্মধ্যে রয়েছে-
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বেশি বেশি দুরূদ ও সালাম পাঠ করা।
২. কমপক্ষে কুরআন শরীফ এক খতম করা।
৩. যতদিন সম্ভব রোযা রাখা।
৪. মদীনাবাসীকে দান খয়রাত করা।
৫. সব রকমের উত্তম কাজ অধিক করা।
৬. মদীনাবাসীকে সম্মান করা ও তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা।
৭. কমপক্ষে একটি রাত সমস্ত রাত্রি ইবাদত করা (তবে যতটুকু সম্ভব বেয়াদবী থেকে নিজেকে রক্ষা করে)।
৮. জামাআতের সাথে নামায আদায় করা।
সকল উলামায়ে কিরাম ও বুযুর্গানে দ্বীন মদীনা শরীফের পথে ও মদীনা শরীফ অবস্থানকালে বেশি দুরূদ শরীফ পাঠ করার জন্য বলেছেন। শুধু দুরূদ সালামের কথা বলেই শেষ করেননি, বলেছেন মনোযোগ সহকারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি গভীর প্রেমানুভূতি নিয়ে সালাত, সালাম পাঠ করবেন। প্রয়োজনীয় কর্ম ও ফরয আমল ছাড়া যত সময় অবশিষ্ট থাকে সব দুরূদ পাঠে অতিবাহিত করা উত্তম বলে মোল্লা আলী কারী (র.) বলেছেন।
একটি প্রশ্ন আসে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত নফল ইবাদতসমূহের মধ্যে উত্তম। তাহলে এসময় কি শুধু তিলাওতে অতিবাহিত করা হবে?
এর উত্তর হলো এসময় অধিক দুরূদ শরীফ পাঠ করা অধিক তিলাওয়াত থেকে উত্তম। যেমন-রুকু সিজদার সময় তাসবীহ পাঠ করা তিলাওয়াতের চেয়ে উত্তম, রুকুতে তিলাওয়াত করা মাকরূহ। অনুরূপভাবে মদীনা শরীফ অবস্থানের সময় অধিক দুরূদ পাঠ করা উত্তম। তাছাড়া অবস্থানকালে কমপক্ষে কুরআন শরীফ এক খতম করা উত্তম। আমার পিতা হযরত মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল লতীফ ছাহেব ফুলতলী (র.) স্বীয় মুরীদগণকে মদীনা শরীফে অবস্থানকালে দরূদ শরীফের ওযীফা ‘দালাইলুল খায়রাত’ ও ‘কাসীদায়ে বুরদা’ পাঠ করার জন্য বলতেন। আল্লাহ তাআলা তাওফীক না দিলে কার সাধ্য আছে সুষ্ঠুভাবে কোনো কর্ম সম্পন্ন করার। তাই আমার মত লোকের পক্ষে বারবার পাঠ করা উচিত-
لاَحَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ اِلاَّ بِاللهِ الْعَلِىِّ الْعَظِيْمِ
মদীনা শরীফ অবস্থানকালে সর্বাবস্থায় মদীনাবাসীর প্রতি সদয় ও ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। মোল্লা আলী কারী (র.) বলেন-
وينبغى ان ينظر الى اهلها بعين التعظيم ولايبحث عن بواطنهم ويكل سراتهم الى الله تعالى ويحبهم بجوارهم كيفما كانوا اذ عظم الاساءة لاتسلب حرمة الجول.
তরজমা: মদীনাবাসীকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা উচিত। তাদের গোপন অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা (বা অন্বেষণ) না করে গোপন অবস্থা আল্লাহর উপর সোপর্দ করবেন। তারা যে অবস্থায় থাকেন না কেন রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিবেশী মনে করে তাদের ভালোবাসা উচিত। কেননা কোনো মন্দের জন্য প্রতিবেশীর মর্যার্দা ক্ষুণœ হয় না। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিবেশী। (লুবাব, ৩৫১ পৃষ্ঠা)।
যে মাটির পরশে কুষ্ঠরোগী আরোগ্য লাভ করে সে মাটিতে যাঁরা বাস করেন তাঁদের ভালোবেসে আমরা আত্মার যাবতীয় রোগ দূর করতে পারি। সে মাটিতে যুগের শ্রেষ্ঠ আউলিয়ায়ে কিরাম ছদ্মবেশে চলাফেরা করেন। হঠাৎ অসাবধানতাবশত কারো সাথে বেয়াদবী করলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদেরকে ভদ্র, বিনয়ী, মৌন, ধৈর্যশীল অবস্থায় সফর শেষ করার তাওফীক দান করেন। আমীন।
[উস্তাযুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, মুরশিদে বরহক হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী লিখিত “চল মুসাফির পাক মদীনায় সবুজ মিনার ঐ দেখা যায়” নামক গ্রন্থ থেকে সংকলিত, সুবহে সাদিক-২০১৭ থেকে সংগৃহীত]